প্রায় সময়ে আমরা শুনি বা দেখি অগ্নুৎপাতের ঘটনা। যেখানে হাজার হাজার ঘরবাড়ি, মানুষজনের ধ্বংসস্তূপের কথা শুনি। এখনও কানাডার ঐতিহাসিক শহর জাসপারের অর্ধেক অংশ পুড়ে মিশে গেছে। আলবার্তা শহরের পাশাপাশি কলম্বিয়ার বিভিন্ন জায়গাতেও দাবানল জ্বলছে। ছড়িয়ে পড়েছে এই দাবানল।
এমনই এক দাবানলের ঘঁনা– ওমায়রা সানচেজকে হয়তো চিনবেন না। আবার চিনতেও পারেন। নামে নয়, ছবি দেখে। নিষ্পাপ সে ছবি একসময় ঝড় তুলেছিল মানুষের হৃদয়ে। কত মানুষ যে নীরবে জল ফেলেছেন ওই মেয়েটার জন্য! বিপদ যখন আসে, অকস্মাতই আসে। আগাম কোনও ইঙ্গিত থাকে না।
১৯৮৫ সালের ১৩ নভেম্বরের ঘটনা। কলম্বিয়ার শহর আর্মেরোর আকাশ সকাল থেকেই মেঘলা। প্রায় বিকেল তখন। বাবা আলভেরো ও ভাই আলভেইরোর সঙ্গে জমি থেকে তুলে আনা ধান গোলায় তুলছিল তেরো বছরের বালিকা ওমায়রা সানচেজ । মা মারিয়া আলেইডা গিয়েছিলেন বাড়ি থেকে দূরে কলম্বিয়ার রাজধানী বোগোটায়। সেখানে তিনি নার্সের কাজ করেন।
হঠাৎ পশ্চিম দিক থেকে ভেসে এসেছিল মেঘের গর্জনের মতো গুরুম গুরুম আওয়াজ। চমকে উঠেছিল ওমায়রা। মেঘ ডাকার আওয়াজ ভেবে আবার মন দিয়েছিল কাজে। তাড়াতাড়ি সব ধান গোলায় তুলে বাবা ও ভাইয়ের সঙ্গে বাড়িতে ফিরে এসেছিল ওমায়রা।
যে শব্দকে মেঘের আওয়াজ ভেবেছিল ওমায়রা, আসলে সেটি ৭৯ বছর পর জেগে ওঠা বিশ শতকের দ্বিতীয় ভয়াবহ অগ্ন্যুপাতের ঘটনা। যা ঘটে কলম্বিয়ার নেভাদো দেল রুইজ আগ্নেয়গিরি থেকে। ১৯৮৫ সালের ওই অগ্ন্যুৎপাত, আরমেরো ট্র্যাজেডি নামে বিবেচিত। কারণ আরমেরো শহরেই মারা যায় ২০ হাজারের মতো মানুষ। যে আগ্নেয়গিরিকে স্থানীয়রা চেনেন ‘ঘুমন্ত সিংহ’ নামে।
১৯৮৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসেও একবার উশখুশ করে উঠেছিল নেভাডো ডেল রুইজ আগ্নেয়গিরি। কলম্বিয়ার ইন্সটিটিউট অফ মাইনিং অ্যান্ড জিওলজি অক্টোবর মাসেই বানিয়ে দিয়েছিল আসন্ন ভয়াবহ বিপর্যয়ের একটি ম্যাপ। সেই ম্যাপে বলাও হয়েছিল সব থেকে ক্ষতিগ্রস্ত হতে চলেছে আর্মেরো শহর। কান দেয়নি কলম্বিয়া সরকার।
প্রকৃতির কোপে পড়ে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় নেভাদো দেল রুইজ আগ্নেয়গিরির নিকটবর্তী একাধিক গ্রাম। তবে এর থেকেও মর্মান্তিক ছিল এই ঘটনায় ওমায়রার মৃত্যু।
৬৯ বছর শান্ত থাকার পরে ১৯৮৫ সালের ১৩ নভেম্বর নেভাদো দেল রুইজ আগ্নেয়গিরি থেকে অগ্ন্যুৎপাত হয়। দুর্যোগের দু’মাস আগে সতর্কবার্তা পাওয়া সত্ত্বেও সে দেশের সরকার আগ্নেয়গিরির কাছাকাছি বসবাসরত মানুষকে সরিয়ে নিতে এবং সুরক্ষা দিতে ব্যর্থ হয়। অগ্ন্যুৎপাতের ফলে আশপাশের ১৩টি গ্রাম ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
তবে এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল আরমোরো শহর। এ শহরের সেই সময় মোট জনসংখ্যা ছিল প্রায় ২৯ হাজার।
