অন্তর্বর্তী সরকারের ‘নিরপেক্ষতা’ নিয়ে প্রশ্ন তোলা বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলামের ‘নিরপেক্ষ’ সরকারের দাবি আরেকটা এক এগারো সরকার গঠনের ইঙ্গিত বহন করে বলে মন্তব্য করেছেন তথ্য ও সমপ্রচার উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম। গতকাল বৃহস্পতিবার বিকালে সামাজিক যোগাযোগ্য মাধ্যম ফেইসবুকে পোস্টে এমন মন্তব্য করেন আওয়ামী লীগ সরকার পতন আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের এ সমন্বয়ক, যিনি অন্তর্বর্তী সরকারে উপদেষ্টার দায়িত্বে রয়েছেন। মির্জা ফখরুলের বক্তব্যের কয়েক ঘণ্টা পর এর প্রতিক্রিয়ায় ফেইসবুকে নাহিদ লেখেন, ছাত্ররাই এই সরকারের এবং বিদ্যমান বাস্তবতার একমাত্র ফ্যাক্টর যেটা ১/১১ এর সরকার থেকে বর্তমান সরকারকে সম্পূর্ণভাবে আলাদা করে। বিএনপি কয়েকদিন আগে মাইনাস টু এর আলোচনা করলেও এখন ক্ষমতায় যাওয়ার পথ সুগম করার জন্য নিরপেক্ষ সরকারের নামে আরেকটি ১/১১ সরকারের প্রস্তাবনা করছে। এ ধরনের পরিকল্পনা ‘গণতন্ত্র ও জাতীয় স্বার্থের’ বিরুদ্ধে যাবে এবং ছাত্র–জনতা কোনোভাবেই তা মেনে নেবে না বলে তুলে ধরে তিনি বলেন, এবং আমি মনে করি এটা বিএনপির বিরুদ্ধেও ষড়যন্ত্র। এ সরকারের সুবিধা ‘নানান পক্ষ ভোগ’ করছে মন্তব্য করে তিনি লেখেন, সরকার গঠনের দুদিন আগে ৬ অগাস্ট নিয়োগ হওয়া অ্যাটর্নি জেনারেল ও পুলিশের আগের আইজি ’মূলত বিএনপির লোক’। বৃহস্পতিবার জাতীয় প্রেস ক্লাবে এক অনুষ্ঠানে অন্তর্বর্তী সরকারের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন মির্জা ফখরুল। আগের দিন বুধবার বিবিসি বাংলাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে মির্জা ফখরুল বলেন, সরকার নিরপেক্ষ থাকতে না পারলে নিরপেক্ষ সরকারের প্রয়োজন হবে। খবর বিডিনিউজের।
এ কথার জের টেনে বৃহস্পতিবারের অনুষ্ঠানে বিএনপি মহাসচিব বলেন, আমি এ কথা গতকালও বলেছি, আমাকে একজন সাংবাদিক ভাই এ নিয়ে প্রশ্ন করেছেন। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যদি নিরপেক্ষ না থাকে তাহলে একটা নিরপেক্ষ সরকার দরকার হবে নির্বাচনের সময়ে। তিনি বলেন, আমি কথাটা বলছি যে, এর কারণ আছে। কারণ হচ্ছে, আমরা দেখছি যে, বেশ কিছু বিষয়ে অন্তবর্তীকালীন সরকার নিরপেক্ষতা পালন করতে পারছেন না।
এমন বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় উপদেষ্টা নাহিদ লেখেন, ১/১১ এর বন্দোবস্ত থেকেই আওয়ামী ফ্যাসিজমের উত্থান ঘটেছিল। বিএনপি মহাসচিবের বক্তব্যে সামনে আরেকটা ১/১১ সরকার, সংসদীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা ও নতজানু পররাষ্ট্রনীতির ধারাবাহিকতা এবং গুম–খুন ও জুলাই হত্যাকাণ্ডের বিচার না হওয়ার আলামত রয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্বের চার মাস সময় থেকে নির্বাচনের দাবিতে সোচ্চার হয়েছে বিএনপি। বিভিন্ন আলোচনা সভা, সমাবেশে তারা জোরালোভাবে দ্রুত নির্বাচন দেওয়ার দাবি জানিয়ে আসছে।
