বাহারি পণ্যের পসরা

বলী খেলার মেলা ঘিরে উৎসবের আমেজ, বিক্রিও হচ্ছে

আজাদী প্রতিবেদন | সোমবার , ২৫ এপ্রিল, ২০২২ at ৫:৪৯ পূর্বাহ্ণ

বিক্রেতাদের হাঁক-ডাক, ক্রেতার বচসা, বাঁশির সুর, খেলনার টুং টাং শব্দ-সব মিলিয়ে ঐতিহাসিক জব্বারের বলী খেলা উপলক্ষে আয়োজিত মেলা ঘিরে উৎসবের আমেজ তৈরি হয়েছে নগর জুড়ে।

বৈশাখের তপ্ত দুপুর, প্রচণ্ড তাপদাহ। তারই মাঝে সেজেছে লালদিঘি মাঠের আশেপাশের প্রায় তিন কিলোমিটার এলাকা। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ পরিস্থিতিতে দুই বছর বন্ধ থাকার পর গতকাল রোববার থেকে শুরু হওয়া বৈশাখী মেলায় দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা সহস্রাধিক বিক্রেতা পণ্যের পসরা সাজিয়ে বসেছেন।

তিনদিনব্যাপী এ মেলায় নানা ধরনের গৃহস্থালি ও লোকজ পণ্যের সমাহার ঘটেছে। মাটির তৈরি তৈজসপত্র, টেপা পুতুল, কাচের চুড়ি, পাট পণ্যের পাশাপাশি কাঠের পুতুল, হাতপাখা, মুড়ি-মুড়কি, বাঁশি, শিশুদের খেলনা, টমটম গাড়ি, নারীদের ইমিটেশনের গহনা, শীতলপাটি, গাছের চারা, বাঁশের শলার তৈরি মাছ ধরার চাঁই, ডালা, কুলা, দা-বঁটি, প্লাস্টিকের ফুলসহ বাহারি সব জিনিস কিনতে আসছেন মানুষ। ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের রকমারি শোপিসের প্রতি আগ্রহ বেশি দেখা গেছে তরুণ-তরুণীদের। দোকানে মানুষের সমাগম জানান দিচ্ছে জমতে শুরু করেছে বৈশাখী মেলা। বলা হয়, সুই থেকে ফুলশয্যার খাটও মেলে জব্বারের বলী খেলায়। কিন্তু এবার খাট-পালংক, কাঠের আসবাবপত্র কম। কম দেখা গেছে ফুলের ঝাড়ু বা নারকেল পাতার শলার ঝাড়ুও।

গতকাল দুপুরে মেলা ঘুরে দেখা যায়, গ্রামীণ লোকজ সংস্কৃতির নানা জিনিসপত্রের সমাহার দেখতে ভিড় করেছেন নানা বয়সী মানুষ। সকালে ভিড় না থাকলেও দুপুরের পর ভিড় বাড়তে থাকে। সবচেয়ে বেশি ভিড় দেখা যায় মাটির তৈরি সৌখিন জিনিসপত্রের দোকানে। দোকানিরা বলছেন, সন্ধ্যার পর থেকে মেলায় ভিড় আরো বাড়বে। মেলা চলবে রাতভর।

গতকাল দুপুরে মেলা পরিদর্শন করতে যান সিটি মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী। সমবেতদের উদ্দেশে তিনি বলেন, দূর-দূরান্ত থেকে গ্রামের লোকজন বিভিন্ন ধরনের পণ্য তৈরি করে বিক্রি করতে এসেছেন। আমরা যারা শহরবাসী, আমরা আমাদের কৃষ্টি, ঐতিহ্য, গ্রামীণ মেলার যে সংস্কৃতি সেটা ভুলে যাচ্ছি। দূর-দূরান্ত থেকে আসা বিক্রেতারা আমাদের সেই ঐতিহ্যের কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন। একইভাবে আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে যেসব পণ্য প্রয়োজন সেগুলো বিক্রি করছেন। আমাদের সবার উচিত তাদের সহযোগিতা করা এবং উৎসাহ-উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে এই মেলায় অংশগ্রহণ করা।

