ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক শরীফ ওসমান হাদিকে হত্যার প্রতিবাদে গতকালও পুরো চট্টগ্রাম বিক্ষোভ মিছিল–সড়ক অবরোধে উত্তাল ছিল। গত বৃহস্পতিবার রাতে হাদির মৃত্যুর খবরে চট্টগ্রামের রাজপথে নেমে পড়েন বিক্ষুদ্ধ ছাত্র–জনতা। সেই ক্ষোভের নগরী গতকাল শুক্রবার জুমার নামাজের পর আরও উত্তাল হয়ে উঠে।
জুমার নামাজের পর জুলাই বিপ্লবের বিভিন্ন সংগঠনের উদ্যোগে বিশেষ করে ‘জুলাই ঐক্য–চট্টগ্রাম, এনসিপি, বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন, ইসলামী ছাত্র শিবির, জামায়াতে ইসলামী, হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশসহ বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে শরীফ ওসমান হাদির হত্যাকারীদের দ্রুত গ্রেপ্তারের দাবিতে বিক্ষোভ সমাবেশ, মিছিল ও সড়ক অবরোধ করা হয়।
এদিকে দিনভর থমথমে নগরীর প্রতিটি মোড়ে মোড়ে সকাল থেকে পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা সতর্ক অবস্থানে ছিলেন। ভারতীয় সহকারী হাইকমিশন অফিসসহ গুরুত্বপূর্ণ মোড় গুলোতে সেনা বাহিনীর সদস্যরা অবস্থান নেন। শুক্রবার বাদ জুমা শহীদ ওসমান হাদির রূহের মাগফিরাত কামনায় চট্টগ্রামে মসজিদে মসজিদে বিশেষ দোয়া ও মোনাজাত অনুষ্ঠিত হয়। এছাড়াও অন্যান্য ধর্মের উপাসনালয়গুলোতেও বিশেষ প্রার্থনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। বাদে জুমা আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদ থেকে কফিন মিছিল বের করে জুলাই ঐক্য। একই সময়ে জমিয়তুল ফালাহ জামে মসজিদ থেকে মিছিল বের করে ইসলামী ছাত্রশিবির। পরে মিছিলোত্তর সমাবেশ থেকে ওসমান হাদির খুনিকে দ্রুত গ্রেপ্তারের দাবি জানানো হয়। এছাড়া জুলাই ঐক্য স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলমের পদত্যাগ দাবি করেছে।
ইসলামী ছাত্রশিবির : ছাত্রশিবির চট্টগ্রাম মহানগর শাখার উদ্যোগে আধিপত্যবাদবিরোধী শহীদ জুলাই যোদ্ধা শরীফ ওসমান হাদিকে হত্যার প্রতিবাদে বিক্ষোভ মিছিলটি শুরু হয় জমিয়তুল ফালাহ জামে মসজিদ থেকে। দেওয়ানহাট অভিমুখে মিছিলটি যাত্রা শুরু করে এবং দেওয়ানহাট মোড়ে সমাবেশের মাধ্যমে শেষ হয়।
নগর উত্তর সেক্রেটারি মুমিনুল হকের সঞ্চালনায় বিক্ষোভ মিছিল সমাবেশে বক্তব্য রাখেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় সভাপতি মুহাম্মদ আলী ও নগর দক্ষিণ ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মাইমুনুল ইসলাম মামুন। এসময় নেতৃবৃন্দ শহীদ শরীফ ওসমান হাদির হত্যাকারীদের অনতিবিলম্বে গ্রেপ্তার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানান।
মুহাম্মদ আলী বলেন, ওসমান হাদি যেভাবে জুলুম ও স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে ময়দানে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন, একইভাবে কালচারাল ফ্যাসিজমের বিরুদ্ধেও সোচ্চার ভূমিকা পালন করেছেন। এদেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে ভারত যে আধিপত্য চালিয়েছে বীর মুজাহিদ ওসমান হাদির অন্যতম সংগ্রাম ছিল এই সাংস্কৃতিক আধিপত্যের বিরুদ্ধে। একজন হাদিকে শহীদ করে এদেশে ভারতীয় আধিপত্যের নীলনকশা বাস্তবায়ন করা যাবে না।
মাইমুনুল ইসলাম মামুন বলেন, ফ্যাসিস্ট সরকার বিদায় নিলেও তার আধিপত্য এখনো বহাল রয়েছে। ওসমান হাদির শাহাদাতই এর প্রমাণ। তিনি বলেন, গুলি করে কেবল ওসমান হাদিকে নয়, যেন জুলাইকেই হত্যা করা হয়েছে। আপাতদৃষ্টিতে ওসমান হাদির হত্যাকারী দুজন মনে হলেও বিশাল একটি মহলের সূক্ষ্ম পরিকল্পনায় এ হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে। অনতিবিলম্ব তাদের গ্রেপ্তার করে শাস্তির আওতায় আনতে হবে। ওসমান হাদিকে ইমাম সম্বোধন করে তিনি বলেন, জুলাইয়ের অসংখ্য নেতার নৈতিক পদস্খলন ঘটলেও হাদি ছিলেন নীতির উপর অটল ও অবিচল। হাদি যে প্রেরণার মিনার তৈরি করেছেন, শ্রম দিয়ে, রক্ত দিয়ে সে মিনারকে উচ্চকিত রাখার ঘোষণা দেন তিনি।
জুলাই ঐক্য : আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদ থেকে বের হওয়া জুলাই ঐক্যের ব্যানারে কফিন মিছিলটি জামালখান মোড়ে গিয়ে সমাবেশের মধ্য দিয়ে শেষ হয়। মিছিলে অংশগ্রহণকারীরা কফিনের আদলে তৈরি প্রতীকী বাংলাদেশের লাল সবুজ পতাকা জড়িয়ে বহন করে।
সমাবেশে জুলাই ঐক্যের সংগঠক আবরার হাসান রিয়াদের সঞ্চালনায় বিভিন্ন সংগঠনের নেতারা বক্তব্য দেন। বক্তারা স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলমের পদত্যাগ, ওসমান হাদির খুনিকে দ্রুত গ্রেপ্তার দাবি এবং ভারতীয় আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম অব্যাহত রাখার আহ্বান জানান।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা ইবনে হাসান জিয়াদ বলেন, ওসমান হাদি হত্যার দায় স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম, আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল এড়াতে পারে না। হত্যাকারীদের জীবিত বা মৃত দেশে ফিরিয়ে আনতে হবে।
আরেক নেতা তৌসিফ ইমরোজ বলেন, জনতার স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনকে মব ট্যাগ দিয়ে যারা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের আশ্রয়–প্রশ্রয় দিচ্ছে তাদের বিচার করতে হবে।
গণঅধিকার পরিষদ নেতা জসীম উদ্দিন বলেন, অতীতের যেকোনো সরকারের চেয়ে সবচেয়ে বেশি জনসমর্থন নিয়ে ইন্টেরিম সরকার গঠিত হয়েছিল। কিন্তু বর্তমান সময়ে তারাই সবচেয়ে ব্যর্থ সরকার।
অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য দেন যুবশক্তির নেতা টিপু সুলতান, জুলাই আন্দোলনে নিহত মাহবুবুর রহমানের ভাই মঞ্জুর আলমসহ বিভিন্ন সংগঠনের নেতারা।
এদিকে হাদিকে হত্যার প্রতিবাদে গতকাল বিকেলে নগরীর বড়পোল এলাকায় সড়ক অবরোধ করেন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) নেতা–কর্মীরা। এনসিপির কেন্দ্রীয় যুগ্ম সদস্যসচিব সাগুফতা বুশরার নেতৃত্বে তাঁরা সড়ক অবরোধ করেন। এতে বড়পোল থেকে বন্দরমুখী পোর্ট কানেক্টিং সড়ক ও আগ্রাবাদ এলাকায় যানজট সৃষ্টি হয়। কর্মসূচিতে বক্তারা বলেন, ওসমান হাদিকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে। জাতীয় ছাত্রশক্তির চট্টগ্রাম নগরের সংগঠক ফজলে রাব্বি চৌধুরী বলেন, আমাদের দাবি স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার পদত্যাগ, ওসমান হাদির হত্যাকারীদের শাস্তি এবং ভারত থেকে শেখ হাসিনাকে দেশে এনে বিচার করতে হবে।
অপরদিকে আমাদের চন্দনাইশ প্রতিনিধি জানিয়েছেন, ওসমান হাদি হত্যার বিচার দাবিতে চট্টগ্রাম–কক্সবাজার মহাসড়কের দোহাজারীতে বিক্ষোভ ও সড়ক অবরোধ করেছে ছাত্র–জনতা। গতকাল জুমার নামাজের পর ছাত্র–জনতা মহাসড়কে নেমে বিক্ষোভ করে এবং আধা ঘণ্টার মতো সড়ক অবরোধ করে। এ সময় চট্টগ্রাম–কক্সবাজার মহাসড়কে যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। বিক্ষোভ সমাবেশে এসময় বক্তব্য রাখেন চন্দনাইশ এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক আনাস মুহাম্মদ, সাইদুল ইসলাম তৌহিদ, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সদস্য শাহাদাত হোসেন সুমন, জেলা যুগ্ম আহ্বায়ক রাসিমুল্লাহ মারুফ, শিক্ষার্থী, আকিব, জিকু, ইমরান, জোবায়ের, ওবাইদুল হাসান ইমন প্রমুখ।
উল্লেখ্য, গত ১২ ডিসেম্বর রাজধানীর বিজয়নগর এলাকায় চলন্ত মোটরসাইকেল থেকে মাথায় গুলি করা হয় শরীফ ওসমান হাদিকে। গুরুতর আহত অবস্থায় তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে অস্ত্রোপচারের পর ঢাকার এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরে উন্নত চিকিৎসার জন্য এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে তাকে সিঙ্গাপুরে নেওয়া হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় গত বৃহস্পতিবার রাতে তিনি মারা যান। হাদির মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়ার পর চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্নস্থানে বিক্ষোভ শুরু করেন তার সহযোদ্ধারা। চট্টগ্রামে ভারতীয় সহকারী হাইকমিশনের সামনে বিক্ষোভ করেন তারা। এ সময় ভারতীয় সহকারী হাইকমিশনারের বাসভবনে ইট–পাটকেল নিক্ষেপ করা হয়। পুলিশ ফাঁকা গুলি ও টিয়ার সেল নিক্ষেপ করে তাদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়। এ ছাড়া বিক্ষোভকারীরা সাবেক শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলের বাসভবনে অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুর করে।












