বাসায় নগদ ৫০ কোটি টাকা রয়েছে–এমন একটি খবর বিশ্বাস করে টাকাগুলো হাতিয়ে নেওয়ার জন্য সংঘবদ্ধ ডাকাতদল হানা দিয়েছিল নগরীর দক্ষিণ খুলশীর যমুনা অয়েল কোম্পানির সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক গিয়াস উদ্দিন আনসারীর ফ্ল্যাটে। ডিজিএফআই পরিচয়ে তারা ঢুকেছিল ফ্ল্যাটে। টাকাগুলো বস্তা ভরতি করে নেওয়ার জন্য ২৫টি খালি বস্তাও এনেছিল। সিন্দুক বা আলমারি ভাঙার জন্য এনেছিল শাবল। অস্ত্র হিসেবে এনেছিল ৩টি খেলনা রিভলবার। তবে অ্যাপার্টমেন্টের ফ্ল্যাট মালিকদের সম্মিলিত চেষ্টা এবং পুলিশের দ্রুত পদক্ষেপে ১৫ জনের দলটির ১২ জনই ধরা পড়েছে। তাদেরকে গতকাল শনিবার আদালতে হাজির করে তিন দিনের রিমান্ডে আনা হয়েছে।
পুলিশ এবং স্থানীয় সূত্র জানিয়েছে, শুক্রবার রাত ১০টার দিকে দুটি কালো মাইক্রোবাসে করে ১৫ জনের একটি দল দক্ষিণ খুলশীর ৩ নং সড়কের সানমার রয়্যাল রিচ বিল্ডিংয়ের নিচে পৌঁছে। তারা ভবনটির নিরাপত্তাকর্মীদের কাছে নিজেদেরকে ডিজিএফআইয়ের লোক বলে পরিচয় দেয়। তাদের কারো কারো গলায় ওই গোয়েন্দা সংস্থার ভুয়া পরিচয়পত্র ঝুলছিল। তারা ৩ জন নিরাপত্তাকর্মীর হাত–পা ও চোখ বেঁধে ফেলে। সেই সঙ্গে তাদের মোবাইল ফোন ছিনিয়ে নেয় এবং সিসিটিভির হার্ডডিস্কও নিয়ে যায়। ডাকাতরা ইন্টারকম সংযোগও বিচ্ছিন্ন করে দেয়।
পরে ডাকাতদলের সদস্যরা ভবনের ৮ তলায় যমুনা ওয়েল কোম্পানির সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক গিয়াস উদ্দিন আনসারীর ফ্ল্যাটের দরজা ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করে বাসার মালামাল লুট করার চেষ্টা করে। এ সময় আশেপাশের ফ্ল্যাটের লোকজন জানতে পেরে ৯৯৯ নম্বরে ফোন করে খুলশী থানা পুলিশকে সংবাদ দেয়। খুলশী থানা পুলিশের একটি টিম দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছে ভবনটি ঘিরে ফেলে। পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়ে ডাকাতরা পালানোর চেষ্টা করলে পুলিশ উক্ত ভবনের বিভিন্ন স্থান থেকে ১২ জনকে আটক করতে সক্ষম হয় এবং ৩ জন ডাকাত পালিয়ে যায়। আটক ১২ জনকে জিজ্ঞাসাবাদের একপর্যায়ে তারা ডিজিএফআইয়ের সদস্য নয় বলে স্বীকার করে। তারা স্রেফ ডাকাতি করতে খালি ফ্ল্যাটটিতে এসেছিল বলে পুলিশকে জানায়।
এ ব্যাপারে খুলশী থানায় ডাকাতি চেষ্টার একটি মামলা রেকর্ড করে আটকদের গ্রেপ্তার দেখানো হয়। গতকাল তাদের আদালতে হাজির করে সাত দিনের রিমান্ডের আবেদন জানানো হলে আদালত তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করে। গ্রেপ্তারকৃতরা হচ্ছে মো. ইয়াকুব (৩৫), পিতা মৃত ইদ্রিস মিয়া, সাং খৈয়াখালী ১ নং ওয়ার্ড, ৯ নং পাহাড়তলী, থানা রাউজান, জেলা চট্টগ্রাম; মোজাহের আলম (৫৫), পিতা মৃত হাজী তোফাজ্জল আহম্মদ, সাং খৈয়াখালী, হাজী আবদুর রহমান কোম্পানির বাড়ি, থানা রাউজান, জেলা চট্টগ্রাম, বর্তমানে সাং বাদুরতলা, সৈয়দ আল মাদানি রোড, থানা চান্দগাঁও; মো. রুবেল হোসেন (২৬), পিতা মো. শাহ আলম, সাং ওয়াজেদিয়া, পোস্ট বাতুয়া, থানা হাটহাজারী, জেলা চট্টগ্রাম, বর্তমানে সাং হামজারবাগ রেলবিট, মদিনা ভবন, ৩য় তলা, থানা পাঁচলাইশ; মহিউদ্দিন (৪৫), পিতা মোহাম্মদ আবদুল শুক্কুর, সাং কদমতলী পোড়া মসজিদ, শুক্কুর কমিশনার বাড়ি, থানা সদরঘাট, জেলা চট্টগ্রাম; আবদুল সবুর (৩৭), পিতা আবদুল খালেক, সাং চুরিয়ালটুলী লেন, ফিরিঙ্গিবাজার, আব্দুল হাকিমের বাড়ি, থানা