২০২৪ সালের ৫ অগাস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দেশের হাল ধরা অন্তর্বর্তী সরকার প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে নির্বাচন করার পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে। এ নিয়ে বিএনপি নেতাদের বক্তব্যের মধ্যেই মির্জা ফখরুল অন্তর্বর্তী সরকার নিয়ে কথা বললেন। বিএনপি মহাসচিবের এমন বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় সমন্বয়ক থেকে সরকারে উপদেষ্টার দায়িত্ব নেওয়া নাহিদ তার ফেইসবুক পোস্টে ছাত্র–জনতার তুমুল আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পরপরই সরকার গঠনের প্রেক্ষাপটও তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ছাত্র এবং অভ্যুত্থানের নেতৃত্বকে দূরে রাখার পরিকল্পনা শুরু হয়েছে ৫ অগাস্ট থেকেই। ৫ অগাস্ট ছাত্র–জনতা যখন রাজপথে লড়াই করছে, পুলিশের গুলি অব্যাহত তখন অনেক জাতীয় নেতা নতুন সরকার করার পরিকল্পনায় ব্যস্ত ছিলেন–অভিযোগ নাহিদের।
আমাদের আপোষকামী অনেক জাতীয় নেতৃবৃন্দ ক্যান্টনমেন্টে জনগণ কে বাদ দিয়ে নতুন সরকার করার পরিকল্পনায় ব্যস্ত ছিলেন (অনেকে ছাত্রদের কথাও বলেছেন সেখানে)। আমরা ৩ই অগাস্ট থেকে বলে আসছি আমরা কোনো প্রকারের সেনা শাসন বা জরুরি অবস্থা মেনে নিবো না। আমাদেরকে বারবার ক্যান্টেন্টমেন্টে যেতে বলা হলেও আমরা যেতে অস্বীকার করি। শেষ পর্যন্ত বঙ্গভবনে আলোচনা ও বার্গেনিং এর মাধ্যমে ড. ইউনূসকে প্রধান করে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের সিদ্ধান্ত হয়। তিনি বলেন, ছাত্ররা ফ্যাসিবাদবিরোধী রাজনৈতিক দল ও নাগরিক সমাজের সমন্বয়ে একটা জাতীয় সরকার চেয়েছিলেন। সেটা হলে ছাত্রদের হয়তো সরকারে আসার প্রয়োজন হতো না। জাতীয় সরকার অনেকদিন স্থায়ী হবে এই বিবেচনায় বিএনপি জাতীয় সরকারে রাজী হয় নাই। কিন্তু অভ্যুত্থানের পরেই দেশে জাতীয় সরকারের প্রয়োজনীয়তা সবচেয়ে বেশি ছিল। অথচ বিএনপি জাতীয় সরকারের কথা বলতেছে সামনের নির্বাচনের পরে। বর্তমান সরকার জাতীয় সরকার না হলেও এতে আন্দোলনের সব পক্ষের অংশীদারত্ব রয়েছে, বলেছেন নাহিদ ইসলাম। বলেন, সব পক্ষই নানান সুবিধা ভোগ করছে।
সরকার গঠনের আগেই ৬ অগাস্ট অ্যাটর্নি জেনারেল এবং পুলিশের আগের আইজির নিয়োগ হয়েছিল যারা মূলত বিএনপির লোক। এ রকমভাবে সরকারের উপর থেকে নিচ পর্যন্ত নানান স্তরে বিএনপিপন্থি লোকজন রয়েছে। নির্বাচনের নিরপেক্ষতার কথা বললে এই বাস্তবতায়ও মাথায় রাখতে হবে।
নাহিদ ইসলাম বলেন, ছাত্রদের কোনো দলীয় দাবি না হলেও রাষ্ট্রপতির পরিবর্তন, সংস্কার, নতুন সংবিধান, জুলাই ঘোষণা সব ইস্যুতেই বিএনপি বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। দেশের স্থিতিশীলতা, বৃহত্তর স্বার্থ এবং জাতীয় ঐক্য ধরে রাখার জন্য ছাত্ররা বারবার তাদের অবস্থান থেকে সরে এসেছে। কিন্তু এর মানে এই না যে গণতন্ত্রবিরোধী ও অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা বিরোধী কোনো পরিকল্পনা হলে সেখানে আমরা বিন্দু পরিমান ছাড় দিবো।
আওয়ামী লীগের বিষয়ে ভারতের প্রধান দলগুলোর মধ্যে ঐক্য হয়েছে। এত হত্যা ও অপরাধের পরেও আওয়ামীলীগের বিষয়ে বাংলাদেশে কোনো ঐক্য গঠন করতে না পারায় আক্ষেপ জানিয়ে নাহিদ ইসলাম বলেন, হায় এই ‘জাতীয় ঐক্য’ লইয়া আমরা কি রাষ্ট্র বানাবো! তার অভিযোগ, এ দেশের বড় বড় লোকেরা অল্পমূল্যে বিক্রি হওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকে। বাংলাদেশকে দুর্বল করা সহজ কারণ বাংলাদেশকে সহজেই বিভাজিত করা যায়। আমি মনে করিনা সমগ্র বিএনপি এই অবস্থান গ্রহণ করে। বরং বিএনপির কর্মী সমর্থকদের বড় অংশই অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষার বাস্তবায়ন চায়। বিএনপির দেশপ্রেমিক ও ত্যাগী নেতৃত্বকে আহবান করব, ছাত্র জনতার অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে না গিয়ে ছাত্র–জনতার সাথে বৃহত্তর ঐক্য ও সংহতির পথ বেছে নিন।