করোনা মহামারির মধ্যেও আন্তর্জাতিক বাজারে বাড়ছে জ্বালানির দাম। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মাসের ব্যবধানে জ্বালানি তেলের দাম প্রতি ব্যারেলে বেড়েছে প্রায় ৪ ডলারের মতো। অন্যদিকে এলএনজির দাম বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ। মাসের ব্যবধানে এলপিজির দাম বেড়েছে প্রতি টনে ৩০-৫০ মার্কিন ডলার। এতে করে জ্বালানি তেল ও এলএনজি ভর্তুকি দিয়ে বাজারে সরবরাহ করতে হচ্ছে সরকারকে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ব্যক্তি খাতে আমদানিকৃত এলপিজির দামের প্রভাব আগামী এক মাসের মধ্যে পড়বে।
জানা যায়, দেশের চাহিদার সব জ্বালানিই সরবরাহ করে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন (বিপিসি)। এজন্য প্রায় ৬০ লক্ষ মেট্রিক টন জ্বালানি আমদানি করতে হয়। এর মধ্যে ক্রুড অয়েল আমদানি করতে হয় প্রায় ১৪ লক্ষ মেট্রিক টন। আন্তর্জাতিক বাজারে ক্রুড অয়েলের দাম বাড়লে বেড়ে যায় ডিজেলসহ অন্যান্য জ্বালানির দামও। তবে আন্তর্জাতিক বাজারের তথ্য অনুযায়ী, প্রতি ব্যারেল মারবার ক্রুড ও এরাবিয়ান লাইট ক্রুড ৭৪ ডলারের উপরে। বিপিসির উপ-মহাব্যবস্থাপক (বাণিজ্য ও অপারেশন) মোহাম্মদ জাহিদ হোসেন বলেন, কয়েক দিন আগেও ক্রুড অয়েলের দাম ব্যারেলপ্রতি ৭০ ডলারের নিচে ছিল। বিপিসির অর্থ বিভাগের এক কর্মকর্তা বলেন, জ্বালানি তেলের দাম ৭০ ডলারের উপরে গেলেই বিপিসিকে লোকসান গুনতে হবে। সরকার যদি জ্বালানির দাম না বাড়ায় তাহলে ভর্তুকি দিয়েই বাজারে জ্বালানি সরবরাহ করতে হবে।
এদিকে দেশে প্রাকৃতিক গ্যাসের সরবরাহ কমে যাওয়ার কারণে ২০১৮ সাল থেকে এলএনজি আমদানি করছে সরকার। দেশে গ্যাসের সংকট কাটাতে এলএনজি আমদানি ও সারা দেশে সরবরাহের জন্য ৫ হাজার ৬১০ কোটি টাকা ব্যয়ে গ্যাস ট্রান্সমিশন কোম্পানি লিমিটেডের (জিটিসিএল) মাধ্যমে চারটি মেগা পাইপলাইন নির্মাণ করে পেট্রোবাংলা। পাশাপাশি আমদানিকৃত এলএনজি সরবরাহের জন্য সরকারি চুক্তির মাধ্যমে মহেশখালীতে দুটি এফএসআরইউ (ফ্লোটিং স্টোরেজ অ্যান্ড রিগ্যাসিফিকেশন ইউনিট), অর্থাৎ এলএনজি মজুত ও পুনরায় গ্যাসে রূপান্তর করার ভাসমান টার্মিনাল নির্মাণ করে এক্সিলারেট এনার্জি ও সামিট এলএনজি টার্মিনাল কোম্পানি (প্রা.) লিমিটেড। টার্মিনাল দুটি থেকে দৈনিক এক হাজার মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস নির্মিত সঞ্চালন পাইপলাইনের মাধ্যমে সারা দেশে সরবরাহের কথা রয়েছে। চলতি সপ্তাহে ৯০১ মিলিয়ন ঘনফুট এলএনজি সরবরাহ দিচ্ছে রূপান্তরিত প্রাকৃতিক গ্যাস কোম্পানি লিমিটেড (আরপিজিসিএল)। চট্টগ্রামে চাহিদার পুরোটাই এলএনজি দিয়ে মেটানো হচ্ছে। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, গত সপ্তাহে ৩০০-৩২০ মিলিয়ন ঘনফুট এলএনজি সরবরাহ পেয়েছে কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড (কেজিডিসিএল)।
