বাংলাদেশে বায়ুদূষণের মাত্রা ক্রমশ বেড়েই চলেছে। অতি সম্প্রতি প্রকাশিত ‘বায়ুদূষণমুক্ত করার প্রচেষ্টা: দক্ষিণ এশিয়ার বায়ুদূষণ ও জনস্বাস্থ্য’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়, ঢাকায় বায়ুদূষণের উৎস প্রায় ৪ শতাংশ প্রাকৃতিক ও ৬ শতাংশ অভ্যন্তরীণ। প্রায় ২৮ শতাংশ দূষণের উৎস সীমান্তের ওপার থেকে আসা দূষিত বায়ু। দেশের অন্য বিভাগ ও জেলা থেকে আসা দূষিত বায়ুও রাজধানীর বাতাসকে দূষিত করছে। ঢাকার বায়ুদূষণের ক্ষেত্রে অন্য বিভাগ ও জেলার দূষিত বায়ুর ভূমিকা ৬০ শতাংশের কিছু বেশি। ঢাকা, চট্টগ্রাম ও খুলনার বায়ুদূষণে ৩০ শতাংশ ভূমিকা রাখে সীমান্তের ওপার থেকে আসা দূষিত বায়ু। আবার বাংলাদেশ থেকেও দূষিত বায়ু ভারতে যায়।
এর আগে এই সংস্থার ‘ব্রিদিং হেভি: বায়ুদূষণের নতুন তথ্য-প্রমাণ এবং স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব’ প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, দেশের বায়ুদূষণপ্রবণ এলাকায় বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে। একই সঙ্গে যেসব এলাকায় বায়ুদূষণ বেশি, সেখানের মানুষ বেশি মাত্রায় বিষণ্নতায় ভুগছে। ২০১৯ সালে দেশে বায়ুদূষণে সর্বোচ্চ ৮৮ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়। দূষণপ্রবণ এলাকাগুলোর প্রায় ১৪ শতাংশ বাসিন্দা বিষণ্নতায় ভুগছে। দেশে বায়ুদূষণে শীর্ষে রয়েছে ঢাকা বিভাগ। এরপরই অবস্থান বরিশাল বিভাগের। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) নির্ধারিত মাত্রা থেকে ১ শতাংশ দূষণ বাড়লে বিষণ্নতায় ভোগা মানুষের সংখ্যা ২০ গুণ বেড়ে যায়।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, বায়ুদূষণের প্রধান কারণ হচ্ছে যানবাহনের কালো ধোঁয়া। শব্দদূষণ, বায়ুদূষণ, আলোদূষণ-এসব ঘটে পরিবহণ খাত থেকে। লক্কড়-ঝক্কড় গাড়ির কারণে পরিবেশ বেশি মাত্রায় দূষিত হয়। যানবাহনের পাশাপাশি ইটভাটা, বস্তির আবর্জনা, কাঠ-কয়লা ও কেরোসিন দিয়ে রান্নার ধোঁয়া, রাজধানীর বাইরে থেকে আসা হাজার হাজার ট্রাক ও দূরপাল্লার যানবাহনের ধুলা ও ধোঁয়া এবং রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি ও নির্মাণ কাজের ধুলা-এসব কারণেও রাজধানীর বায়ু দূষিত হয়ে থাকে।
গাড়িতে উন্নত জ্বালানির ব্যবহার, নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ, উন্নত ইঞ্জিন ব্যবহার-এসব বিষয়ে লক্ষ্য রাখলে যানবাহন থেকে দূষণের মাত্রা অনেক কম হবে। তাঁরা বলেন, পরিকল্পনার অভাবে বাংলাদেশে বায়ু দূষণের মাত্রা নিয়ন্ত্রণের বাইরে। সমন্বিত উদ্যোগ থাকলে বায়ুদূষণ সহনীয় মাত্রায় আনা সম্ভব। বাতাসে ক্ষতিকর বস্তুকণা থাকবে, তবে তা সহনীয় মাত্রায় রাখার চেষ্টা নিতে হবে। নগরের আশপাশে গড়ে ওঠা অবৈধ ইটভাটা বন্ধ করতে হবে। সেই সঙ্গে পরিবেশবান্ধব ইটভাটা নির্মাণে জোর দিতে হবে। অবকাঠামোগত উন্নয়নের জন্য কাজ চালিয়ে যেতে হবে। কিন্তু অপরিকল্পিতভাবে খুঁড়াখুঁড়ি বন্ধ করতে হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক ও বায়ুর মানবিষয়ক গবেষক আবদুস সালামের একটা বক্তব্য প্রকাশিত হয়েছে পত্রিকান্তরে। সেখানে তিনি বলেন, বিশ্বের যে অঞ্চলগুলোতে সবচেয়ে বেশি দূষিত বায়ু সৃষ্টি হয়, তার মধ্যে ইন্দো-গাঙ্গেয় অঞ্চলের দেশগুলো রয়েছে। এ অঞ্চলে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বেশি। দ্রুত অবকাঠামো নির্মাণ ও নগরায়ণের কারণেও ধুলা বাড়ছে। এ ছাড়া এ অঞ্চলের গ্রামীণ জনগোষ্ঠী এখন অনেক বেশি জীবাশ্ম জ্বালানি দিয়ে রান্না করে ও শীতকালে উষ্ণতা নেয়।
জীবনধারণের জন্য জ্বালানির প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করা যায় না। কিন্তু আমাদের নজর রাখতে হবে, কতটা কম দূষণ করে এই জ্বালানি পাওয়া যায়। দূষণের কারণে অনেক উন্নত দেশ কয়লাভিত্তিক জ্বালানি বন্ধ করে দিয়েছে এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারের ওপর জোর দিয়েছে। কিন্তু আমাদের কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ওপরই জোর দেওয়া হচ্ছে; যদিও নবায়নযোগ্য জ্বালানিও কিছু কিছু ব্যবহার করা হচ্ছে।
এই বায়ু দূষণ আমাদের জীবনে এমন ক্ষতিকর প্রভাব ফেলছে, যা থেকে পরিত্রাণ জরুরি। যদি দ্রুত সঠিকভাবে পরিকল্পনা করা না যায় তাহলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম একটি অসুস্থ প্রজন্ম হিসেবে বেড়ে উঠবে। বিশেষজ্ঞদের আশংকা- এই কাজে সফল না হলে ২০৫০ সালে গোটা বিশ্বে বায়ুদূষণের ফলে প্রায় ৬০ লক্ষেরও বেশি মানুষের অকালমৃত্যু ঘটবে। শুধু এশিয়ায় প্রায় ৪০ লক্ষ মানুষের মৃত্যু ঘটতে পারে। বায়ুদূষণ যতই বাড়বে ততই আমাদের পক্ষে বিশুদ্ধ বাতাসে নিশ্বাস নেওয়া অসম্ভব হয়ে পড়বে। বায়ুদূষণ ভবিষ্যৎ মৃত্যুর সবচেয়ে বড় কারণ হিসেবে দাঁড়াবে। মানুষই বায়ুদূষণের জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী। তাই মানুষকেই এগিয়ে আসতে হবে বায়ুদূষণ কমিয়ে আগামী দিনের মানুষের জন্য পৃথিবীকে বাসযোগ্য করে যাওয়া। তাই বায়ুদূষণ রোধ করতে চাই সমন্বিত পরিকল্পনা।