বিজয়ের ৫১ বছর আমরা দেখতে দেখতে পার করে এলাম। দীর্ঘ নয় মাসের সশস্ত্র যুদ্ধে পাকবাহিনী ও তাদের অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক মিত্র তথা চীন–মার্কিন–সৌদি অক্ষশক্তিকে পরাস্ত করা গেলেও তাদের নির্মূল করা যায়নি বরং আদর্শিকভাবে তারা টিকে ছিল বিরাট সংখ্যক প্রতিক্রিয়াশীল সাম্প্রদায়িক চিন্তার অনুসারীদের মধ্যে। মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দল ও প্রবাসী সরকারের অভ্যন্তরের চিহ্নিত পাকিস্তানি এজেন্ট খোন্দকার মোস্তাকসহ সশস্ত্র রাজাকারদের চাইতেও বিপদজনক ও ক্ষতিকর কিছু লোকজনকে স্বাধীন দেশে বহাল তবিয়তে ক্ষমতায় রেখে দিয়ে শেয়ালকে মুরগী পাহারা দেয়ার মতো করে মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ গড়ার কাজ শুরু হয়। প্রতি পদে পদে প্রবাসী সরকারকে যারা বিপদগ্রস্ত করতে চেয়েছে এবং বঙ্গবন্ধুর অতি “কল্যাণকামী” সেজে প্রাজ্ঞ, মুক্তিযুদ্ধের প্রধান প্রকৌশলী, দৃঢ় নৈতিক চরিত্রের দুরদর্শী রাষ্ট্রনেতা তাজউদ্দিনকে বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে দূরে সরিয়ে দিয়ে বঙ্গবন্ধুকেই তারা চরম আঘাত করে। শেষ পর্যন্ত জীবন দিয়ে তাজ উদ্দিন প্রমাণ করলেন তিনি সেই কাদম্বিনির মত মরিয়াও মরেন নাই– তিনিই ছিলেন বঙ্গবন্ধুর অকৃত্রিম ও আমৃত্যু সুহৃদ। মোস্তাক চক্র ছাড়াও মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকে তাজউদ্দিন নজরুল ইসলামের প্রবাসী সরকার বিরোধী তৎকালীন তরুণ নেতৃত্ব যাদের প্রতি ভারত সরকারের একটি মহলের উদ্দেশ্যপূর্ণ সমর্থন ছিল, স্বাধীন দেশে তাদের মধ্যে র্যাডিকেল ও ত্যাগী অংশটি বিভ্রান্ত হয়ে বঙ্গবন্ধুর সরকার উচ্ছেদের চূড়ান্ত হঠকারী লাইনে চলে গেল অন্য অংশটি মোস্তাক গংয়ের শক্তিকে লঘু করে দেখে তাজউদ্দিনের বিরোধিতা অব্যাহত রাখে যার ফলে তাজউদ্দিনের সাথে বঙ্গবন্ধুর মত পার্থক্য বাড়তে থাকে এবং শেষ পর্যন্ত তাঁকে সরকার থেকে বাদ দেয়া হয়। তাঁর আরো ‘অপরাধ’ ছিল তিনি দৃঢ়ভাবে মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী পাক–মার্কিন চক্রের বিরোধী ছিলেন। ১৯৭২ সাল থেকেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিপরীতে দেশ যেভাবে চলছিল তাতে তিনি নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু সহ তাঁকে হত্যা করা হবে দেশ স্বাধীন করার অপরাধে কিন্তু ’৭১ এর মত সেই চক্রান্ত প্রতিরোধ করার অবস্থানে তিনি ছিলেন না প্রধানত তাঁর বিরুদ্ধে দলের শীর্ষ পর্যায়ে এক ধরনের পৎড়হু ধষষরধহপব এর কারণে। দ্বিতীয়ত, মুক্তিযুদ্ধের সময় সরাসরি বিরোধীতাকারী সাম্রাজ্যবাদী প্রতিক্রিয়া ও এদের ঘনিষ্ট সহযোগী প্যান ইসলামিক গোষ্ঠীর বিশাল শক্তি, ভিত্তি ও লক্ষ্য সম্পর্কে ঐ সময়ের সরকারের নির্বিকার ঔদাসীন্য ও উল্টো তাদের সাথে সম্পর্ক স্থাপনের