কক্সবাজারের চকরিয়ার ডুলাহাজারায় অবস্থিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্কে বার্ধক্যজনিত নানা সমস্যায় ভোগার পর গত বুধবার পুরুষ সিংহ সোহেল পাড়ি জমিয়েছেন পরপারে। এবার সেই পদাঙ্ক অনুসরণ করতে যাচ্ছে পার্কের আরো কয়েকটি বন্যপ্রাণী।
পার্ক কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন, যে কোনো মুহূর্তে মারা যেতে পারে এমন তালিকায় রয়েছে একটি করে হাতি, বিরল ও বিপন্ন প্রজাতির লামচিতা এবং আসামী বানর অন্যতম। তাই বয়সের ভারে আক্রান্ত এসব বন্যপ্রাণীকে পার্কের বন্যপ্রাণী হাসপাতালের কোয়ারেন্টাইন শেডে রেখে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা দেওয়াসহ যত্ন-আত্তি করা হচ্ছে।
সরজমিন সাফারি পার্কের এসব প্রাণীর বেষ্টনী এবং বন্যপ্রাণী হাসপাতালে গিয়ে দেখা গেছে, স্ত্রী হাতি রংমালার চোখের দুই কোনে দুটি টিউমার। তন্মধ্যে একটি ফেটে পানি ঝরছে। এজন্য হাতিটির ক্ষতস্থানে ড্রেসিং করার জন্য হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে। বয়সের ভারে এতটাই কাবু হয়েছে যে, হাতিটি ঠিকমত খাবারও মুখে নিতে পারছে না।
অসুস্থ এই হাতিটির মাহুত মোহাম্মদ হোছাইন বলেন, এক বছর ৭ মাস আগে হাতিটিকে পার্কে প্রেরণ করা হয়। এখানে আনার আগে থেকেই হাতিটির ওপর বেশ ধকল গেছে। কারণ ব্যক্তি মালিকানাধীন এই হাতিটিকে দীর্ঘসময় ব্যবহার করেছিল চাঁদাবাজচক্র। সর্বশেষ এই হাতিকে ব্যবহার করে চট্টগ্রাম মহানগরীতে চাঁদাবাজি করার সময় বনবিভাগ অভিযান চালিয়ে হাতিটিকে উদ্ধারের পর পার্কে প্রেরণ করে।
মরণাপন্ন অবস্থায় রয়েছে বিলুপ্তির ঝুঁকিতে থাকা মহাবিপণ্ন বন্যপ্রাণী পার্কের একমাত্র লামচিতাটি। এটির বয়সও ইতোমধ্যে ১৫ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। স্ত্রী এই লামচিতাটির গায়ের লোমও সিংহভাগ ঝরে পড়েছে।
বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্কের বন্যপ্রাণী চিকিৎসক মো. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, নারী হাতি ‘রংমালা’, লামচিতা ও আসামী বানরের আয়ুষ্কাল অনেক আগেই শেষ হয়েছে। পার্কের আবদ্ধ পরিবেশে থাকাসহ নিয়মিত খাবার দেওয়া এবং পরিচর্যায় তারা বাড়তি সময় বাঁচলেও বর্তমানে বয়সের ভার তাদেরকে তাড়া করছে।
পার্কের ভারপ্রাপ্ত তত্ত্বাবধায়ক মো. মাজহারুল ইসলাম বলেন, পার্কের প্রতিটি প্রাণীকে যথেষ্ট যত্ন-আত্তি করা হয়। নিয়মানুযায়ী তাদের খাবারও দেওয়া হয়। কিন্তু চলমান বার্ধক্যের কারণে তারা নানা রোগে ভুগছে। কিছুদিন পর পর তাদের স্বাস্থ্যও পরীক্ষা করানো হয় বন্যপ্রাণীর বড় ডাক্তার দ্বারা। পাশাপাশি বার্ধক্যজনিত এসব প্রাণীর তালিকা তৈরি করে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকেও আগে থেকে অবহিত করা হয়েছে। সর্বশেষ গেল জানুয়ারিতেও ছকাকারে তথ্যাদি প্রেরণ করার পর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা সরজমিন এসব প্রাণীর বিষয়ে অবগত হয়েছেন।
প্রজননে বাধা প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ : পার্ক কর্তৃপক্ষ বলছেন, যে পরিবেশে এই পার্ক প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে, বর্তমানেও সেই পরিবেশ বজায় থাকায় তা বন্যপ্রাণীর প্রজননের ক্ষেত্রে যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। আফ্রিকান প্রজাতির জেব্রা, ওয়াইল্ডবিষ্টের প্রজনন হওয়ার বিষয়টি প্রকৃষ্ট উদাহরণ হিসেবে ধরা যায়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পার্কের সাবেক এক কর্মকর্তা বলেন, করোনাকালীন দীর্ঘসময় পার্কে দর্শনার্থীদের গমণাগমণ না থাকায় একের পর বন্যপ্রাণীর প্রজনন হয়। সেই তুলনায় এসব প্রাণীর জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হয় না। যার কারণে বিকল্প উপায়ে এসব প্রাণীর নিয়মিত খাবারের সংস্থান করতে হয়।
তবে প্রজনন হওয়ার পর প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হয় না, এই বিষয়টিকে একেবারে নাকচ করে দিয়ে পার্কের ভারপ্রাপ্ত তত্ত্বাবধায়ক মো. মাজহারুল ইসলাম বলেন, প্রতিটি প্রাণীর বিপরীতে রেশন ব্যবস্থা চালু রয়েছে। সেই অনুযায়ী প্রত্যেক প্রাণীকে নিয়মিত খাবার দেওয়া হয়ে থাকে।
হাতি শাবক যমুনার পেছনে প্রতিদিন ব্যয় ৪৭০০ টাকা : গত বছরের মার্চ মাসে কঙবাজার দক্ষিণ বনবিভাগের টেকনাফের সংরক্ষিত বনাঞ্চলে পাহাড় থেকে ছিঁটকে পড়ে মারা পড়ে একটি মাদী হাতি। কিন্তু সেই হাতি মারা যাওয়ার কয়েকদিন আগেই প্রসব করে একটি শাবকের। কিন্তু মা মারা যাওয়ার পর দুগ্ধপোষ্য সেই শাবকটির অবস্থা হয় শোচনীয়। সেই পরিস্থিতিতে বনবিভাগ শাবকটিকে উদ্ধারের পর প্রেরণ করে বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্কে। তখন শাবকটির একটি পায়ে ক্ষত এবং ওজন ছিল প্রায় ১০৭ কেজিতে। বর্তমানে সেটির ওজন ৪৫০ কেজি।
সেই শাবকটির বর্তমান অবস্থা জানতে চাইলে মাজহারুল ইসলাম বলেন, বাচ্চা হাতিটিকে পার্কে আনার পর প্রয়োজনীয় সেবা এবং নিয়ম করে প্রতিদিন ১০ প্যাকেট ল্যাকটোজেন দুধ, ৮০টি কলার পাশাপাশি প্রতিসকালে দুধ-দইয়ের সাথে জাওভাত করে খেতে দিতে হয়। এসব খাবারের বিপরীতে প্রতিদিন বরাদ্দ দিতে হয় ৪৭০০ টাকা। এই হাতি শাবকের নাম ‘যমুনা’।