চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের (চসিক) গৃহীত নগরের বহাদ্দারহাট বারইপাড়া থেকে কর্ণফুলী নদী পর্যন্ত ২ দশমিক ৯ কিলোমিটার দীর্ঘ নতুন একটি খাল খনন প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয় ২০২৪ সালের জুন মাসে। তবে ওই সময় পর্যন্ত প্রকল্পের ভৌত ও আর্থিক অগ্রগতি শেষ হয়নি। মেয়াদ না থাকায় গত ২০২৪–২০২৫ অর্থবছরে প্রকল্পের বিপরীতে বরাদ্দকৃত অর্থও ছাড় করেনি মন্ত্রণালয়। ফলে প্রকল্পটির কাজ শেষ করা নিয়ে এক ধরনের অনিশ্চয়তা তৈরি হয়।
এ অবস্থায় ১৯ কোটি ৪১ লাখ টাকা ব্যয় কমিয়ে দুই বছর মেয়াদ বৃদ্ধি করে প্রকল্পটির সংশোধিত (তৃতীয়) উন্নয়ন প্রস্তাবনা (ডিপিপি) অনুমোদন দিয়েছে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক)। গতকাল একনেকের চেয়ারপার্সন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে এনইসি সম্মেলন কক্ষে অনুষ্ঠিত একনেক সভায় এ অনুমোদন দেয়া হয়। এর আগে গত ৬ ফেব্রুয়ারি অনুৃষ্ঠিত পিইসি সভায় বিভিন্ন শর্ত প্রতিপালন সাপেক্ষে প্রকল্পটি অনুমোদনের সুপারিশ করা হয়।
চসিকের প্রকৌশল বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, সংশোধিত ডিপিপি’তে প্রকল্পটির ব্যয় ধরা হয়েছে ১ হাজার ৩৪৩ কোটি ২১ লাখ টাকা। যা পূর্বে ছিলে ১ হাজার ৩৬২ কোটি ৬২ লাখ টাকা। সংশোধিত ডিপিপি অনুমোদনের ফলে প্রকল্পটির আওতায় নতুন করে ৮ হাজার ৪৯৬ বর্গকিলোমিটার জায়গায় একটি ‘মেইনটেনেন্স ইয়ার্ড’ও নির্মাণ করা হবে। এছাড়া সংশোধিত ডিপিপি অনুযায়ী প্রকল্পটির আওতায় ২ হাজার ৭৭ দশমিক ৫২ ডেসিমেল ভূমি অধিগ্রহণ, সাড়ে ৫ হাজার মিটার ড্রেন নির্মাণ, ৫ হাজার ৮০০ মিটার রাস্তার উন্নয়ন, সাড়ে ৫ হাজার মিটার প্রতিরোধ দেয়াল, ২ লক্ষ ৮৪ হাজার ৮৮১ ঘনমিটার মাটি কাটা, ২৬ হাজার ১০০ ঘনমিটার বালি ভরাট, ১৬৯ মিটার আরসিসি ব্রিজ নির্মাণ এবং সাড়ে ৫ হাজার মিটার রিটেইনিং ওয়াল ও সিঁড়ি নির্মাণ করা হবে। প্রকল্পটির ডিপিপি সূত্রে জানা গেছে, খালটি বারইপাড়াস্থ চাক্তাই খাল থেকে শুরু করে শাহ্ আমানত রোড হয়ে নুর নগর হাউজিং সোসাইটির মাইজপাড়া দিয়ে পূর্ব বাকলিয়া হয়ে বলির হাটের পাশে কর্ণফুলী নদীতে গিয়ে পড়বে। এ খালের প্রস্ত ৬৫ ফুট।
সিটি মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন আজাদীকে বলেন, বাকলিয়াসহ বড় একটি এলাকার জলাবদ্ধতা নিরসনের জন্য বারইপাড়া খালটি অনেক গুরুত্বপূর্ণ। ১৯৯৫ সালের ড্রেনেজ মাস্টার প্লানের প্রস্তাবের আলোকে এ খাল খনন করার খুব জরুরি। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক যারা দায়িত্বে ছিল তারা নির্দিষ্ট সময়ে এ খালের কাজ শেষ করতে পারেননি। প্রকল্পটির কাজ বন্ধই ছিল এক প্রকার। আমি দায়িত্ব নেয়ার পর কাজের গতি বৃদ্ধি পেয়েছে। সংশোধিত প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা উন্নতকরণের মাধ্যমে জলাবদ্ধতা হ্রাসকরণ এবং উক্ত খালের দুই পাড়ে ওয়াকওয়ে নির্মাণের মাধ্যমে চট্টগ্রামবাসীর নাগরিক সুবিধাদি বৃদ্ধি পাবে। আগামী জুন পর্যন্ত মেয়াদ থাকলেও আমার টার্গেট এর আগেই কাজ শেষ করে ফেলা।