জানা যায়, মহামারিতে বিশ্ববাজারে আকস্মিকভাবে এলএনজির দাম বাড়তে শুরু করে। মাত্র দুই মাসের ব্যবধানে প্রায় দ্বিগুণ দামে এলএনজি আমদানি করতে হচ্ছে সরকারি প্রতিষ্ঠান পেট্রোবাংলাকে। ২৫ জুন অর্থমন্ত্রীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ভার্চ্যুয়াল সভায় প্রায় দ্বিগুণ দামে এলএনজি কেনার প্রস্তাব অনুমোদন দিয়েছে সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি। বৈঠক শেষে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব শামসুল আরেফিন জানান, যুক্তরাষ্ট্রের এক্সিলারেট এনার্জির কাছ থেকে ৪৪৮ কোটি ১৬ লাখ ৮২ হাজার ৪ টাকায় ৩৩ লাখ ৬০ হাজার এমএমবিটিইউ এলএনজি আমদানির প্রস্তাব অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এবারের চালানের ইউনিট মূল্য ১৩ দশমিক ৪২ ডলার। তথ্য অনুযায়ী, গত এপ্রিলে সুইজারল্যান্ডের এওটি ট্রেডিংয়ের কাছ থেকে একই পরিমাণ এলএনজি কিনতে খরচ হয়েছিল ২৪৩ কোটি ৩০ লাখ ৩২ হাজার ৩৫৮ টাকা। এতে দুই মাসের ব্যবধানে আন্তর্জাতিক বাজারে এলএনজির দাম বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণের কাছাকাছি।
আরপিজিসিএলের উপ-মহাব্যবস্থাপক (এলএনজি) প্রকৌশলী কেএম জহিরুল ইসলাম আজাদীকে বলেন, এলএনজির দাম হঠাৎ করে বেড়েছে। জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে গেলে গ্যাসের চাহিদা বেড়ে যায়। যে কারণে এলএনজির দামও বাড়ে। তবে প্রাইসিংয়ের (মূল্য) বিষয়টি মন্ত্রণালয় থেকে নির্ধারিত হয়। এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করা যাবে না।
জ্বালানির দাম বৃদ্ধির বিষয়ে জ্বালানি ও খনিজ বিভাগের সিনিয়র সচিব আনিসুর রহমান বলেন, এবারের চালানে আমদানিকৃত এলএনজির দাম এ যাবতকালের সর্বোচ্চ হবে। তাছাড়া বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দামও সর্বোচ্চ পর্যায়ে উঠেছে। অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম ব্যারেলপ্রতি ৭৫ ডলারের বেশি হয়ে গেছে, যা চলতি মাসের শুরুতে ৭০ ডলারের কম ছিল। মূলত জ্বালানি উৎপাদনকারীরা উৎপাদন কমিয়ে দেওয়ায় দাম বেড়েছে। উৎপাদকরা উৎপাদন কমিয়ে দাম বাড়িয়ে নিতে চাইছে।
এছাড়া বিশ্ব বাজারে এলপিজির (লিকুফাইড পেট্রোলিয়াম গ্যাস) দামও বাড়তে শুরু করেছে। তথ্য অনুযায়ী, গত মে মাসে প্রতি টন প্রোপেন ৪৯৫ ডলার এবং বিউটেন ৪৭৫ ডলার হিসেবে বিক্রি হলেও চলতি জুন মাসে প্রতি টন প্রোপেন ৫৩০ ডলার এবং বিউটেন ৫২৫ ডলার হিসেবে বিক্রি হচ্ছে।
বিপিসির অঙ্গ প্রতিষ্ঠান এলপি গ্যাস কোম্পানি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবু হানিফ আজাদীকে বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে এলপিজির দামও বাড়ছে। আমরা স্থানীয় উৎস থেকে সংগ্রহ করে বোতলজাত এলপিজি সরবরাহ করে থাকি। তবে চাহিদার বেশিরভাগ পূরণ হয় আমদানি করে। আন্তর্জাতিক বাজারে এলপিজির দাম বাড়ার কারণে দেশীয় বাজারেও এর প্রভাব পড়বে।