মুক্তিযুদ্ধ আমাদের অর্জিত বিজয়গাথা। তার সাথে অন্যকিছুর তুলনা হয় না। হতে পারে আমরা আমাদের বিজয়ের যে আকাঙ্ক্ষা তার বাস্তবায়ন ঘটাতে সক্ষম হইনি। যারা ক্ষমতায় ছিল তারা মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ থেকে সরে গিয়ে নিজেদের স্বার্থকেই প্রাধান্য দিয়েছে। জনগণকে প্রতারিত করেছে। গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ করেছে। ক্ষমতা কুক্ষিগত করেছে। তাই বলে ত্রিশ লক্ষ শহীদের রক্তের বিনিময়ে পাওয়া স্বাধীনতা আর চব্বিশের স্বৈরাচার হটানোর গল্প কি এক হতে পারে? একাত্তর আর চব্বিশকে মুখোমুখি করে অনেক বক্তব্যই আমাদের আশাহত করছে। মুক্তিযুদ্ধ আর মুক্তিযোদ্ধাদের অসম্মান করার ব্যাপারটা মোটেও শুভ লক্ষণ হতে পারে না। এটি আমাদের অহংকারের জায়গা। আর বঙ্গবন্ধু হচ্ছে এক অমোচনীয় নাম। কিছুতেই কোনোভাবেই তাঁকে মোছা যায় না। ইতিহাস ডান থেকে শুরু হোক অথবা বাঁ থেকে। স্বৈরাচার হটিয়ে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ছাপিয়ে যাওয়া বা তুলনা করার ব্যাপার নয় এটি।
আমরা যারা মুক্তিযুদ্ধ দেখেছি আমরা তার গুরুত্বকে ধারণ করি। কিভাবে কতটা ত্যাগের বিনিময়ে স্বাধীনতা এসেছে তা আমরা দেখেছি! এবারের নিরুত্তাপ বিজয় দিবস নানারকম প্রশ্ন মনের ভেতর তোলপাড় করছে! কোনদিকে যাচ্ছে আমাদের স্বদেশ? কোন ভাবনায় নয়া জেন জি? মুক্তিযুদ্ধকে বিতর্কিত করা মানে নিজেদের বিতর্কিত করা! বাংলাদেশটার যখন জন্ম হয় তখন আমি সদ্য কৈশোরে প্রবেশ করেছি। সেই বয়সে একটা স্বাধীন ভূখণ্ডের জন্মযন্ত্রণা অনুভব করতে সক্ষম হয়ে উঠি। কারণ সময় আমাদের তৈরি করেছিলো। প্রতিটি মুহূর্ত ছিল শ্বাসরুদ্ধকর, প্রতিটি দিন মৃত্যুর মুখোমুখি। অবিরাম ধ্বংস আর মৃত্যুর খবরে মানুষ দিশেহারা। শহর থেকে গ্রাম, আবার গ্রাম থেকে গ্রামে প্রাণ বাঁচাতে ছোটাছুটি এক অকল্পনীয় সময়! মানুষের জীবন ছিল বাঘ আক্রান্ত ত্রস্ত হরিণের মতো! গ্রামের শান্ত সবুজ বনজঙ্গলগুলো কখনও কখনও হয়ে উঠেছিল বধ্যভূমি। নারীরা ছিল গনিমতের মাল। ভোগের নিশানা। তাই নারীর জীবন ছিল আরও বেশি কষ্টের। প্রাণ গেলে তো গেলোই! সম্ভ্রম হারিয়ে বেঁচে থাকাটা তো মৃত্যুর চেয়েও ভয়ংকর! অনেক পরিবারও যাদের গ্রহণ করেনি এমন নারীদের বঙ্গবন্ধু গভীর মমতায় নাম দিয়েছিলেন বীরাঙ্গনা! পরিচয় গোপনকারীদের পিতার জায়গায় নাম লিখতে বলেছিলেন তাঁর নাম। ঠিকানা ৩২নম্বর!
বাংলাদেশটাকে পাকিস্তানি হানাদার ও তাদের দোসরেরা কি করেছে আমরা ভুলিনি। টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া পর্যন্ত ছিল মৃত্যু উপত্যকা। গৃহহীন, আশ্রয়হীন মানুষ শুধু মৃত্যুর প্রহর গুনেছে। স্বাধীনতার জন্য উৎকণ্ঠায় আর আবেগে ভেসেছে। ভারতে আশ্রয় নেওয়া এক কোটি শরণার্থীদের তিন লাখ শরণার্থী কলেরা আর অনাহারে মৃত্যু হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধ করেছে খেয়ে না খেয়ে! জীবন হাতের মুঠোয় নিয়ে। একটি স্বাধীন ভূখণ্ডের জন্য, স্বপ্নের মতো একটা দেশের স্বপ্নে! হয়নি হবে। একটা বৈষম্যহীন সমাজ গড়ার জন্য কাজ করো। দেখিয়ে দাও ওরা পারেনি তোমরা পেরেছো! মুক্তিযুদ্ধকে কেন প্রতিপক্ষ করা! ক্ষমতার জন্য নয়, দেশকে ভালোবাসলে মুক্তিযুদ্ধের সম্পৃক্ত সবই ভালো লাগবে। মুক্তিযুদ্ধই আমাদের পরিচয়, চেতনা। আমাদের সামনে এগুতে হলে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ও চেতনাকে সামনে রাখতে হবে। এবং যে কোনো অবস্থায় স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে লড়াই চলমান রাখাও গণতন্ত্রের অন্যতম হাতিয়ার। কয়েকটি জেনারেশন আজও বেঁচে আছি যারা যুদ্ধ দেখেছে অথবা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে সরাসরি। এই মহাকাব্যকে আমৃত্যু লালন করব ত্যাগের বেদনায় আর বিজয় অর্জনের আনন্দে।