প্রকল্প পরিচালক ও চসিকের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো. ফরহাদুল আলম আজাদীকে বলেন, প্রকল্পের অগ্রগতি হয়েছে ৮৫ শতাংশ। প্রকল্পের মূল অংশ খাল খনন শেষ। ৯টি ব্রিজের মধ্যে ৮টির শেষ হয়েছে, একটির কিছু অংশ বাকি আছে।
চসিক সূত্রে জানা গেছে, ২০১৪ সালের ২৪ জুন ২৮৯ কোটি ৪৪ লাখ চার হাজার টাকায় বারইপাড়া খাল খনন প্রকল্পটি একনেক সভায় অনুমোদন পেয়েছিল। পরবর্তীতে কাঙ্খিত বরাদ্দ না পাওয়ায় প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করতে পারেনি চসিক। এরপর ২০১৮ সালের ৭ নভেম্বর সংশোধন করে প্রকল্পটি এক হাজার ২৫৬ কোটি ১৫ লাখ টাকায় চূড়ান্ত অনুমোদন দেয় একনেক। পরবর্তীতে ২০২২ সালের ১৯ এপ্রিল প্রকল্প ব্যয় বাড়িয়ে ১ হাজার ৩৬২ কোটি ৬২ লাখ টাকায় অনুমোদন দেয়া হয়। প্রকল্পটির মেয়াদ ধরা হয় ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত। গতকাল অনুমোদিত সংশোধিত ডিপিপিতে ২০২৬ সালের জুন পর্যন্ত মেয়াদ বৃদ্ধি করা হয়।
জানা গেছে, ২০২০ সালের ২৮ জানুয়ারি তৎকালীন সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন ওয়াইজ পাড়া এলাকায় স্কেভেটর দিয়ে মাটি কেটে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকল্পটির উদ্বোধন করেন। তবে করোনার প্রকোপ বৃদ্ধি পেলে ওই সময় কাজ বন্ধ হয়ে যায়। পরবর্তীতে ২০২১ সালের ২১ সেপ্টেম্বর থেকে প্রকল্পের কাজ শুরু করে চসিক। সর্বশেষ ২০২১ সালের ২৭ নভেম্বর প্রকল্পটির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন তৎকালীন স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম।
জানা গেছে, ১৯৯৫ সালে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের উদ্যোগে প্রণীত মাস্টার প্লানে নগরের জলাবদ্ধতা নিরসনে বিদ্যমান খালসমূহ প্রশস্থকরণের পাশাপাশি ৩টি নতুন খাল খননের প্রস্তাব করা হয়। পরবর্তীতে ২০০৭ সালের ১১ জুন রেকর্ড বৃষ্টিতে নগরীর এক–তৃতীয়াংশ ডুবে যাওয়ার পর অগ্রাধিকার ভিত্তিতে মাস্টার প্লানে প্রস্তাবিত নতুন খাল খননের সুপারিশ করেছিল বিশেষজ্ঞ কমিটি। প্রস্তাবিত খাল তিনটি হচ্ছে– মুরাদপুরের সিডিএ এভিনিউতে মির্জা খালের সমান্তরালে একটি খাল, বহদ্দারহাট খাজা রোডের সমান্তরালে কর্ণফুলী নদী পর্যন্ত একটি খাল ও শীতল ঝর্ণা খাল খননের সুপারিশ করা হয়। এরপ্রেক্ষিতে ২০১০ সালে প্রকল্পটি গ্রহণ করে চসিক। ওই হিসেবে ১৫ বছর এবং প্রথম অনুমোদনের (২০১৪ সালের ২৪ জুন) পর ১১ বছর পেরুলেও প্রকল্পটির কাজ শেষ হয়নি।