বাসযোগ্য চট্টগ্রাম গড়তে দরকার টেকসই ও বাস্তবসম্মত পরিকল্পনা

| বৃহস্পতিবার , ১৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ at ৬:১৯ পূর্বাহ্ণ

চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের মেয়র এম রেজাউল করিম চৌধুরীর দায়িত্ব গ্রহণের সময়কাল এক বছর পূর্ণ হয়েছে ১৫ ফেব্রুয়ারি। এই এক বছরে মেয়র কতটা অগ্রসর হয়েছেন, সে বিষয়ে হিসাব নিকাশ শুরু হয়ে গেছে। গত ১৫ ফেব্রুয়ারি দৈনিক আজাদীতে ‘মেয়রের এক বছর/কতটুকু পূরণ হলো প্রতিশ্রুতি’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, যৌক্তিক হারে গৃহকর নির্ধারণ, জলাবদ্ধতা নিরসন, খাল-নালা ও নর্দমার নাব্যতা ফিরিয়ে আনাসহ ৩৭ দফা উন্নয়ন প্রতিশ্রুতি (নির্বাচনী ইশতেহার) দিয়ে নগরপিতার দায়িত্ব নেন বীর মুক্তিযোদ্ধা এম রেজাউল করিম চৌধুরী। মঙ্গলবার সে দায়িত্বগ্রহণের এক বছর পূর্ণ হয়েছে। দায়িত্বপালনকালীন সময়ে নিজের প্রতিশ্রুতির কতটুকু পূরণ করতে পেরেছেন মেয়র? এ প্রশ্নই এখন নগরবাসীর। অবশ্য নাগরিকগণ নিজেরাই প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির হিসাব মেলাচ্ছেন। তাঁরা বলছেন, কোনো প্রতিশ্রুতিই শতভাগ পূরণ হয়নি। তবে কয়েকটি পূরণে চেষ্টা ও উদ্যোগ ছিল মেয়রের। আবার কিছু প্রতিশ্রুতি পূরণে দৃশ্যমান পদক্ষেপও গ্রহণ করা হয়নি।
স্থানীয় সরকার (সিটি কর্পোরেশন) আইন ২০০৯ অনুযায়ী, ২৮ ধরনের কাজ করার সুযোগ আছে মেয়রের। এর মধ্যে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, নালা-নর্দমা পরিষ্কার, সড়ক মেরামত ও সড়কবাতি নিশ্চিত অন্যতম। এসব কর্পোরেশনের প্রধান কাজ বলেও গণ্য। সেবাগুলো নিশ্চিত করেই শহরের অন্যান্য সযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির বিষয়টি সামনে আসে। এসব সেবা পূরণ হলেই মোটামুটি সন্তুষ্ট থাকেন নগরবাসীও। কারণ প্রতিবছর নগরবাসী যে পৌরকর পরিশোধ করেন তাতে পরিচ্ছন্ন ও আলোকায়ন রেইটও যুক্ত থাকে। তাই মেয়রের এক বছরের মূল্যায়নে এসব সেবা কতটা পেয়েছেন তা সামনে চলে আসে।
হাজার বছরের একটি ঐতিহ্যসমৃদ্ধ শহর চট্টগ্রাম। এর নামের সঙ্গে গ্রাম শব্দটি লেপ্টে আছে। ফলে অনেকে এখনো এই শহরটিকে গ্রামের ইমেজে দেখেন। আসলে এটি কোনো গ্রাম নয়। এর সংস্কৃতিও গ্রাম্য নয়। বিশ্লেষকদের মতে, আর্থসামাজিক, রাজনৈতিক ও ব্যবসা-বাণিজ্য এবং তার প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যের কারণে চট্টগ্রাম একটি কসমোপলিটন নগর। এখানে আরব, ইংরেজ, মগ, পর্তুগিজরা এসেছিল। কেউ ব্যবসা-বাণিজ্য, কেউ ধর্ম প্রচার, কেউ শাসন ও শোষণ করার মানসে। আবার কেউ এসেছিল দস্যুতা ও লুণ্ঠনের জন্য। বিচিত্র মানুষের উপস্থিতি ও অপরূপ প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যের কারণে এখানে গড়ে ওঠে মিশ্র সংস্কৃতি ও সামাজিক বৈশিষ্ট্য, যার সঙ্গে বাংলাদেশের অন্য কোনো জেলার মিল নেই। বৈশ্বিক উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে চট্টগ্রামেরও উন্নয়ন হয়েছে। তবে কায়েমি স্বার্থবাদীরা চট্টগ্রামকে পরিকল্পিত নগর হিসেবে গড়ে উঠতে দেয়নি। চট্টগ্রামের সমস্যা সমাধানের সঠিক পরিকল্পনা করা হয়নি। তাই বিশৃঙ্খলভাবে চট্টগ্রাম শহর আকারে বড় হয়েছে। অনন্য প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও সম্পদ হারিয়ে হয়েছে রুগ্ন।
মেয়র নির্বাচনী ইশতেহারে ‘যৌক্তিক হারে গৃহকর নির্ধারণ’ এর প্রতিশ্রুতি দিলেও সাম্প্রতিক সময়ে মেয়রের ভূমিকা নিয়ে নগরবাসী উদ্বিগ্ন। কর বাড়বে, তাতে আপত্তি নয়, নগরবাসীর আপত্তিটা অস্বাভাবিক হারে কর বৃদ্ধির বিষয়ে। পরিচ্ছন্নতা অভিযানেও গত এক বছরের খুব একটা সফলতা চোখে পড়ছে না। ‘ডোর টু ডোর ময়লা অপসারণ প্রকল্প’ চলছে কেমন যেন ঝিমিয়ে ঝিমিয়ে। মশক নিধন কার্যক্রম তো কোনো অবস্থাতেই সফল বলা যাবে না। এক্ষেত্রে আরো বেশি তৎপর হতে হবে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের।
নগর পরিকল্পনাবিদরা বলেন, বাসযোগ্য চট্টগ্রাম গড়তে দরকার টেকসই ও বাস্তবসম্মত নগর-পরিকল্পনা। কারণ, ইতিমধ্যে দেখা যাচ্ছে, মহাপরিকল্পনা অনুযায়ী উন্নয়ন কার্যক্রম পরিচালিত না হওয়ায় চট্টগ্রাম শহর অপরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠেছে। যে যেভাবে পারছে, নিজেদের মতো উন্নয়ন কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এর নেতিবাচক ফল ভোগ করতে হচ্ছে আমাদের। এ অবস্থা থেকে বের হতে হলে সব সেবা সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানকে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে। তাই চট্টগ্রাম বন্দর ও চট্টগ্রামের শিল্পাঞ্চল দেশের অর্থনীতিতে যেভাবে অবদান রাখছে, তাতে অতি দ্রুত বাসযোগ্য ও পরিকল্পিত চট্টগ্রাম নগরী গড়ে তোলার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু শুধু মহাপরিকল্পনা করলেই চলবে না, তার পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন প্রয়োজন। এর আগের মহাপরিকল্পনাগুলো কেন বাস্তবায়িত হয়নি, তারও মূল্যায়ন করা দরকার। নইলে একই ব্যর্থতার পুনরাবৃত্তি চলতেই থাকবে, অপরিকল্পিত নগরায়ণ সমস্যার সমাধান হবে না। ফলে এই নগরের বাসযোগ্যতা দিনে দিনে আরও কমে যাবে।
বাসযোগ্য নগরীর অন্যতম কারিগর হলেন নগর পরিকল্পনাবিদগণ। নগর উন্নয়নে তাঁদের পরিকল্পনা ও পরামর্শ গ্রহণ করা দরকার বলে আমরা মনে করি।

পূর্ববর্তী নিবন্ধকৌতুক কণিকা
পরবর্তী নিবন্ধএই দিনে