আত্মঘাতী প্রচেষ্টা ও এরি ধারাবাহিকতায় ১৯৭৪ সালে ’৭১ এর মূল নর ঘাতক ভুট্টোকে এদেশে সফরে নিয়ে আসা হয়। ভুট্টো এই সফরে নানা বিতর্কের জন্ম দেয় কাজে ও আচরণে। এর এক বছরের মাথায় বঙ্গবন্ধুকে জীবন দিতে হয়। তৃতীয়ত, ৬ দফা আন্দোলনসহ ১৯৭০ সালের নির্বাচনে জাতীয় পরিষদের বহু আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা না করে আওয়ামী লীগের নিরংকুশ বিজয়ে এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে পরাশক্তি রাশিয়াকে নিয়ে আসা ও যুদ্ধে অংশগ্রহণসহ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এদেশের প্রকৃত বাম শক্তি মস্কোপন্থী কথিত ন্যাপ–সিপিবি। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে ক্ষমতায় বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতি জনিত সম্ভাব্য সংকটের কথা বিবেচনায় নিয়ে তাঁর সরকারকে রাজনৈতিক ঝুঁকি নিয়ে সমর্থন দেয়া বামশক্তিকে আমলে না নেয়া, সদ্য স্বাধীন দেশে সেই শক্তিকে নিয়ে সাময়িকভাবে হলেও দেশ পুনর্গঠনের ও শত্রুদের চূড়ান্তভাবে নিশ্চিহ্ন করার জন্য জাতীয় সরকার গঠন করা তো দূরে থাক বিকল্প শক্তি বা বিরোধী দল হিসাবে এদের দাঁড়াতে না দেয়া (১৯৭৩সালের নির্বাচন এর প্রমাণ) ছিল মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সরকারের চরম ভুল। চতুর্থত, জীবন মৃত্যুকে পায়ের ভৃত্য করে যে মুক্তি পাগল তারুণ্য অসম যুদ্ধে জেতে সেই তারুণ্য পরাজিত হতে থাকে জীবন যুদ্ধে। সঠিক নির্দেশনার অভাবে অনৈতিক পঙ্কিলতার কালিমায় লিপ্ত হয়ে পড়ে এদের বিরাট একটি অংশ। অপমৃত্যু ঘটে সমস্ত প্রতিকুলতাকে জয় করে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবার অপার সম্ভাবনাময় একটি অমিত শক্তির। এটাই ছিল দেশের জন্য বিরাট ক্ষতি ও ট্র্যাজেডি।
কার্যকারণ সম্পর্কে বাঁধা ইতিহাসের গতিপথে আকস্মিকতার কোন স্থান নেই। বাংলাদেশের অভ্যুদয় যেমন কোন আকস্মিক ঘটনা ছিল না তেমনি এর ভাবাদর্শগত পরাজয় রাজনৈতিক ও সামাজিক পশ্চাদপসরন তথা বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতার হত্যাকান্ড, পরাজিত ও নিষিদ্ধ ধর্মান্ধ শক্তির রাষ্ট্র ও সমাজে পুনরুভ্যুদয়, রাষ্ট্রীয় মদদে একটি শক্তিশালী লুটেরা ধনিক গোষ্ঠীর উদ্ভব, সব মিলিয়ে পাকিস্তানি ভাবাদর্শি প্রত্যাবর্তনও কোন আকস্মিক ঘটনা ছিল না মোটেও। উপরোল্লিখিত কারণগুলো ছাড়াও জাতীয় নেতৃত্বের অনুদারতা, শত্রু মিত্রের পার্থক্যকে আত্মম্ভরিতাসুলভ তাচ্ছিল্যে গুরুত্ব না দেয়া, ’৪৭ সালের পূর্বাপর সময় থেকে গড়ে উঠা গভীর সাম্প্রদায়িক সমাজ মানসকে অপনোদনের জন্য শিক্ষা ও সংস্কৃতির প্রগতিমুখী চর্চা সবচেয়ে জরুরি ভিত্তিতে এবং ব্যাপকভাবে শুরু করার গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োজনীয়তাকে উপলব্ধির মধ্যেও না আনা, প্রগতিশীল