বৃষ্টি হলেই জলাবদ্ধতা। ডুববে শহর। দুর্ভোগ বাড়বে নগরবাসীর। এ যেন নিয়মে পরিণত হয়েছে। সেই নিয়ম মেনে গতকালও পানির নিচে ছিল শহরের অনেক এলাকা। আগের রাত অর্থাৎ বুধবার রাত থেকে গতকাল বৃহস্পতিবার ভোর পর্যন্ত টানা বৃষ্টি হয়েছে। এতেই তলিয়ে যায় নিচু এলাকা। সকালে বৃষ্টি বন্ধ হলেও প্রায় দুপুর পর্যন্ত পানি আটকে ছিল অনেক জায়গায়। বুধবার মধ্যরাতে অবশ্য অনেক জায়গায় কোমর সমান পানি হয়েছে। বাসা-বাড়ি, দোকান-পাট এমন কি হাসপাতালেও পানি ঢুকে যায়। এতে দুর্ভোগ বাড়ে সাধারণ মানুষের। বাসা-বাড়ি, দোকান থেকে পানি সেচ করতে করতে রাত পার করেন তারা। এদিকে চান্দগাঁওসহ আশেপাশের এলাকায় পানি আটকে থাকায় গতকাল বেলা সাড়ে ১১ টার দিকে ডোমখালের মুখ থেকে একটি বাঁধ কেটে দিয়েছে নগরে জলাবদ্ধতা নিরসনে চলমান মেগা প্রকল্পের বাস্তবায়নকারী সংস্থা বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। সিডিএ স্লুইচ গেট নির্মাণে অন্য একটি প্রকল্পের আওতায় বাঁধটি দেওয়া হয়েছিল।
পতেঙ্গা আবহাওয়া অফিসের পূর্বাভাস কর্মকর্তা শেখ আবদুল হান্নান দৈনিক আজাদীকে বলেন, বুধবার রাত ১২ টা থেকে বৃহস্পতিবার ভোর ৬ টা পর্যন্ত ছয় ঘণ্টায় নগরে ৬৩ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড হয়েছে। এছাড়া গতকাল সকাল ৯ টা পর্যন্ত সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় ২০৩ দশমিক ২ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড হয়েছে। বৃহস্পতিবার মধ্য রাত থেকে পরবর্তী ২৪ ঘণ্টায়ও ভারী বর্ষণ হতে পারে বলে জানিয়েছেন তিনি। এদিকে নগরের বিভিন্ন এলাকা পরিদর্শনে দেখা গেছে, বুধবার রাতেই মুরাদপুর ও বহাদ্দারহাটে প্রায় কোমর সমান পানি ছিল। রাত ১ টার দিকে মুরাদপুর মোহাম্মদপুর এলাকার বাসিন্দা একজন গণমাধ্যমকর্মী আজাদীকে বলেন, অফিস থেকে সিএনজি করে ফেরার সময় কাতালগঞ্জে প্রায় কোমর সমান পানি দেখতে পাই। পরে সিএনজি চালক চকবাজার-বহাদ্দারহাট হয়ে আসার চেষ্টা করেও পারেননি। কারণ তেলিপট্টি মোড় পার হতেই পানি। কাপাসগোলা, বাদুরতলা হয়ে বহাদ্দারহাট পর্যন্ত কোথাও কোমর কোথাও হাঁটু সমান পানি ছিল। পরে প্রবর্তক ও পাঁচলাইশ হয়ে মুরাদপুর পৌঁছি। কিন্তু মুরাদপুর-বহদ্দারহাট সড়কের উত্তর পাশে হাঁটুর উপর পানি ছিল। সেখান থেকে হেঁটে মোহাম্মদপুর রোডে ঢুকতেই ছিল কোমরের বেশি পানি। এসময় কয়েকটি বাসায় নিচতলায় ঢুকে যাওয়া পানি মেশিন দিয়ে সেচ করতে দেখেছি। মোহাম্মদপুর রোডের প্রতিটি দোকানে পানি ঢুকে গেছে। রাত জেগে দোকানদাররা পানি সেচে ব্যস্ত ছিলেন।
এদিকে নগরের চকবাজারের মুহাম্মদ আলী শাহ দরগাহ লেন এলাকায় গতকাল দুপুর ১ টায়ও পানি দেখা গেছে। ওই এলাকার রাস্তাঘাট ও ঘরবাড়িতে হাঁটু সমান পানি ঢুকে গেছে। স্থানীয়রা জানান, সেখানে রাত তিনটা থেকে বাসা-বাড়িতে পানি ঢুকতে শুরু করে। স্থানীয় বাসিন্দা আবদুল হামিদ বলেন, বৃষ্টি হলেই আমাদের ঘরে পানি ঢুকে যায়। এতে ঘরের জিনিসপত্র নষ্ট হয়। জলাবদ্ধতা নিরসনে হাজার হাজার কোটি টাকার প্রকল্পের গল্প শুনি। কিন্তু এর সুফল তো আমরা পাচ্ছি না।
