বাংলাদেশে বিগত দুই দশকে সবসময়ই ‘উন্নয়ন’ নিয়ে সরগরম থেকেছে জাতীয় রাজনীতি। বাজেট বরাদ্দের বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় হয়েছে অবকাঠামো নির্মাণে। দেশে যেসময় পদ্মাসেতু, মেট্রোরেল, কর্ণফুলী টানেল নিয়ে টেবিল গরম আলোচনা চলেছে, তারই মধ্যে উহ্য থেকে গেছে উন্নয়ন–বৈষম্যের ভয়াবহ চিত্র। কঙবাজারের সোনাদিয়া দ্বীপের মতোই প্রান্তিক ছিন্নমূল জনপদগুলোকে দেশের উন্নয়নের মূলধারায় ফেরানোর ব্যাপারে কোনো উদ্যোগই নেয়নি সরকার।
সোনাদিয়া কঙবাজারের মহেশখালী উপজেলার একটি দ্বীপ। কলেবরে ৯ বর্গকিলোমিটারের এ দ্বীপটি কঙবাজার জেলা শহর থেকে প্রায় ১৫ কিলো দূরে। শুঁটকি, সামুদ্রিক মাছের জন্য পরিচিত বঙ্গোপসাগরের এ দ্বীপটি শেষবার আলোচনায় এসেছিলো ২০১২ সালে, তৎকালীন সরকার সোনাদিয়া গভীর সমুদ্র বন্দরের ঘোষণা করেও সে সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে। বিগত দশকে দেশে পরিবর্তনের যত হাওয়াই বয়েছে, সোনাদিয়া পর্যন্ত তা পৌঁছায়নি কোনোদিনও। আজও এ দ্বীপটিতে বসবাসরত প্রায় দুই শতাধিক পরিবারের নেই একটিও পাকাবাড়ি।
দারিদ্র্যপীড়িত এ জনপদে স্বাস্থ্যসেবা একেবারেই নিশ্চিহ্ন। স্কুল বলতে আছে একটি এনজিওর টিনশেড প্রাথমিক বিদ্যালয়, তাতেও শিক্ষিকা মাত্র একজন। স্থানীয়দের কাছে অবাক হয়ে জানতে চাইলাম, বাকি পড়াশোনা তাহলে কী করে হয়? বছর দুয়েকের শিশু কোলে এক গৃহিণী জানালেন, হয় না। ‘প্রাথমিকের পাঠ চুকিয়ে কাজে লেগে যায় ছেলেরা। যদি কারো আরও পড়ার থাকে, তবে তাকে নৌকা করে কয়েক কিলো দূরে মহেশখালী বা কঙবাজারে যেতে হয়।’ টিকে থাকাই যেখানে যুদ্ধ, সেখানে শিক্ষার আবেদন বোধয় বিলাসিতাই। তবু জানতে চাইলাম, তাঁর কোলের সন্তানটির ভবিষ্যৎ কী। ভাঙা বাংলায় যা বললেন, তার সারমর্ম অনেকটা এই , পয়সা জমাচ্ছেন। ইচ্ছা আছে ওকে অনেকদূর পড়ানোর। ওর বুদ্ধি ভালো। দারিদ্র্যের সঙ্গে পাঞ্জা লড়া সোনাদিয়ার মানুষ আজও দিন বদলের স্বপ্ন দেখতে ভোলেনি।
‘বাড়ি তো নয়, পাখির বাসা, ভেন্না পাতার ছানি/একটু খানি বৃষ্টি হলেই গড়িয়ে পড়ে পানি’– আসমানী কবিতার বাড়িটির মতোই যেন সোনাদিয়ার একেকটি কুটির। বাঁশ–ছন–পলিথিন দিয়ে কোনোরকমে মাথা গোঁজার ঠাঁই করা এ জীর্ণ কুটিরগুলো সহজেই বলে দেয় সোনাদিয়ার করুণ উন্নয়ন–বৈষম্যের চিত্র। এখানে বেঁচে থাকার লড়াই চলছে প্রতিনিয়ত। সমুদ্রের সঙ্গে সমঝোতা করে টিকে আছে জনজীবন। রাষ্ট্র, সরকার, প্রশাসন – কিছুই তাদের কাজে লাগেনি।
সোনাদিয়ায় আমার থাকা হয়েছে দুদিন মোটে। ঘুরে ঘুরে দেখেছি, মৎসজীবিকা বা পশুপালন ব্যতীত অন্য কোনো স্থায়ী উপার্জন এখানকার মানুষদের নেই। তাতে লাভ খুব বেশি হয় না। বরং বছরের যে সময়টি বন্যা চলে, সেসময় অকর্মণ্য বসে কাটাতে হয় পেশাজীবীদের। বিদ্যুৎ পৌঁছায়নি, মোটামুটি সচ্ছলদের ঘরে আছে সৌরবিদ্যুত। বিচ্ছিন্ন এ সাগর তীরে সরকারি বরাদ্দের ছিটেফোঁটাও আসে না। আসে না বলেই, এতো বড়ো একটি দ্বীপে একমাত্র পাকা দালান, সরকারি আশ্রয়কেন্দ্রটিও বছর তিরিশ আগের, এখন একেবারে ভগ্নদশায়। বন্যার সময় সোনাদিয়ায় কাজ থাকে না, থাকে না ফসল। মৌলিক নাগরিক অধিকার তো দূরে থাক, বিগত জনপ্রতিনিধিরা এখানে সামান্য ত্রাণটুকু পর্যন্ত যথাযথ দেননি। ফলে সবরকমের সুযোগ–সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়ে আসছেন সোনাদিয়ার প্রায় চার হাজার মানুষ।
অথচ এ দ্বীপটিতে কাজ করার সুযোগ রয়েছে অনেক। বাংলাদেশের নতুন অর্থনৈতিক ও পর্যটন সম্ভাবনার কেন্দ্র হতে পারে সোনাদিয়া। বর্তমানে পরিবর্তিত রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এ দ্বীপ নিয়ে পুনর্বিবেচনার বা বিকল্প ব্যবহারের সুযোগ রয়েছে। একইসঙ্গে পৃষ্ঠপোষকতা ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন হলে মৎসসহ সামুদ্রিক সম্পদ আহরণের উল্লেখযোগ্য হাব হতে পারে সোনাদিয়া।
এত পরিবর্তনের যুগে দাঁড়িয়ে সোনাদিয়ার মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন না হওয়ার দায় অবশ্যই রাষ্ট্রযন্ত্রের রয়েছে। সেই দায় কাঁধে নিয়েই এই বিচ্ছিন্ন দ্বীপে অতিসত্ত্বর নাগরিক সুবিধাদি পৌঁছে দেয়ার কর্তব্য পালন করতে হবে সরকারকে। কেবল সোনাদিয়া নয়, বাংলাদেশের সকল ছিন্নমূল জনগোষ্ঠীরকে মূলধারায় যুক্ত করার সময় এসেছে। একটি অংশগ্রহণমূলক কল্যাণ রাষ্ট্র বিনির্মাণে এর কোনও বিকল্প নেই।