শিশু ধর্ষণের ঘটনা কমছে না। ধর্ষণ বিরোধী আইন কঠোর করা হলেও এখনো রোধ করা যাচ্ছে না এই হীনতম কর্মকাণ্ড। ধর্ষণের মতো বিকৃত সামাজিক ব্যাধির হাত থেকে রেহাই পাচ্ছে না কোমলমতি নিষ্পাপ শিশুরা। ঘরে-বাইরে কোথাও নিরাপদ নয় তাদের জীবন। স্কুলে, মাদ্রাসায়, খেলার মাঠে, ঘরের ছাদে কোনো স্থানেই এখন শিশুর নিরাপত্তা নেই। খোদ পরিবার, আত্মীয়-স্বজন, শিক্ষক-শিক্ষয়িত্রীদের কাছেও নিরাপদ থাকছে না শিশুরা। সভ্যতার বড়াই করা, সামাজিক-সাংস্কৃতিক মূল্যবোধের বক্তৃতা দেওয়া এবং ধর্মীয় বিশুদ্ধতার দাবিদার ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর কাছেও আজ বিপন্ন শিশুরা। শিশু ধর্ষণের দায়ে বিচারও হচ্ছে। তবু কেন এ ঘটনা কমছে না, তা বোধের মধ্যে আসছে না।
উল্লেখ্য, শিশু ধর্ষণের দায়ে কঙবাজারে এক যুবককে যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড ও এক লাখ টাকা অর্থদণ্ড প্রদান করেছেন কঙবাজারের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক (জেলা ও দায়রা জজ জজ) জেবুন্নেসা আয়শা। গত বৃহস্পতিবার সকালে এ রায় ঘোষণা করা হয়। এছাড়া অর্থদণ্ড অনাদায়ে আসামির আরো এক বছর কারাদণ্ডাদেশ দেয়া হয়। সাজাপ্রাপ্ত আসামি আনোয়ার হোসেন (২৩) রামুর রশিদনগর ইউনিয়নের থলিয়াঘোনা বড় গ্যারেজ এলাকার মনজুর আলমের ছেলে। দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি ২০১৭ সালের ১৯ অক্টোবর রামুর রশিদনগর ইউনিয়নের বড় গ্যারেজ এলাকার একটি কালভার্টে নিয়ে গিয়ে ১০ বছর বয়সী এক কন্যা শিশুকে ধর্ষণ করে। এ ঘটনায় ধর্ষিতার পিতা বাদি হয়ে রামু থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। পুলিশ ঘটনার তদন্ত করে অভিযুক্ত যুবকের বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশিট দেয়।
পরবর্তীতে মামলাটি বিচারের জন্য দীর্ঘ শুনানি শেষে বৃহস্পতিবার রায় প্রদান করা হয়। রায়ে অর্থদণ্ড আদায়ের জন্য সাজাপ্রাপ্ত আসামির স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি ক্রোক ও বাজেয়াপ্ত করতে জেলা কালেক্টর(ডিসি)কে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আসামির সম্পত্তি প্রকাশ্যে বিক্রি করে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-২’তে জমা দিতেও বলা হয়। এ টাকা ক্ষতিপূরণ বাবদ ধর্ষণের শিকার শিশুকে প্রদান করতেও রায়ে উল্লেখ করা হয়।
শিশুদের ওপর নির্যাতনের বিভিন্ন দিক নিয়ে দীর্ঘদিন গবেষণা করছেন এমন এক সমাজবিজ্ঞানী মনে করেন, মূলত দরিদ্র শ্রেণির শিশুরা ধর্ষণের ঝুঁকিতে থাকে। শ্রমজীবী বাবা-মায়েদের অনুপস্থিতিতে এসব শিশুর দেখার কেউ থাকে না। আরেকটি অংশ যারা নিজেরাই কর্মজীবী শিশু এবং গৃহকর্মী; তারাও ধর্ষণের ঝুঁকিতে রয়েছে। তিনি বলেন, অনেক শিশু বা অভিভাবক জানেন না কোথায় গিয়ে বিচার চাইতে হয়। আবার বিচার চাইলে বিচার পাওয়ার নিশ্চয়তাও নেই। বিচারহীনতার সংস্কৃতির কারণে অনেকেই আদালত বা পুলিশের দোরগোড়ায় যান না। অধিকাংশ নির্যাতনের ঘটনা বিচার না হয়ে মিটমাট হয়ে যায়। বিচারহীনতার সংস্কৃতিও শিশু ধর্ষণকে উৎসাহিত করছে বলে মনে করেন তিনি।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, আগের তুলনায় হিংসাত্মক ঘটনা বেশি হচ্ছে, যদিও আগের তুলনায় এখন ঘটনাগুলো বেশি জানা যাচ্ছে। এখন অনেক বাবা-মা পুলিশের কাছে যাচ্ছে। সামাজিক প্রতিরোধ হচ্ছে। এর ফলে নির্যাতক অনেক সময় নিজের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে শিশুটিকেই হত্যা করছে। মূলত শিশু নিরাপত্তার বিষয়টি নেই বললেই চলে। তাঁরা বলেন, শুধু যে মেয়ে শিশুরাই এমন নির্যাতন ও হত্যার শিকার হচ্ছে, তা নয়। আমাদের দেশে ছেলেরা এত নির্যাতিত হয় তা ভাবাই যায় না। ছেলেরা যে ছেলেদের দ্বারাই নির্যাতিত হয় তা নয়, নারীদের দ্বারাও সেটি হয়। কিন্তু স্কুল বা মাদ্রাসাগুলোতে বলা হচ্ছে না বলেই শিশুরা এ সম্পর্কে জানছে না যে- তাকে কী করতে হবে। বাবা-মা, আত্মীয়-স্বজনকে প্রশিক্ষণ দেওয়া দরকার। শিশুদের শেখাতে হবে- এ রকম ঘটনা ঘটলে কী করতে হয়, কোথায় যেতে হয়, কে আদর করলো, কে শরীর স্পর্শ করলো এবং এর কোনটা ভালো, কোনটা খারাপ।
পুলিশ বলছে, শিশুদের ওপর বল খাটানো বা প্রভাবিত করা, ভয় দেখানো সহজ। ফলে সেই সুযোগটি নিচ্ছে অপরাধীরা। শিশুরা এখন একশ্রেণির লোকের টার্গেটে পরিণত হয়েছে। তারা শিশুদের নিয়ে পর্নোগ্রাফি তৈরি করছে। একশ্রেণির মানুষ শিশুদের ভোগ্যপণ্য হিসেবে দেখছে। এতে অনেক ক্ষেত্রে পর্নোগ্রাফিরও প্রভাব রয়েছে। আইন বা ধর্ম কোনো কিছু দিয়েও থামানো যাচ্ছে না ভয়াবহ এ বিকৃত আচারকে। আত্মরক্ষার পথও শিখিয়ে দিতে হবে অভিভাবকদের।