বিশ্ব থ্যালাসেমিয়া দিবস আজ। থ্যালাসেমিয়া একটি বংশগত রক্ত স্বল্পতা জনিত দুরারোগ্য ব্যাধি। বাংলাদেশে এই রোগের বাহকের সংখ্যা অনেক। স্বামী–স্ত্রী উভয়ই থ্যালাসেমিয়ার জীনবাহক হলে সন্তান থ্যালাসেমিয়া রোগী হওয়ার আশঙ্কা থাকে। প্রতিবছর বাংলাদেশে জন্মগত রক্তরোগ থ্যালাসেমিয়া নিয়ে জন্মগ্রহণ করে ৬ হাজার থেকে ৭ হাজার শিশু। বর্তমানে দেশে প্রায় ৭০ হাজার মানুষ এই রোগে ভুগছে। গত মঙ্গলবার থ্যালাসেমিয়া–বিষয়ক এক কর্মশালায় বাংলাদেশ থ্যালাসেমিয়া ফাউন্ডেশন এসব তথ্য উপস্থাপন করেছে।
আজ (৮ মে) পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও বিশ্ব থ্যালাসেমিয়া দিবসটি পালিত হচ্ছে। থ্যালাসেমিয়া রোগ এবং এর প্রতিকার সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে প্রতি বছর এ দিন দিবসটি পালন করা হয়।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য মতে, বাংলাদেশে ১১ দশমিক ৪ শতাংশ মানুষ থ্যালাসেমিয়া রোগের বাহক। ২০১৪–১৫ সালে বাংলাদেশে ৭ থেকে ৮ শতাংশ মানুষ থ্যালাসেমিয়া রোগের বাহক ছিল। দেশে ৬০ থেকে ৭০ হাজার থ্যালাসেমিয়া রোগী রয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরিসংখ্যান মতে, বাংলাদেশের জনসংখ্যার ৭ শতাংশ অর্থাৎ প্রায় ১ কোটি ১০ লাখ মানুষ থ্যালাসেমিয়া রোগের বাহক।
বাংলাদেশ থ্যালাসেমিয়া ফাউন্ডেশনের এক প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, ২০১৮ সালে রোগীর সংখ্যা ছিল ২ হাজার ৭২৫ জন। ২০১৯ সালে ৩ হাজার ৯৮ জন, ২০২০ সালে ৩ হাজার ৪১৬ জন, ২০২১ সালে ৪ হাজার ৯৪১ জন, ২০২২ সালে ৬ হাজার ৫৫ জন, ২০২৩ সালে ছিল ৭ হাজার ২২ জন এবং ২০২৪ সালে এসে দাঁড়িয়েছে ৭ হাজার ৫১১ জন থ্যালাসেমিয়া রোগী। প্রতিবছর ৬ থেকে ৭ হাজার শিশু থ্যালাসেমিয়া নিয়ে জন্ম নেয়। তবে সব বাহকই রোগী হন না।
বিশেষজ্ঞরা জানান, মানব কোষে রক্ত তৈরি করার জন্য দুটি জিন থাকে। কোনো ব্যক্তির রক্ত তৈরির একটি জিনে ত্রুটি থাকলে তাকে থ্যালাসেমিয়া বাহক এবং দুটি জিনেই ত্রুটি থাকলে তাকে থ্যালাসেমিয়া রোগী বলা হয়। শিশু জন্মের এক থেকে দুই বছরের মধ্যে এই রোগ ধরা পড়ে। ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়া, দুর্বলতা, ঘন ঘন রোগ সংক্রমণ, শিশুর ওজন না বাড়া, জন্ডিস ও খিটখিটে মেজাজ ইত্যাদি এই রোগের লক্ষণ।
বিশ্ব থ্যালাসেমিয়া দিবস উপলক্ষে অন্তর্র্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস বাণী দিয়েছেন। এ বছরে দিবসটির প্রতিপাদ্য ‘থ্যালাসেমিয়ার জন্য সামাজিক ঐক্য গড়ি, রোগীর অগ্রাধিকার নিশ্চিত করি’।
এই ব্যাপারে চমেক হাসপাতালের হেমাটোলজি বিভাগের রেজিস্ট্রার ডা. সৌরভ বিশ্বাস দৈনিক আজাদীকে বলেন, থ্যালাসেমিয়া নিরাময়যোগ্য নয়। বাহকে–বাহকে বিয়ে না হলে এই রোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব। তাই জাতীয় পরিচয় ইস্যু করার আগে থ্যালাসেমিয়া পরীক্ষা করে তিনি যদি বাহক কিংবা রোগী হয়ে থাকেন, তবে সেটি জাতীয় পরিচয়পত্রে (এনআইডি) উল্লেখ করা প্রয়োজন। এই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক বলেন, সচেতনতার অভাবে বাড়ছে থ্যালাসেমিয়া রোগী।
সম্প্রতি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড বায়োটেকনোলজি বিভাগ, বায়োটেড ও নেটওয়ার্ক অফ ইয়াং বায়টেকনলজিস্ট বাংলাদেশ (চবি চ্যাপ্টার) এর উদ্যোগে ‘থ্যালাসেমিয়া সচেতনতা ও স্ক্রিনিং’ বিষয়ক কর্মশালায় বিশেষজ্ঞরা বলেন, এদেশের ১১ শতাংশ মানুষ থ্যালাসেমিয়া রোগে আক্রান্ত। এর চিকিৎসা ব্যয়বহুল এবং প্রতি মাসে ৩০ থেকে ৩৫ হাজার টাকা খরচ করতে হয় একজন রোগীকে। শুধুমাত্র সচেতনতার অভাবে এই রোগের হার বহু শতাংশ বেড়ে যায়।
চট্টগামের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের মতে, যদি বাবা ও মায়ের দুজনেই থ্যালাসেমিয়ার বাহক হন, তবে সন্তানের থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা খুব বেশি। স্বাভাবিক মানুষের লোহিত রক্তকণিকার গড় আয়ু ১২০ দিন হলেও ত্রুটিপূর্ণ হিমোগ্লোবিনের কারণে থ্যালাসেমিয়া রোগীর লোহিত রক্তকণিকার গড় আয়ু অনেক কমে যায়। অপরিপক্ব অবস্থায় লোহিত রক্তকণিকা ভেঙে যায়, তাই রক্তস্বল্পতা দেখা দেয়। এটি এক ধরনের এনিমিয়া। প্রধানত দুই ধরনের থ্যালাসেমিয়া হয়। তবে আমাদের দেশে ই–বিটা ও বিটা থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত রোগীই বেশি।
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের হেমাটোলজি বিভাগে গত সাড়ে চার বছরে ৪৯৯ জনের থ্যালাসেমিয়া নির্ণয়ের হিমোগ্লোবিন ইলেক্ট্রোফোরেসিস পরীক্ষা হয়েছে। এর মধ্যে ৬৩ শতাংশ স্বাভাবিক ছিল। বাকি ২৫ শতাংশ থ্যালাসেমিয়ার বাহক এবং ১৩ শতাংশের বিভিন্ন ধরনের থ্যালাসেমিয়া রোগী। বর্তমানে হেমাটোলজি বিভাগের থ্যালাসেমিয়া ক্লিনিকে ২৩০ জন থ্যালাসেমিয়ার বাহক ও রোগী নিয়মিত চিকিৎসকদের ফলোআপে রয়েছেন। তবে এদের মধ্যে ই–বিটা ধরনের থ্যালাসেমিয়া রোগী প্রায় ৫৯ শতাংশ।
বিশেষজ্ঞরা জানান, আমাদের দেশে অনেকে মানুষ জানেন না, তারা থ্যালাসেমিয়ার বাহক কি না। তাই অজান্তেই থ্যালাসেমিয়া বাহকদের মধ্যে বিয়ে হচ্ছে এবং দিনদিন থ্যালাসেমিয়া রোগী বাড়ছে। বাবা–মা উভয়ই থ্যালাসেমিয়ার বাহক হলে সন্তানের থ্যালাসেমিয়া রোগী হওয়ার ঝুঁকি ২৫ শতাংশ, বাহক হওয়ার ঝুঁকি ৫০ শতাংশ আর সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা ২৫ শতাংশ। আর বাবা–মার যেকোনো একজন থ্যালাসেমিয়ার বাহক হলে সন্তানের থ্যালাসেমিয়া বাহক হওয়ার ঝুঁকি ৫০ শতাংশ, সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা ৫০ শতাংশ, তবে থ্যালাসেমিয়া রোগী হওয়ার আশঙ্কা নেই। চাচাতো, মামাতো, খালাতো, ফুফাতো ভাইবোনের মধ্যে বিয়ে হলে থ্যালাসেমিয়া রোগী হওয়ার ঝুঁকি অনেক বেড়ে যায়।