প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র ও বঙ্গবন্ধু মৎস্য হেরিটেজ হালদা নদী। প্রতি বছর বিশেষ সময়ে এ নদীতে রুই, কাতলা, মৃগেল ও কালিবাউস তথা কার্প জাতীয় মা মাছ ডিম ছাড়ে। সেই সময়টাকে তিথি ও স্থানীয় ভাষায় জো বলা হয়। বালুতে ভরাটের কারণে নাব্যতা হারাচ্ছে সেই হালদা। হালদা নিয়ে সরকারি–বেসরকারিভাবে মাতামাতি থাকলেও খননে কোনো উদ্যোগ নিচ্ছেন না কেউ। হালদাপাড়ের বাসিন্দা, ডিম সংগ্রহকারী, জনপ্রতিনিধি সবাই বলছেন, হালদা নদী খননে ব্যবস্থা না নিলে হারিয়ে যাবে নদীর প্রাকৃতিক পরিবেশ।
সরেজমিনে হালদাপাড়ের বাসিন্দা, ডিম সংগ্রহকারী ও জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নদীর অনেক স্থানে হাঁটু পানি, কোথাও কোমর পানি। শুষ্ক মৌসুমে নাব্যতা হারানো নদীর দুরবস্থা বেশি চোখে পড়ে। আগে ডিম সংগ্রহের মৌসুমে নব্বই থেকে একশ বিশ ফুট গভীরে নৌকার নোঙর ফেলা হতো। এখন তা ত্রিশ ফুটে এসেছে। স্বাভাবিক জোয়ারের পানি যে এলাকায় কখনো প্রবেশ করেনি, এখন জোয়ারের সাথে বৈরী আবহাওয়ায় ওইসব এলাকার রাস্তাঘাট, উঠান তলিয়ে যায়। এতে করে হালদাপাড়ে ক্ষেত–খামার প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। বিশেষ করে মরিচের চাষ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।
হালদাপাড়ের বাসিন্দা ও ডিম সংগ্রহকারী মো. লোকমান, মো. জাফর, আবু তৈয়্যব ও মো. শফি বলেন, যারা সবসময় হালদার খবর রাখেন তারা এসব বিষয়ে জানেন। হালদা নদী খননে ব্যবস্থা না নিলে মা মাছের ডিম ছাড়ার হাতেগোনা যে কয়টি কুম রয়েছে তাও ভরাট হয়ে যাবে। আর কুম বিলীন হলে কার্প জাতীয় মা মাছ ডিম ছাড়বে না। প্রাকৃতিকভাবে এক সময় হালদায় তাদের আগমন বন্ধ হয়ে যাবে। যার জন্য হালদা আজ দেশ ছাড়িয়ে বিশ্বে পরিচিত, সেই পরিচিতিও মুছে যাবে।
হালদাপাড়ের বাসিন্দা ও গড়দুয়ারা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সরোয়ার মোর্শেদ তালুকদার বলেন, হালদার উৎপত্তিস্থল পাহাড়। তাই প্রতিনিয়ত পাহাড়ের বালু হালদায় এসে পড়ছে। অন্যদিকে হালদা নদীর সাথে অনেকগুলো শাখা খালের সংযোগ রয়েছে। শাখা খালের বালু, আবর্জনা এবং বর্জ্য এসে পড়ছে হালদায়। ড্রেজার দিয়ে খননে হালদা ও তার পাড় ক্ষতিগ্রস্ত হবে, তা সত্য। কিন্তু প্রশাসন পরিকল্পনা করে যদি ম্যানুয়ালি তথা ডুবুরি দিয়ে বালু উত্তোলনের ব্যবস্থা করে তাহলে ক্ষতি কোথায়? এতে হালদা যেমন গভীরতা ফিরে পাবে, তেমনি কিছু বেকার মানুষের কর্মসংস্থান হবে। একইসাথে প্রশাসন নিয়ন্ত্রণ করলে সরকারি কোষাগারে টাকা জমা পড়বে।
উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা মো. ফারুক ময়েদুজ্জামান বলেন, বৃষ্টি হলেই হালদা নদীতে পাহাড়ি উজানের ঘোলা পানি অর্থাৎ পাহাড়ি বালুকণা নেমে প্রবল স্রোতের সৃষ্টি হয়। এই নদী লম্বা ও সরু হওয়ায় পাহাড় থেকে নেমে আসা বালুকণা মিশ্রিত পানিতে হালদা ধীরে ধীরে ভরাট হয়। তিনি মনে করেন, ম্যানুয়ালি তথা ডুবুরি দিয়ে বালু উত্তোলন করা হলে হালদা নদীর তেমন ক্ষতি হবে না। ইতোমধ্যে অনেক জায়গায় চর দেখা যাচ্ছে। সেখানে যদি এ পদ্ধতি ব্যবহার করে বালু উত্তোলন করা হয় তাহলে হালদার ক্ষতি নয়, উপকার হবে। তবে এসবের অনুমতি জেলা প্রশাসক মহোদয়ের হাতে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক সরকারি কর্মকর্তা বলেন, ২০০৭–৮ সালের দিকে কর্ণফুলী নদীতেও এমন পরিস্থিতি ছিল–বালু উত্তোলন করলে ক্ষতি হবে। পরে যখন দেখা গেল ভরাট হয়ে বড় ধরনের ক্ষতি হচ্ছে, তখন কর্তৃপক্ষ বালু মহাল ঘোষণা করে। যা এখনো পর্যন্ত জারি আছে। একসময় হালদার অবস্থাও সেইরকম হবে। সময় থাকতে হালদা নিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।