ঘড়িতে তখন রাত ৯.০৯।
বিকট আওয়াজে কেঁপে উঠেছিল আশেপাশের প্রায় একশো কিলোমিটার এলাকা। এক ভয়াবহ বিস্ফোরণে উড়ে গিয়েছিল আর্মেরো শহর থেকে মাত্র ৪৮ কিলোমিটার দূরে থাকা নেভাডো ডেল রুইজের তুষারাচ্ছাদিত চূড়া। আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখ থেকে বেরিয়ে এসেছিল উত্তপ্ত লাভার স্রোত। লাল রঙে ঢেকে গিয়েছিল আকাশ।
ফুটন্ত লাভার উত্তাপে গলে গিয়েছিল আগ্নেয়গিরির চূড়ায় থাকা বরফ ও পাদদেশে থাকা হিমবাহগুলি। বিশাল জলরাশি ছুটে চলেছিল গুয়ালি নদীর খাত ধরে। সঙ্গে নিয়ে চলেছিল হাজার হাজার বোল্ডার, পাথর, গাছ ও কাদা। ঢেউগুলি ছুটে চলেছিল চোদ্দটি জনপদের দিকে।
এ পানি নদীর তীরের পাথর এবং মাটির সঙ্গে মিশে সমতল এলাকায় বিপর্যয়ের সৃষ্টি করে। আগ্নেয়গিরির গরম লাভার সঙ্গে তুষারগলা পানি এবং কাদার মিশ্রণ ‘লাহার’ নামে পরিচিত। লাহারের স্রোত প্রবেশ করে টলিমার আরমেরো শহরেও। আরমেরোর প্রায় ৭০ শতাংশ বাসিন্দা লাহারের কবলে পড়ে মারা যান। তাই এ ঘটনাই ‘আরমেরো ট্র্যাজেডি’ নামে পরিচিত।
কলম্বিয়ান মেয়ে ওমায়রা ১৯৭২ সালের ২৮ আগস্ট জন্মগ্রহণ করে।
মারা গেছে ১৬ নভেম্বর, ১৯৮৫ সালে।
স্থানীয় একটি স্কুলে পড়াশোনা করত ওমায়রা।
যে রাতে লাহার আরমেরোতে আঘাত হানে, সেই রাতে ওমায়রা তার বাবা, ভাই এবং ফুফুর সঙ্গে বড়িতেই ছিল।
প্রথম ঢেউটি, আঘাত হানার আগেই অন্ধকারে ডুবে গিয়েছিল আর্মেরো। শহরবাসীদের কানে আসছিল ভয়ানক কিছু আওয়াজ। কিন্তু কী হচ্ছে, কেউ কিছু বুঝতে পারছিল না। তাই টর্চ নিয়ে বাড়ির বাইরে বেরিয়ে এসেছিল হাজার হাজার মানুষ। বাবা, ভাই ও কাকিমার সঙ্গে বাড়ির ছাদে উঠে পড়েছিল ওমায়রা। অন্ধকারে জোনাকির মত ছোটাছুটি করতে থাকা টর্চগুলি ছাড়া অন্য কিছু নজরে আসছিল না তখন।
আর্ত চিৎকার ভেসে এসেছিল চারদিক থেকে। শহরবাসীরা কিছু বুঝে ওঠার আগেই, আর্মেরোকে আঘাত করেছিল পাথর, গাছের গুঁড়ি বয়ে আনা কাদার প্রথম ঢেউটি। ওমায়রাদের বাড়ির ছাদের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া কুড়ি ফুট উচ্চতার ঢেউটি ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছিল ওমায়রার বাবা ও ভাইকে।
ভেঙে পড়া ছাদের বিম ও লোহার কাঠামোয় আটকে গিয়েছিল ওমায়রা ও কাকিমা আলেইডা। ওমায়রাকে বুকে আঁকড়ে ধরে ছিলেন কাকিমা। কিন্তু কাদার ঢেউ ক্রমশ গিলে নিতে শুরু করেছিল কাকিমাকে। কাদার স্রোতের নিচে তলিয়ে যেতে যেতে দুই হাত দিয়ে কাকিমা ধরে ফেলেছিলেন ওমায়রার পা দু’টি। ঘটনার আকস্মিকতায় জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিল ওমায়রা।