আগ্রাবাদ মা ও শিশু হাসপাতালে বুধবার রাতেই পানি ঢুকে যায়। হাসপাতালটির নিচতলা তলিয়ে যায় পানিতে। সেখানে হাঁটু সমান পানি ছিল। এতে দুর্ভোগ বাড়ে রোগী ও স্বজনদের। গতকাল দুপুরেও পানি ছিল হাসপাতালটির নিচ তলায়। নিচতলার শিশু ওয়ার্ড, অভ্যর্থনা কক্ষ, বহির্বিভাগ, প্রশাসনিক বিভাগে কাজ করা যায়নি। এ কারণে জরুরি বিভাগ তৃতীয় তলায় স্থানান্তর করা হয়। নিচতলায় থাকা সাধারণ শিশু ওয়ার্ডের কয়েকজন রোগীকে চতুর্থ তলায় সরিয়ে নেওয়া হয়েছে বলে হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে। হাসপাতালের পরিচালক ডা. নুরুল হক সাংবাদিকদের বলেন, ‘প্রতি বছর বর্ষায় মুষলধারে বৃষ্টির সঙ্গে জোয়ারের পানিতে হাসপাতালের নিচতলা তলিয়ে যায়। এটি অনেক আগে থেকে হয়ে আসছে। বুধবার রাতেও বৃষ্টিতে নিচতলায় পানি জমেছে।’ রোগীর নিকটাত্মীয় মাহমুদ বলেন, মঙ্গলবার ভাগ্নেকে নিয়ে হাসপাতালে এসেছিলাম। বুধবার রাতে বৃষ্টিতে পানি উঠে যাওয়ায় আমাদের আসা-যাওয়া করতে অনেক কষ্ট হয়েছে। হাঁটু পরিমাণ পানি ডিঙিয়ে ওষুধসহ জিনিসপত্র আনা-নেওয়া করেছি।
এদিকে হালিশহরের কে-ব্লক এলাকায় বিভিন্ন সড়কে গোড়ালি থেকে হাঁটু পরিমাণ পানি জমেছিল গতকাল সকালেও। সেখানে ভবনের ভেতর ও সামনে পানি জমে থাকায় তা নিষ্কাশনে পাম্প বসাতে দেখা গেছে। কয়েকটি ভবনে দেখা গেছে, নিচতলায় পার্কিংয়ে রাখা গাড়ি ও মোটরসাইকেলের অর্ধেক ডুবে ছিল।
এছাড়া শুলকবহর ফ্লাইওভারের মুখে কোমর সমান পানি ছিল। চান্দগাঁও আবাসিক এলাকা ও বাস টার্মিনাল এলাকায় রাতে কোথাও কোমর, কোথাও হাঁটু সমান পানি ছিল। ষোলশহর, কাপাসগোলা, চকবাজার বাদুরতলা, আবদুল হামিদ লেন, চাক্তাই, বাকলিয়া, ডিসি রোড, হালিশহর, চান্দগাঁওয়ের বিভিন্ন এলাকা, দক্ষিণ কাট্টলী ও কাতালগঞ্জ, চকবাজার জেলেপাড়া, মুহাম্মদ আলি শাহ দরগাহ লেন, ঘাসিয়ার পাড়া, ফুলতলা, কে বি আমান আলী রোড, ঝর্ণাপাড়া ও রসুলবাগ এলাকা পানিতে তলিয়ে গেছে। আগ্রাবাদ, সিডিএ আবাসিক, কমার্স কলেজ রোডও ডুবে যায়। এছাড়া মকবুল সওদাগর লেন, জঙ্গি শাহ মাজার এলাকা, বগারবিল, পেরেক ফ্যাক্টরি, ইছহাকের পুল ও মিয়া খান নগরে পানিবন্দী হয়ে পড়েন এলাকাবাসী। সেখানে বাসা-বাড়িতে পানি ঢুকেছে।
এদিকে জলাবদ্ধতায় অতিষ্ঠ নগরবাসী ফেসবুকে ব্যঙ্গ করে নানা পোস্ট করেন। কয়েকটি এলাকার পানিতে ডুবে থাকার ছবি পোস্ট করে লিখেন, ‘মাছ ধরা জাল আর নৌকা থাকলে চলে আসেন বহদ্দারহাট এলাকায়। সিডিএ পরবর্তী প্রকল্পে কালুরঘাট থেকে এয়ারপোর্ট নৌকা সার্ভিস চালু করবে আশা করি।’
মেগা প্রকল্পের বাস্তবায়নকারী সংস্থার প্রকল্প পরিচালক লে.কর্নেল মোহাম্মদ শাহ আলী আজাদীকে বলেন, ‘ডোমখালের মুখে সিডিএ স্লুইচ গেট নির্মাণে যে বাঁধ দিয়েছিল সেটা তাদের সাথে সমন্বয় করে কেটে দিয়েছি। এরপর টার্মিনাল, চান্দগাঁও আবাসিক এলাকা, বহদ্দারহাট, বাড়ইপাড়াসহ আশেপাশের এলাকার পানি দ্রুত নেমে যায়। নোয়াখালেও তাদের বাঁধ আছে। সেটার কিছুটা কেটে দিয়েছি। সম্পূর্ণ কাটার জন্য তাদের চিঠি দিয়েছি। সেটা কেটে দিলে পানি দ্রুত নেমে যাবে।’