কোতোয়ালী, জেলা চট্টগ্রাম; মো. রুকন (৩৯), পিতা মৃত আমির হোসেন, সাং আলী সিকদার বাড়ি, ৬ নং ওয়ার্ড, ৪ নং ইউনিয়ন, থানা কুতুবদিয়া, জেলা কঙবাজার, বর্তমানে সাং বহদ্দারহাট খাজা রোড, থানা চান্দগাঁও, জেলা চট্টগ্রাম; মো. ওসমান (৪০), পিতা মৃত কামাল উদ্দিন, সাং লৌহগ্রাম, বাহার ভুঁইয়া বাড়ি, ৮ নং হিলোছিয়া, থানা বাজিতপুর, জেলা কিশোরগঞ্জ, বর্তমানে সাং রোড নং ২, কামাল উদ্দিনের বাসা, ব্লক এ, থানা হালিশহর, জেলা চট্টগ্রাম; মোহাম্মদ হোসেন (৪১), পিতা মৃত সিরাজুল হক, সাং দক্ষিণ বাঁশবাড়িয়া, সিরাজুল ইসলামের বাড়ি, ৩ নং ওয়ার্ড, থানা মীরসরাই, জেলা চট্টগ্রাম, বর্তমানে সাং বড়পুল, আবু তাহের ভাইয়ের বাসা, থানা হালিশহর, জেলা চট্টগ্রাম; মোহাম্মদ ওয়াজেদ প্রকাশ রাকিব (৩৬), পিতা মৃত মাহাবুব খান, সাং পশ্চিম পটিয়া কাজীবাড়ি, মনসা গ্রাম, কুসুমপুরা, থানা পটিয়া জেলা চট্টগ্রাম, বর্তমানে ওয়াপদা, হালিশহর এইচ ব্লক, খান ভিলা, থানা হালিশহর, জেলা চট্টগ্রাম; আবদুল মান্নান (৩৫), পিতা নুরুল আমিন, সাং মধ্য কুরুয়া, থানা মীরসরাই, জেলা চট্টগ্রাম, বর্তমানে সাং সবুজবাগ, হালিশহর, চট্টগ্রাম; শওকত আকবর ইমন (২৮), পিতা নুরুল ইসলাম, মাতা খাদিজা খাতুন, সাং মধ্য কুতুবদিয়া পাড়া, শওকতের বাড়ি, থানা সদর, জেলা কঙবাজার এবং মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ (৩৬), পিতা মো. সালাম সওদাগর, সাং চর খাশারিয়া, মহাজনপাড়া, থানা সাতকানিয়া, জেলা চট্টগ্রাম।
ডাকাতদলের সদস্যরা দুটি মাইক্রোবাস নিয়ে এলেও একটি নিয়ে তিনজন পালিয়ে যায়। কালো রঙের অপর একটি হাইয়েস মাইক্রোবাস (নং চট্ট–মেট্রো–চ–১১–৫৯৩১) জব্দ করা হয়েছে। এছাড়া ডাকাতদলের সদস্যদের কাছ থেকে একটি শাবল, ৩টি খেলনা পিস্তল (পুলিশ লেখা পিস্তল কভারসহ), ডিজিএফআই পরিচয় দানকারী ভুয়া পরিচয়পত্র এবং ২৫টি খালি প্লাস্টিকের বস্তা উদ্ধার করা হয়েছে।
গতকাল সংবাদ সম্মেলনে নগর পুলিশের উপ–কমিশনার (অপরাধ) রইছ উদ্দিন বলেন, তারা দুটি মাইক্রোবাসে করে খুলশী ৩ নম্বর সড়কের একটি ভবনে যায়। সেখানে গিয়ে নিজেদের গোয়েন্দা সংস্থার লোক পরিচয় দিয়ে ভবনে প্রবেশ করে নিরাপত্তারক্ষীদের হাত–পা বেঁধে ফেলে। এরপর অষ্টম তলায় গিয়াস উদ্দিন আনসারী নামে এক ব্যক্তির বাসায় ডাকাতি করতে যায়। পুলিশ গোপন সূত্রে খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে গিয়ে ১২ জনকে আটক করে এবং ডাকাতির কাজে ব্যবহৃত বিভিন্ন সরঞ্জাম উদ্ধার করে। তিনি বলেন, ঘটনার সময় ওই ফ্ল্যাটের লোকজন ছিলেন না। তারা সবাই বেড়াতে গিয়েছিলেন। আটকদের মধ্যে বিদেশ ফেরত, সাবেক ব্যাংকার, বালু সরবরাহকারী এবং দোকানের কর্মচারীও রয়েছেন।
খুলশী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মজিবুর রহমান আজাদীকে জানান, ৯৯৯– এর মাধ্যমে খবর পাওয়ার সাথে সাথে আমরা ঘটনাস্থলে গিয়ে ভবনটি ঘিরে ফেলি। ওই সময় ১২ জনকে আটক করি। মামলা হয়েছে, আসামিদের রিমান্ডে আনা হয়েছে। জিজ্ঞাসাবাদে বিস্তারিত জানা যাবে। তিনি বলেন, এটি স্রেফ ডাকাতির চেষ্টা বলে মনে হচ্ছে। তদন্তের পর বিস্তারিত জানা যাবে।
তবে ডাকাতদলের সদস্যদের উদ্ধৃতি দিয়ে নির্ভরশীল একটি সূত্র জানিয়েছে, উক্ত ফ্ল্যাটে ৫০ কোটি নগদ টাকা থাকার খবর পেয়ে তারা হানা দিয়েছিল। তাদের ধারণা ছিল, গোয়েন্দা সংস্থার নামে তারা বাসায় ঢুকে তল্লাশির নামে টাকাগুলো হাতিয়ে নিয়ে যেতে পারবে।