বৃষ্টি শুরু হয়েছিল আবার। বৃষ্টির ছাট গায়ে লাগায় জ্ঞান ফিরে এসেছিল ওমায়রার। সে বুঝতে পেরেছিল, থিকথিকে কাদার মধ্যে গলা অবধি ডুবে আছে। কাদার নিচে কোথাও আটকে গিয়েছে হাত পা। চারদিকে থেকে ভেসে আসছিল আর্তনাদ। কিন্তু কিছুক্ষণ পরে সেই আর্তনাদও আর শোনা যাচ্ছিল না। বিধ্বস্ত আর্মেরোর বুকে নেমে এসেছিল নীরবতা। আর্মেরো তখন মৃত্যুপুরী।
ঘটনার কয়েক ঘণ্টা পরে উদ্ধারকারী এবং স্বেচ্ছাসেবকেরা ঘটনাস্থলে পৌঁছে ওমায়রাদের বাড়ির ধ্বংসস্তূপ সরিয়ে যা দেখে, তা দেখে তারাও মর্মাহত হয়ে পড়ে।
উদ্ধারকারীরা দেখেন, ওমায়রা কোনোরকমে তার হাত জলকাদার ওপরে তুলে রয়েছে। উদ্ধারকারীদের দেখেই হাত তুলে সে জানান দেয় যে, সে তখনও জীবিত রয়েছে। উদ্ধারকারীরা ওমায়রাকে সাহায্য জন্য ছুটে এলেও খুব শিগরিরই বুঝতে পারেন, তাকে উদ্ধার করা অত সহজ নয়। উদ্ধারকারীরা বুঝতে পারেন, ওমায়রার কোমর থেকে নিচের অংশ পানির তলায় থাকা কংক্রিটের নিচে চাপা পড়েছে।
পরবর্তীতে উদ্ধার কর্মীরা ওকে বাঁচাতে চেষ্টা করে, ওর পা কংক্রিটের মতো বাঁকানো হয় বের করে আনার জন্য কিন্তু তারা বুঝতে পারে পা ছিঁড়ে ফেলা ছাড়া ওকে মুক্ত করা অসম্ভব। কলম্বিয়ার সরকারের কাছে উদ্ধার করার সরঞ্জাম চেয়েও অস্ত্রোপচারের সরঞ্জামের অভাবে ওকে উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি।
ওমায়রাকে উদ্ধার করার পুরো প্রক্রিয়া চলাকালীন জার্মান সাংবাদিক সান্তা মারিয়া ব্যারাগানের সঙ্গে কথা বলে। মারিয়ার সব প্রশ্নের উত্তর দেয়ার পাশাপাশি সে গান গেয়ে, লজেন্স খেয়ে এবং সোডা পান করে নিজেকে উজ্জীবিত রাখার চেষ্টা করে। তবে আটকা পড়ার দ্বিতীয় দিনে ধীরে ধীরে নিস্তেজ হতে শুরু করে ওমায়রা। তৃতীয় দিনে ভুল বকতেও শুরু করে সে। বারংবার বলতে থাকে একটাই কথা ‘আমি স্কুলে দেরি করে পৌঁছাতে চাই না।’ এমনকি স্কুলে আসন্ন গণিত পরীক্ষার কথাও বলে সে।
পানি এবং ধ্বংসস্তূপের চাপে ধীরে ধীরে কালো হতে থাকে। সময় আরও গড়ালে যন্ত্রণায় কাতরাতে শুরু করে ওমায়রা। অনেক চেষ্টার পরও যখন উদ্ধারকারী এবং চিকিৎসকেরা তাকে উদ্ধার করতে ব্যর্থ হন, তখন তারা সিদ্ধান্ত নেন যে, ওমায়রাকে শান্ত রাখা এবং তাকে মরতে দেয়াই হবে সব থেকে মানবিক কাজ।
ওমায়রা ততক্ষণে জেনে গিয়েছে তার পরিণতির কথা। বাঁচার আকুতি ছেড়ে, সে তখন হাসছে গাইছে খাচ্ছে… আবার গলা জলে ডুবে থেকেই, জটলা হয়ে থাকা সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলছে। এভাবেই একটা সময় আসে, মৃত্যুর কোলে ঢোলে পড়ে সেই মেয়ে। ওমায়রার মৃত্যুর ঘণ্টাখানেক আগে ছবিটি তুলেছিলেন ফোটোগ্রাফার ফ্রাঙ্ক ফোরনিয়ার। তাঁর ফ্রেমবন্দি নিষ্পাপ মুখের এই ছবিটি আলোড়ন ফেলেছিল বিশ্বজুড়ে। চারপাশ থেকে আন্তর্জাতিক সাহায্য আসতে শুরু করে কলম্বিয়ায়। ওমায়রা নিজে মরে অন্যদের বাঁচার একটা ব্যবস্থা করে দিয়ে যায়।
মৃত্যুর সামনে দাঁড়িয়ে মৃত্যুকে এমনভাবে বরণ করতে পারে এমন ক’জন!