জাতীয় ঐক্যকে অপ্রয়োজনীয় মনে করে একলা চলো নীতিতে মুক্তিযুদ্ধের চাইতেও জটিল ও কঠিন, বৈষম্যহীন ও অসাম্প্রদায়িক দেশ গড়ার অপরিকল্পিত প্রচেষ্টা, পাকিস্তানি ভাবাদর্শের প্রতি বিশ্বস্ত দলীয় নেতাকর্মী ও আমলা এমনকি পাকিস্তান প্রত্যাগত পাক সামরিক বাহিনীর লোকজনদের শুধু বাঙালি বলে নির্বিচারে সামরিক বাহিনীতে আত্মীকরণ ও পদায়ন ইত্যাদি ছিল অপরিমেয় ত্যাগ ও রক্তের বিনিময়ে অর্জিত বিজয়, বিজিতের করতলগত হয়ে পড়ার কারণ।
টানা ২১ বছর ক্ষমতায় থেকে পাকিস্তানি ভাবাদর্শে বিশ্বাসী মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিরোধী শক্তি রাষ্ট্রীয় শক্তি ব্যবহার করে মনে মননে, সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্পে মানুষকে বিভ্রান্ত ও বিভক্ত করে চালু করে লুটপাটের অর্থনীতি। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা তো কোন বিমূর্ত বিষয় ছিল না। ’৭৫ এর পূর্বেই এ চেতনা বিরোধী কিছু কিছু কর্মকাণ্ড সীমিত পর্যায়ে শুরু হলেও জিয়ার শাসনামলে সামরিক শাসনের অধীনে মুক্তিযুদ্ধের উপরোল্লিখিত আদর্শ বিরোধী কাজ প্রাতিষ্ঠানিকভাবে পুরোপুরি শুরু হয়। রাজনীতিকে ডিফিকাল্ট করার প্রকাশ্য ঘোষণা দিয়ে নিষিদ্ধ ধর্মান্ধ শক্তিকে রাজনীতির মাঠে নামানো হয়। যুদ্ধাপরাধীরা রাজনীতি ও ক্ষমতায় জায়গা করে নেয়। এরশাদের আমলে এই প্রক্রিয়া প্রবলতর হয়ে পুরো রাষ্ট্র ও সমাজকে কলুষিত করে ফেলে। ১৯৮০ এর দশকের মাঝামাঝি থেকে এসব পরিবর্তনকে চ্যালেঞ্জ করার রাজনীতির বদলে আওয়ামী লীগ ক্রমে সেন্টার লেফট থেকে ডান দিকে ঘুরতে থাকে। ৯০ এর দশক থেকে এ আওয়ামী লীগ বঙ্গবন্ধু প্রণীত ’৭২ এর সংবিধানের মূল চেতনা থেকে সরে আসে। ১৯৬৪ থেকে ’৭০ সাল পর্যন্ত সামরিক শাসন ও একচেটিয়া পুঁজির শাসনকে মোকাবেলার বিপ্লবী অভিজ্ঞতা থেকে রাজনৈতিক চিন্তার র্যাডিকেল বিবর্তনের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু একজন সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট নেতায় পরিণত হন। তাজউদ্দিনকে সাথে নিয়ে বেছে নেন আপোষহীন রাজনৈতিক সংগ্রামের পথ। তাঁদের নেতৃত্বে পরিচালিত আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ছিল মূলতঃ সাম্রাজ্যবাদ ও ধর্মান্ধ প্রতিক্রিয়া বিরোধী জাতীয় মুক্তির লড়াই।
স্বাধীন দেশে শেষ পর্যন্ত পেরে না উঠে বঙ্গবন্ধু মানুষের মুক্তির প্রশ্নে গভীর আন্তরিকতা থেকে নিজের প্রিয় দল বিলুপ্ত করে দুর্নীতি, লুটপাট বিরোধী কল্যাণকামী আর্থ–সামাজিক কর্মসূচি ভিত্তিক দ্বিতীয় বিপ্লব বা বাকশালের কর্মসূচি তথা জাতীয় ঐক্যের পথ বেছে নেন– যদিও তখন অনেক দেরী হয়ে যায়। সে জায়গায় বর্তমান শাসক দল আওয়ামী লীগ জিয়া এরশাদের হাত ধরে গড়ে উঠা কতিপয় লুটেরা ধনিক গোষ্ঠীকে অবাধ লুটপাটের সুযোগ দিয়ে, জিয়ার পঞ্চম বাহিনী ধর্মান্ধ রাজনৈতিক দলগুলোকে নানাভাবে বিভক্ত করে, কাউকে নিজেদের পক্ষে নিয়ে ক্ষমতার রাজনীতি করছে। বঙ্গবন্ধু ও তাজউদ্দিনের আওয়ামী লীগ আর বর্তমান আওয়ামী লীগের এই দৃশ্যমান পার্থক্য মানুষ নিত্যদিনের অভিজ্ঞতায় উপলদ্ধি করছে– কাউকে বলে দিতে হচ্ছে না। ফলে সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য বন্ধ না করে ব্যাংক লুট ও দুর্নীতি বন্ধ না করে সরকারের লোকজন যখন মুক্তিযুদ্ধের চেতনা রক্ষার কথা বলে তখন মানুষের কাছে মহান মুক্তি সংগ্রাম নিয়ে ভুল বার্তা যায় যা মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী শক্তিকেই আদর্শগত ভাবে শক্তিশালী করে। জিয়া–এরশাদের অমানবিক দুস্কর্মের অপরাধ মানুষ বিশেষ করে এ শতকের তরুণ সমাজ মনে আনেনা, শুধু ভুক্তভোগীরা ছাড়া। তাহলে উত্তরণের পথ কোনটি? ক্ষমতায় বা ক্ষমতার বাইরে থেকেও বঙ্গবন্ধুর মত নীতিনিষ্ঠ অবস্থান থেকে গণবিরোধী রাজনৈতিক অর্থনীতি, ধর্মান্ধ শক্তির যে কোন তৎপরতার বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান নিয়ে অব্যাহত রাজনৈতিক লড়াইয়ের মাধ্যমে তারুণ্যের অফুরান পরিবর্তনকামী সহজাত সদিচ্ছাকে সঠিক ধারায় এনে বিপ্লবী গণঅভ্যুত্থানের সৃষ্টি করা– যে অভ্যুত্থানের ঢেউয়ে ’৬৯ এর মতো ভেসে যাবে প্রতিক্রিয়ার সমস্ত শক্তি ও সামর্থ্য। মনে রাখতে হবে এই দেশ মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ। বাংলাদেশের রক্তাক্ত মাটি, এর জল হাওয়া প্রতিক্রিয়ার প্রতিকূল। এখানেই স্বতঃস্ফূর্তভাবে গড়ে উঠে গণজাগরণ মঞ্চ, এখানেই নিরাপদ সড়কের দাবীতে পথে নামে স্কুলের ছাত্র ছাত্রীরা, এখানেই রাষ্ট্রীয় দূর্নীতি, ধর্মান্ধতা ও লুটেরা পুঁজি বিরোধী গণজাগরণও সম্ভব যদি গড্ডালিকা আর স্বৈরশাসনের ধারায় মুক্তিযুদ্ধের শক্তি হারিয়ে না যায়। ইতোপূর্বে আলোচিত আমাদের ভুল আর ব্যর্থতায় প্রতিক্রিয়া শক্তি পেয়েছে। সেই বিজিত শক্তির ভাবাদর্শগত অবস্থান থেকে তাদের আলখেল্লা পরে আমরা বিজয়ের উৎসব করছি সেই ’৭৫ থেকে।
’৭৫ এর জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত প্রদত্ত বঙ্গবন্ধুর ভাষণগুলো কিন্তু কেউ খুব বেশি শুনে না। ঐ ভাষণগুলো ছিল দুর্নীতিবাজ লুটেরাদের বিরুদ্ধে, নিজ দলের নেতাকর্মীদের সুবিধাবাদিতার বিরুদ্ধে, কৃষি, শিল্প–বাণিজ্য সরকারী নিয়ন্ত্রণে রেখে মানুষের কল্যাণে কাজ করার একটি আর্থ–রাজনৈতিক দর্শনের পক্ষে উচ্চকিত। তিনি শেষ পর্যন্ত মানব মুক্তির আপোষহীন কঠিন পথে হেঁটেছেন। সেই পথে জীবন দিয়ে অমর হয়ে রয়েছেন, অপার মহিমায় ভাস্বর হয়ে আছেন মুক্তিকামী মানুষের অন্তরে। তাঁর প্রিয় কবি রবি ঠাকুরের মত তিনি জানতেন “আমৃত্যু দুঃখের তপস্যা এ জীবন– সত্যের দারুন মূল্য/লাভ করিবারে/মৃত্যুতে সকল দেনা/শোধ করে দিতে।”
লেখক : প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট।