বিবিধ ধর্মীয় রীতি রেওয়াজ মেনে ষষ্ঠী থেকে শুরু করে সপ্তমী, মহাষ্টমী, মহানবমী পেরিয়ে দুর্গা পুজো পদার্পণ করল মহাদশমী তিথিতে। ষষ্ঠীতে দেবী দুর্গা স্বামীগৃহ ছেড়ে সপরিবারে এসেছিলেন পিতৃগৃহে। দশমী তিথিতে দেবী আবার পাড়ি দেবেন কৈলাসে। এই দিনেই মা দুর্গার প্রতিমা বিসর্জন দেওয়া হয় এবং শুরু হয় আবার এক বছরের অপেক্ষার পালা। ‘দশমী‘ মানেই ঘরের মেয়ে অর্থাৎ উমার এবার বিদায় বেলা। স্বভাবতই মন খারাপ থাকে সকলের। কারো মন চাইনা মেয়েকে বিদায় দিতে। কিন্তু, নিয়মানুযায়ী বিদায় তো দিতেই হবে। তাই হাজারো মন খারাপের মাঝেও হাসিমুখে সিঁদুর খেলা ও মিষ্টিমুখের মাধ্যমে মহা আড়ম্বরে ঘরের মেয়েকে তার শ্বশুরবাড়ি পাঠাতে ব্যস্ত থাকেন সকলে। মহিলারা সিঁদুর খেলায় মেতে ওঠেন। প্রাচীন যুগে এই দিনে ক্ষত্রিয়রা অস্ত্র পুজো করে পরের দিন যুদ্ধে রওনা দিতেন।
মায়ের বিসর্জন এর আগে মায়ের সামনে সাদা অপরাজিতা ফুল অর্পণ করা হয়। দেবী দুর্গার বিসর্জনের পর পুজো মণ্ডপের ঈশান কোণে অষ্টদল পদ্ম এঁকে অপরাজিতার লতা রেখে পুজো করা হয়। পুরান মতে অপরাজিতা আরাধনা দুর্গাপুজোর একটি অঙ্গ, কারণ উমা, দুর্গার অন্য নাম হল অপরাজিতা। তবে এই দেবীর মূর্তি অন্যরকম, অপরাজিতা চতুর্ভূজা, হাতে শঙ্খ, চক্র, বর ও অভয় মুদ্রা থাকে। দুর্গাপুজোর দশমীতে তাই সাদা আর নীল রঙের অপরাজিতা লাগে। নীল অপরাজিতা ফুলের মালা পরানো হয় দেবীকে। স্বয়ং শ্রীরামচন্দ্র দেবী অপরাজিতার পূজো প্রথম প্রচলন করেছিলেন বলে কথিত আছে। শত্রুকে দমনের জন্য এই দেবীরই আরাধনা করেন ভক্তরা। দেবী অপরাজিতা হলেন দেবী দুর্গারই এক রূপ। মূলত সাদা অপরাজিতা গাছকেই দেবী রূপে কল্পনা করে পুজো করা হয়। আগেকার দিনে সেজন্যই দশমীতে অপরাজিতা গাছের চারা রোপণ করা হত। লক্ষ্য ছিল– মঙ্গলকামনা। আর, যুদ্ধে জিতে বিজয়ী হওয়া। এই পুজোর শেষে ভক্তদের হাতে অপরাজিতা গাছের ডাল বেঁধে দেওয়া হয়।
এই বিজয়া দশমীর প্রকৃত তাৎপর্য হয়তো অনেকেরই অজানা। পিতৃগৃহ ছেড়ে উমা এবার ফিরে যাবেন কৈলাশে স্বামী মহাদেবের কাছে। তাই মর্ত্যবাসীর মন খারাপ। দুর্গাপুজোর এই শেষ দিনটিকে দশমী বা বিজয়া দশমী বলা হয়ে থাকে। কেন দশমীকে বিজয়া দশমী বলা হয়, তা এখন জেনে নেব আমরা। মহিষাসুর নামে এক অসুর ব্রহ্মার বর পেয়ে প্রবল ক্ষমতাশালী হয়ে স্বর্গ, মর্ত্য ও পাতাল দখল করে নেন। তিনি দেবরাজ ইন্দ্রকে স্বর্গ থেকে বিচ্যুত করেন। ব্রহ্মা তাঁকে বর দিয়েছিলেন যে কোনও পুরুষ তাঁকে হত্যা করতে পারবেন না। তবে কোনও নারী তাঁকে বধ করতে পারবেন না, এমন বর দেওয়া হয়নি। তখন সব দেবতার সম্মীলিত শক্তি থেকে আবির্ভূত হলেন দেবী দুর্গা। পুরাণে মহিষাসুর বধের কাহিনী অনুসারে টানা নয় দিন ও নয় রাত্রি যুদ্ধের পর শুক্লা দশমীতে দুর্গা মহিষাসুরকে বধ করেন। এই বিজয় লাভকেই বিজয়া দশমী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। ত্রেতা যুগে লংকার রাজা রাবণ শ্রীরামচন্দ্রের পত্নী সীতাকে অপহরণ করেছিলেন। দেবী দুর্গার আশীর্বাদ নিয়ে রাম স্ত্রীকে উদ্ধার করতে লংকা আক্রমণ করেন। শুক্লা দশমীতেই তিনি রাবণকে বধ করেন। রাবণের বিরুদ্ধে যুদ্ধে রামের জয়লাভকেও চিহ্নিত করে বিজয়া দশমী। উত্তর ও মধ্য ভারতে এই দিনে দশেরা উদযাপিত হয়। তবে তার তাৎপর্য সম্পূর্ণ আলাদা। ‘দশেরা‘ শব্দটির উৎপত্তি সংস্কৃত শব্দ ‘দশহর’ থেকে। যার অর্থ দশানন রাবণের মৃত্যু। বাল্মীকি রামায়নে বলা হয়েছে, আশ্বিন মাসের শুক্লা দশমী তিথিতেই লঙ্কেশ্বর রাবণকে বধ করেছিলেন রাম। কালিদাসের রঘুবংশ তুলসীদাস রামচরিত মানস সূত্রের সঙ্গে সংযোগ রেখেই বলা হয়েছে রাবণ বধের পরে আশ্বিন মাসের ৩০ তম দিনে অযোধ্যা প্রত্যাবর্তন করেন রাম, সীতা, লক্ষণ। রামচন্দ্রের প্রত্যাবর্তনকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য যথাক্রমে দশেরা ও দীপাবলি পালন করা হয়ে থাকে। দশেরা অর্থাৎ নবরাত্রি, এর প্রথম নয় দিন মা দুর্গাকে পুজো করা হয় নানা ভাবে। নবরাত্রি মানে নয়টি রাত্রি, যা নয়টি গ্রহের পরিচালনায় ঠিক মতো চালিত করতে পারে। শুধুমাত্র দুর্গাপুজোর বাহ্যিক আড়ম্বরই নয়, মনের অন্তর থেকে দেবীকে পুজো করে প্রতিটা গ্রহের প্রভাবে যেন ঠিক ভাবে শরীর চালিত হয়, সেই প্রার্থনা করা। দশমী পূজার অঞ্জলি দেওয়ার সময় সাদা বা নীল অপরাজিতা ফুল অর্পণ করা। শক্তির আরাধনা চলতে থাকে। অতঃপর দশম দিনে মাকে বিশেষ ভাবে সম্মান জানানো হয়। তার পর মাকে বিসর্জন দেওয়া হয়।