মাটির তৈরি ফুলদানিতে রঙ লাগাতে ব্যস্ত বিক্রয়কর্মী সাজু। বেচাকেনা কেমন চলছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, দুই বছর পর মেলায় এলাম। সাধারণত দুপুর ২টার পর মানুষজনের আনাগোনা বাড়বে। এখন পর্যন্ত বেচাকেনা ভালো চলছে। আশা করছি বাকি দুদিন আরও ভালো চলবে।

লালদিঘি পেট্রোল পাম্প এলাকায় মাটির তৈরি জিনিসপত্রের হাট বসেছে যেন। সাজুর মতো অনেকেই ঢাকা, শাহবাগ, সাভার, বরিশাল, কুমিল্লা থেকে মেশিন, ডাইস, হাতে তৈরি রকমারি মাটির জিনিস নিয়ে এসেছেন। তাদের একজন দীপু। তিনি জানান, এক ট্রাকে দুই আড়াই লাখ টাকার মাটির জিনিস আনা হয়। আনার পথে অনেক জিনিস ভেঙে যায়। ঈদের আগে মেলা হওয়ায় আশা করছি মানুষ পছন্দের জিনিসটি সংগ্রহ করতে পারবেন। তিনি বলেন, সেহেরি পর্যন্ত স্টল খোলা রাখব। দিনে প্রখর রোদের কারণে অনেকে মেলায় আসেন না, তারা রাতে রিলাঙে কেনাকাটা করেন।

ঢাকার শনির আখড়া থেকে লায়লা এসেছেন হরেক রকমের চুড়ির পসরা নিয়ে। সর্বনিম্ন ৫০ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ২০০ টাকা পর্যন্ত চুড়ি রয়েছে তার কাছে। জানালেন, আজকে প্রথম দিন, তাই বিক্রি একটু কম। ইফতারের পর বাড়বে।

কুমিল্লার হোমনা থেকে বিভিন্ন ধরনের বাঁশি নিয়ে এসেছেন লিটন। ক্রেতাকে আকৃষ্ট করতে নিজেই তুলছেন সুর। নিজের তৈরি প্রায় ৫০০ বাঁশি নিয়ে এসেছেন মেলায়। তিন দিনে সব বাঁশি বিক্রি করে বাড়ি ফিরতে পারবেন বলে আশা তার।

নরসিংদী থেকে মোহাম্মদ সোহেলের নেতৃত্বে আসা ৯ জন দুটি দোকান দিয়েছেন কেসিদে রোডে। সোহেল বলেন, এবার দোকান কম। সবাই আসেনি। বিক্রি ভালো হবে বলে আশা করছি।

কুষ্টিয়ার পান নিয়ে এসেছেন সুধীর দাস। ঢাকা থেকে ফুলের ঝাড়ু, বেতের ঝুড়িসহ গৃহস্থালি নানা সামগ্রী নিয়ে এসেছেন লায়লা বেগম। বরিশাল থেকে মাটির তৈজসপত্র নিয়ে এসেছেন তমাল পাল। তার দোকানে মিলছে মাটির তৈরি খেলনাও। তিনি জানালেন, করোনার কারণে গত দুই বছর ছাড়া অন্তত ৪০ বছর ধরে তিনি মেলায় আসছেন।

বেতের হাতপাখা নিয়ে গাজীপুর থেকে এসেছেন আমির হোসেন। তার দোকানে আছে বিভিন্ন কারুকাজের তালপাতার পাখা। দা-ধামা, কুড়াল, শিল-নোড়া নিয়ে রাঙ্গুনিয়া থেকে এসেছেন পিন্টু দাশ। তিনি বলেন, আমি যেসব জিনিস এনেছি সেগুলোর কাস্টমার মহিলারা। তারা সন্ধ্যার পর কিংবা ভোরের দিকে আসবে।
সোনালী ব্যাংকের সামনে বসেছে শীতল পাটির হাট। ছোট-বড়-মাঝারি নকশাদার বেতের পাটি মিলছে ১ থেকে ৪ হাজার টাকায়। তবে পাটি বিক্রেতাদের ঘাড়ে নিশ্বাস ফেলছে সস্তা টেকসই প্লাস্টিকের মাদুর।

