বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে

| বৃহস্পতিবার , ২১ আগস্ট, ২০২৫ at ১০:৪৬ পূর্বাহ্ণ

সামপ্রতিক সময়ে পারিবারিক সহিংসতা বৃদ্ধি পেয়েছে। কোনো কোনো মানুষ তার পরিবারের সদস্যদের মতো অতি আপন মানুষের ঘাতক হয়ে উঠছে। উদ্বেগজনক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে এই সহিংসতা। কোথাও জেদের বশবর্তী হয়ে স্ত্রী নির্মমভাবে হত্যা করছেন স্বামীকে, স্বামী মেরে ফেলছেন স্ত্রীকে। আবার সবচেয়ে নিরাপদ যে মায়ের কোল, সেই মা হয়ে যাচ্ছেন সন্তানের হন্তারক; অন্যদিকে সন্তানকে খুন করে পালিয়ে বেড়ান বাবা। ক্ষোভ বা লোভের বশে মাবাবার রক্তে হাত রঞ্জিত করা সন্তানের সংখ্যা আরও বেশি। ভাই মেরে ফেলছে বোনকে, বোন ভাইকে।

গত ১৮ আগস্ট দৈনিক আজাদীতে প্রকাশিত হয়েছে ‘বাবাছেলেসহ তিনজনকে কুপিয়ে জখম, একই পরিবারের দুই নারী পুলিশ হেফাজতে’ শীর্ষক এক সংবাদ। এতে বলা হয়েছে, কর্ণফুলীর শিকলবাহায় তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে বাবাছেলেসহ তিনজনকে কুপিয়ে জখম করা হয়েছে। গত রোববার সকাল ১০টার দিকে শিকলবাহা ইউনিয়নের দইয়্যার ভাণ্ডার বাড়িতে এ ঘটনা ঘটে। আহতরা হলেনএকই এলাকার নুর মোহাম্মদ (৫৭) এবং তার দুই ছেলে আবদুল কাদের (৩৪) ও ফজল কাদের (৩২)। এর মধ্যে ফজল কাদের চট্টগ্রাম মেডিকেল হাসপাতালে আইসিইউতে এবং নুর মোহাম্মদ ও আবদুল কাদের সাধারণ কক্ষে চিকিৎসাধীন।

পুলিশ ও স্থানীয়রা জানান, দীর্ঘদিন ধরে দুই পরিবারে জমি সংক্রান্ত বিরোধে উত্তেজনা চলছিল। ঘটনার সময়ে বাড়ির পাশে একটি ডোবায় মাছ ধরার বড়শি নিয়ে নুর মোহাম্মদ ও প্রতিবেশী পুলিশ সদস্য নবীর ছেলে দিদারের মধ্যে কথাকাটাকাটি হয়। এ সময় দিদার, তার ভাতিজা ও ভাইয়েরা দেশীয় অস্ত্র নিয়ে হামলা চালান। এতে নুর মোহাম্মদ ও তার দুই ছেলে আহত হন। ঘটনাস্থল পরিদর্শন করা কর্ণফুলী থানার উপপরিদর্শক (এসআই) রেজাউল হক বলেন, ঘটনাস্থল থেকে কিছু দেশীয় অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে। জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পুলিশ সদস্য নবীর পরিবারের দুইজন নারীকে পুলিশ হেফাজতে আনা হয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পরিবার মানব সমাজের মৌল ভিত্তি। পরিবার নাগরিকের প্রথম সোপান, এখানে সহিংসতা বাড়া মানে জাতীয়ভাবে বিরূপ প্রভাব ফেলার মতো একটি বিষয়। পারিবারিক সহিংসতার ধরন পাল্টেছে এবং সহিংসতা বাড়ছে। উল্লেখ্য, দেশে সার্বিক অপরাধপ্রবণতার কোনো একক চিত্র পাওয়া যায় না। নেই কোনো সমন্বিত জরিপও। এর পরও সাম্প্রতিক বেশ কিছু ঘটনা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর তথ্য এবং বিভিন্ন সরকারিবেসরকারি সংস্থার প্রকাশিত তথ্যউপাত্তের ভিত্তিতে বিশেষজ্ঞরা বলেন, ‘পারিবারিক সহিংসতা বৃদ্ধির পেছনে পারিবারিক বন্ধন শিথিল হওয়া, প্রযুক্তির অপব্যবহার, ব্যক্তিগত স্বার্থ, সুস্থ বিনোদনের অভাব, অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা এবং সামাজিক অবক্ষয়ের প্রভাব কাজ করছে। পরিবারে শারীরিকমানসিক নির্যাতনের পাশাপাশি হত্যাকাণ্ডের মতো ঘটনা উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।’