হাটহাজারী উপজেলা নির্বাহী অফিসার এবিএম মশিউজ্জামান বলেন, ম্যানুয়ালি বালু উত্তোলন অনেক জায়গায় চলছে; তবে তা প্রশাসনের আওতামুক্ত। যদি পরিকল্পনা করে সরকারিভাবে করা হয় তাহলে হালদা তার গভীরতা ফিরে পাবে।
সম্প্রতি মৎস্য অধিদপ্তরের আয়োজনে রাউজান উপজেলায় হালদা বিষয়ক কর্মশালায় এ বিষয়সহ অনেকগুলো বিষয় তুলে ধরেছেন হালদার সাথে জড়িত অনেকে।
জেলা মৎস্য কর্মকর্তা শ্রীবাস চন্দ্র চন্দ বলেন, যদি মাটিতে কম্পন না হয়, পাড় না ভাঙে, একইসাথে পরিবেশের বিপর্যয় না ঘটে, তাহলে ম্যানুয়ালি বালু উত্তোলন করা যায়। হালদার নাব্যতা রক্ষার্থে এ নিয়ে অনেকেই এখন চিন্তাভাবনা করছেন। তবে পরিবেশ সমীক্ষা করে এগোতে হবে। এজন্য বিশেষজ্ঞদের মতামত লাগবে।
হালদা গবেষক ও চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক কলেজের জীববিজ্ঞান বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ড. শফিকুল ইসলাম বলেন, জোয়ার–ভাটার নদীর অন্যতম সমস্যা হচ্ছে বালু/পলি জমা। পলি জমে নদীর নাব্যতা কমে যায়। পানিপ্রবাহ পরিবর্তন, বিভিন্ন জলজ প্রাণীর বাসস্থান ধ্বংস, কুম ভরাট, জীববৈচিত্র্য হ্রাস, পলি দূষণ, পানির গুণাবলী নষ্ট ও পানিতে দ্রবীভূত অঙিজেনের পরিমাণ কমে যায়। জোয়ার–ভাটার নদী হালদা ও এর শাখা খালের বিভিন্ন স্থানে বালু জমে নদীর গভীরতা কমে গেছে। কুম ভরাট, কার্পজাতীয় মাছের প্রজনন স্থান পরিবর্তন ও পানিপ্রবাহ কমেছে। তাই হালদা নদীকে কার্পজাতীয় মাছ, গাঙ্গেয় ডলফিন এবং জলজ প্রাণীর নিরাপদ বাস্তুতন্ত্রে পরিণত করার লক্ষ্যে হালদায় নাব্যতা বৃদ্ধির জন্য বালু জমাট স্থান থেকে ম্যানুয়্যালি প্রয়োজন মতো বালু অপসারণ করতে হবে।
হালদা গবেষক ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. মঞ্জুরুল কিবরিয়া ম্যানুয়ালি বালু উত্তোলনকে সমর্থন করে বলেন, এ পদ্ধতিতে বালু উত্তোলনে যেমন হালদার গভীরতা ফিরে আসবে, তেমন বালুর চাহিদা পূরণ হবে। পাশাপাশি যদি হালদার শাখা খালগুলোর প্রতিবন্ধকতা সরিয়ে দেওয়া হয় তাহলে শাখা খালের স্বাভাবিক স্রোতে হালদায় পাহাড়ের জমানো পলিমাটি সরে যাবে।
তিনি বলেন, ম্যানুয়ালি বালু উত্তোলনের নির্দেশনা অনেক আগে থেকেই দেওয়া আছে, কিন্তু বাস্তবায়ন নাই। নির্দেশনা যথাযথ বাস্তবায়ন হলে হালদার নাব্যতা রক্ষা পাবে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রুইজাতীয় মাছের প্রকৃত বংশধরদের বাঁচিয়ে রাখার জন্য হালদা নদীর প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য সংরক্ষণের বিকল্প নাই। হালদা নদীকে বলা হয় চট্টগ্রামের ‘লাইফ লাইন’। চট্টগ্রাম শহরে প্রায় ৬০ থেকে ৭০ লাখ মানুষ বসবাস করে। তাদের চাহিদা মেটানোর জন্য চট্টগ্রাম ওয়াসা দিন–রাত যে পানি সরবরাহ করে, তার মধ্যে প্রতিদিন ১৮ কোটি লিটার পানি হালদা থেকে সংগ্রহ করা হয়। চট্টগ্রাম শহর গড়ে উঠেছে কর্ণফুলী নদীর পাশে। এর এক পাশে বঙ্গোপসাগর। এর মধ্যে ‘ফ্রেশ ওয়াটার সোর্স’ হচ্ছে হালদা নদী। কোনো কারণে যদি হালদা বিপন্ন হয়, তাহলে চট্টগ্রামের মানুষের জীবনযাত্রা বিপন্ন হবে।