লালদিঘির উত্তর-পূর্ব কোণে বসেছে দেশি-বিদেশি ফুল ও ফলের চারার স্টল। বিক্রেতারা জানালেন, ছোট ছোট চারা বেশি বিক্রি হচ্ছে।

এদিকে মেলা হবে কি হবে না এ দোলাচলে অনেক ব্যবসায়ী মেলায় অংশ নিতে পারেননি বলে মন্তব্য নরসিংদী থেকে আসা গৃহস্থালি পণ্যের ব্যবসায়ী সোহেল রানার। তিনি বলেন, দুই বছর পর মেলাটা হচ্ছে। প্রথম দিকে খুব আশাহত হয়েছিলাম। এরপর যখন বলল মেলা হবে তখন হঠাৎ করে প্রস্তুতি নিয়ে আসতে হয়েছে। যে কারণে দূরদুরান্ত থেকে অনেক ব্যবসায়ী আসতে পারেননি। চাঁদা দিতে হচ্ছে কিনা জানতে চাইলে বলেন, না, কোনো চাঁদা লাগে নাই। আশা আছে এবার ভালো ব্যবসা হবে।

কেনাকাটা করতে আসা জামালখান এলাকার গৃহিণী কামরুন নাহার বলেন, দিনের বেলা সংসারের কাজ থাকে। প্রতি বছর রাতে আসি গৃহস্থালি পণ্যসামগ্রী কিনতে। মাটির ব্যাংক, ফুলদানি, হাতপাখাসহ টুকিটাকি কিছু জিনিস প্রতি বছরই কিনতে হয় বলে জানান তিনি।

বৈশাখী মেলা কমিটির সভাপতি কাউন্সিলর জহরলাল হাজারী আজাদীকে বলেন, দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বাহারি পণ্যের পসরা সাজিয়ে এক হাজার ব্যবসায়ী এই মেলায় এসেছেন। আমরা পর্যাপ্ত নিরাপত্তার ব্যবস্থা রেখেছি। সবাইকে বলব নির্বিঘ্নে মেলায় আসেন। নতুন প্রজন্ম যাতে জব্বারের বলী খেলার সঙ্গে পরিচিত হতে পারে সেই ব্যবস্থা আমরা করেছি। যদিও এবার অস্থায়ীভাবে বলী খেলার আয়োজন করেছি, তাই সাময়িক সমস্যা হবে। তবে আমরা সুষ্ঠুভাবে শেষ করতে পারব বলে আশা করছি।

বলী খেলা ও বৈশাখী মেলা ঘিরে বাড়তি নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেছে সিএমপি। সিএমপির উপ-কমিশনার (দক্ষিণ) জসিম উদ্দিন আজাদীকে বলেন, থানার নিয়মিত দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যের বাইরে অতিরিক্ত ফোর্স মেলা উপলক্ষে মোতায়েন করা হয়েছে। গোয়েন্দা পুলিশ ও কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের সদস্যরাও দায়িত্ব পালন করছেন।

এদিকে কারও সঙ্গে অবৈধভাবে কোনো অর্থ লেনদেন না করার আহ্বান জানিয়ে মেলা কমিটির পক্ষ থেকে দিনভর মাইকিং করা হচ্ছে। সার্বিক বিষয়ে সিএমপির পক্ষ থেকে একটি নিয়ন্ত্রণ কক্ষ খোলা হয়েছে। কোনো অভিযোগ থাকলে ০৩১-৬৩০৩৫২, ০৩১-৬৩০৩৭৫, ০৩১-৬৩৯০২২, ০১৩২০০৫৭৯৯৮ এবং জাতীয় জরুরি সেবা নম্বর ৯৯৯-এ যোগাযোগের জন্য বিজ্ঞপ্তি জারি করেছে সিএমপি।

পূর্ববর্তী নিবন্ধকৌতুক কণিকা
পরবর্তী নিবন্ধঅনেক প্রতীক্ষার জব্বারের বলী খেলা আজ