বাল্যবিবাহ একটা বিষফোঁড়া

অভিমত

গোপা রাণী দে | সোমবার , ৩০ ডিসেম্বর, ২০২৪ at ১০:৪০ পূর্বাহ্ণ

বাল্যবিবাহ, অল্পবয়সী মেয়েদের উপর জোরপূর্বক চাপিয়ে দেয়া এক সামাজিক কুপ্রথা এবং মারাত্মক সামাজিক ব্যাধিও বটে। ১৯২৯ সালের ২৪ শে সেপ্টেম্বর বৃটিশভারতে বাল্যবিবাহ রোধের আইন পাস হয়। সময়োপযোগী করে আইনটি ২০১৭ সালের ১১ই মার্চ নুতন আঙ্গিকে প্রণয়ন করা হয়েছে বাংলাদেশে। তবে আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগ না থাকায় এই দণ্ডনীয় অপরাধ দিনদিন বেড়েই চলেছে। তাছাড়া শাস্তির বিধান আরও কঠিন করা এবং জরিমানার পরিমাণও বাড়ানো দরকার। সাম্প্রতিক সময়ে এক আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে প্রতি বছর আমাদের দেশে ২ শতাংশ হারে বাল্যবিবাহ কমছে। তথ্যপ্রযুক্তির যুগে এসে তা বেমানান বটে কেননা আমাদের ২১৫ বছর লেগে যাবে অভিশাপমুক্ত হতে।

দারিদ্রতা, নিরাপত্তাহীনতা, সামাজিক চাপ ও অবাধ যৌন সম্পর্ক থেকে সুরক্ষা বাল্যবিবাহের অন্যতম কারণ। এর প্রভাবে নারীশিক্ষার হার কমেই চলেছে। ৭৫.৭ শতাংশ মেয়ের স্কুল ও কলেজে যাওয়া বন্ধ হয়ে যায় বাল্যবিবাহের কারণে। আমার কলেজের একাদশ শ্রেণির ঝরে পড়া কয়েকজন ছাত্রীর অভিভাবকের কাছে মেয়ে কলেজে আসে না কেন জানতে চাইলে বলেন-‘এখন অসুস্থ পরিবেশে আছি, মেয়ে সারাদিন মোবাইল ঘাঁটাঘাঁটি করে, আজেবাজে ভিডিও দেখে। ইন্টারনেট আমাদের সর্বনাশ করেছে। তাই ভালো পাত্র পেলে, নষ্ট হওয়ার আগেই বিয়ে দিয়ে দিব। কলেজে আর যাবে না।’ ছাত্রীদের সাথে কথা বলে মনে হলো বিয়ে নয় ওরা পড়তে আগ্রহী। বুঝলাম ব্যক্তিগত লক্ষ্য অর্জনে সীমাবদ্ধতা রয়েছে তাদের। এতে কিন্তু তাদের মানসিক স্বাস্থ্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। ৪৪.২ শতাংশ অভিভাবক মনে করেন মেয়েকে তাড়াতাড়ি বিয়ে দেয়া নিরাপদ। অন্যদিকে বরের বাড়ির লোকজন ভাবেন, কম বয়সী মেয়েরা পরিবারের বাধ্য হয়। তাদের ধারণা হলো বয়স ও শিক্ষাদীক্ষা বাড়লে অধিকারবোধ বাড়ে, তর্কে লিপ্ত হয়, ফলে সংসারে অশান্তি বাড়ে।

আমাদের দেশে ১৮ বছরের কম বয়সী মেয়ের বিয়ের হার ৫০ শতাংশ। সম্প্রতি আইসিডিডিআরবি ও ব্র্যাক এর এক সমীক্ষায় বলা হয়, প্রতি ৫ জনে ১ জন মেয়ের বিয়ে হয় ১৫ বছরের আগে। অধিকাংশ অল্পবয়সী নারীরা অপরিপক্ক সন্তান প্রসব করে, প্রসবকালীন মা কিংবা শিশুর মৃত্যুঝুঁকি, প্রজনন স্বাস্থ্য সমস্যাসহ নানাবিধ শারীরিক জটিলতার সম্মুখীন হয় তারা। তাছাড়া পরিপূর্ণ মানসিক বিকাশের অভাবে সংসার ও সন্তান কোনটাই দক্ষতার সাথে সামলাতে পারে না। অষ্টাদশ শতাব্দীতে ১২ বছরের রমণীর কোলে শিশু ছিল স্বাভাবিক দৃশ্য। ৭ বছর থেকেই পাত্রস্থ করতো, ১২ বছর পর অবিবাহিত থাকা ছিল নিন্দনীয়। উনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি কুপ্রথাটি রোধের ডাক দিয়েছিলেন অগ্নিপুরুষ রাজা রামমোহন রায়। পুরোহিতদের দ্বারস্থ হয়ে তাঁদের অঙ্গীকারবদ্ধ হতে বাধ্য করেছিলেন যাতে ১৮ বছরের নিচে মেয়ের ও ২১ বছরের নিচে কোনো ছেলের বিয়ে না করান। তাঁর জন্মভিটা খানাকুল থেকে এটার বাস্তবায়ন শুরু। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যসাগর এবং বেগম রোকেয়া এই অভিশাপ থেকে মুক্তির জন্য গঠনমূলক সামাজিক আন্দোলনের ডাক দিয়েছিলেন। অতীতে বুড়োর সাথে ৯ বছরের শিশুর বিয়ে দিত পাষাণ্ড বাবামা টাকার বিনিময়ে। তাই বেগম রোকেয়া লিখেন

হুকুর হুকুর কাশে বুড়া হুকুর হুকুর কাশে/ নিকার নামে হাসে বুড়া ফুকুর ফুকুর হাসে।

নারীর মর্ম যাতনা লুকিয়ে আছে তাঁর এই সরল বাণীর মাঝে। উন্নত তথা শিক্ষিত সমাজের আড়ালে এই কুপ্রথা আজও বিরাজমান। এই বিষফোঁড়া উপড়ে ফেলতে বহুমাত্রিক কৌশল গ্রহণ জরুরি। সামাজিক রীতিনীতি মেনে সরকার কর্তৃক নির্ধারিত আইন অনুযায়ী বিবাহ রেজিষ্ট্রেশন সম্পন্নকরণ পূর্বক বিবাহ সনদ সংগ্রহ বাধ্যতামূলক করতে হবে। প্রতি উপজেলার স্কুলেকলেজে ছাত্রছাত্রীদের উপস্থিতিতে বাল্যবিবাহ প্রতিরোধের উপর সেমিনার, রচনা প্রতিযোগিতা ও উপস্থিত বক্তৃতার আয়োজন করে গণসচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। মূলত পরিবার থেকেই নিতে হবে পদক্ষেপ, সাথে থাকবে সরকার, স্থানীয় প্রশাসন ও বিভিন্ন শ্রেণিরপেশার লোকজন।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, বোয়ালখালী হাজী নুরুল হক ডিগ্রী কলেজ, চট্টগ্রাম।

পূর্ববর্তী নিবন্ধনকলের থাবা ও প্রশ্নবিদ্ধ শিক্ষার মান
পরবর্তী নিবন্ধঅগমেন্টেড রিয়ালিটি এবং ভার্চুয়াল রিয়ালিটি : বাংলাদেশে ব্র্যান্ড এনগেজমেন্টে জেন জি কে টার্গেট করার নতুন অস্ত্র