বিশেষজ্ঞদের মতে, সমাজের শান্তিশৃঙ্খলা, স্থিতিশীলতা, অগ্রগতি ইত্যাদি পারিবারিক সুস্থতা ও দৃঢ়তার উপরই বহুলাংশে নির্ভরশীল। যদি পারিবারিক জীবন অসুস্থ ও নড়বড়ে হয়, তাতে ভাঙন ও বিপর্যয় দেখা দেয়, তাহলে সমাজ জীবনে নানা অশাস্তি ও উপদ্রব সৃষ্টি হতে বাধ্য। এ কারণে সমাজবিজ্ঞানীরা পারিবারিক জীবনের সুস্থতা ও সুষ্ঠুতার ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছেন সভ্যতার ঊষাকাল থেকেই। কিন্তু কাঙ্ক্ষিত এই সুস্থতা ও সুষ্ঠুতা আসবে কিভাবে? কেন অশান্তি বিরাজ করে পরিবারে? কেন এমন সহিংসতা হচ্ছে? এমন প্রশ্নে সমাজবিজ্ঞানী ও অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অনেক কারণেই পারিবারিক অশান্তি বৃদ্ধি পাচ্ছে। আর এ অশান্তি থেকেই যত বিপত্তি, যত প্রাণঘাত। অশান্তির নেপথ্যে স্বার্থের দ্বন্দ্ব, সম্পত্তির লোভ, বিয়েবহির্ভূত সম্পর্ক, সাংসারিক অনটন, পরস্পরের প্রতি অবিশ্বাস, অর্থনৈতিকসাংস্কৃতিক অস্থিরতা, বহিরাগত রাষ্ট্রের সংস্কৃতির আগ্রাসন, ভোগবিলাসিতার আকাঙ্‌ক্ষা, প্রযুক্তির অপব্যবহার ও মাদকাসক্তি ছাড়াও সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয়কে দায়ী করছেন তাঁরা। তাঁদের মতে, শুধু আইন থাকলেই হবে না; সে আইন বাস্তবায়ন জরুরি। দেশে দীর্ঘ দিন ধরে বিচারহীনতার যে সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে, সেটি থেকে দ্রুত বেরিয়ে আসতে হবে। নতুবা অপরাধ না কমে আরো বাড়বে বৈকি। গবেষকরা বলছেন, পারিবারিক সহিংসতার পেছনে ব্যক্তি পর্যায়ে অস্থিরতা অনুঘটক হিসেবে কাজ করছে। সামাজিক, রাষ্ট্রীয়, ধর্মীয় যেসব মূল্যবোধ রয়েছে, সেগুলো মেনে চললে ব্যক্তি কিংবা পরিবারএই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে সহায়ক হবে। অপরাধ বেড়ে যাওয়া, মূল্যবোধের অবক্ষয়এসবের জন্য বেশি দায়ী ঐতিহ্যগত শিষ্টাচারগুলোকে অবজ্ঞা করা। মোটকথা, পারিবারিক সহিংসতা নিয়ন্ত্রণে দরকার সুস্থ পারিবারিক, সাংস্কৃতিক, সামাজিক মেলবন্ধন।

পূর্ববর্তী নিবন্ধ৭৮৬
পরবর্তী নিবন্ধএই দিনে