বছর দুয়েক বাদে ছেলেমেয়েকে কাছে পেয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়লেন বাবুল আক্তার। বাবার হাতের পরশ পেয়ে সন্তানরাও ছুঁয়ে দেখল বাবাকে। একপর্যায়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন স্ত্রী মাহমুদা আক্তার মিতুকে হত্যার অভিযোগে বিচারের মুখোমুখি হওয়া সাবেক এ পুলিশ কর্মকর্তা।
গতকাল চট্টগ্রামের তৃতীয় অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ মো. জসিম উদ্দিনের আদালতে সাক্ষ্যগ্রহণের নির্ধারিত দিন ছিল। এদিন বাবার সঙ্গে দেখা করতে আদালতে আসে মিতু–বাবুল দম্পতির ১৩ বছর বয়সী ছেলে এবং ৯ বছর বয়সী মেয়ে।
দুপুর ১২টার দিকে আদালতে হাজির করা হয় কারাবন্দি বাবুলকে। এর পরপরই তাদের দুই সন্তান আদালত কক্ষে আসে।
সঙ্গে বাবুলের স্বজন আরও দুই নারী ছিলেন। বাবুল তখন আদালত কক্ষের শেষ দিকের কাঠগড়ায়, হাতকড়া পরানো অবস্থায়। বাবুল এ সময় ছেলেমেয়ের মাথায় ও গায়ে হাত বুলিয়ে আদর করে দেন। ছেলেমেয়েরা গরাদের ফাঁক দিয়ে বাবার হাত ধরেছিল। খবর বিডিনিউজের।
একপর্যায়ে বাবুল আক্তার কান্নায় ভেঙে পড়েন। তখন ছেলেমেয়েও কান্না সামলে রাখতে পারেননি। বাবুলের কিশোর ছেলেটি বাবার কাঁধে, মাথায় হাত বুলিয়ে সান্ত্বনা দিচ্ছিল।
তখন অন্য মামলার কার্যক্রম চলছিল, আদালত কক্ষে থাকা পুলিশ সদস্যরা বাবুলের সন্তানদের আদালত কক্ষের বাইরে গিয়ে বসতে বলেন। এ সময় বাবুল আক্তার হাত তুলে বিচারকের অনুমতি নিয়ে বলেন, অনেকদিন আমার বাচ্চাদের দেখি না। এখন এসেছে, তাদের থাকতে দিচ্ছে না…। এটুকু বলেই কান্নায় ভেঙে পড়েন বাবুল।
তখন বিচারক অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ জসিম উদ্দিন বলেন, বাচ্চারা কাছে থাকুক। এখনও মামলা আমরা শুরু করিনি। এখন ওরা থাক। এরপর কাঠগড়ার এক প্রান্তে গিয়ে বাবুল দাঁড়ান। আর তার ছেলেমেয়েরা কাঠগড়ার সামনে রাখা একটি বেঞ্চে বসে।
বাবুল তার মেয়ের মাথায় হাত রাখেন, বাবার হাতের স্পর্শ পেয়ে মেয়ে হাউমাউ করে কাঁদছিল। বাবুলের ছেলের অপলক দৃষ্টি তখন বাবা–বোনের দিকে। তারপর বোনের মাথায় রাখা বাবার হাতের উপর সে নিজের হাতটি রাখে। বাবুলের কান্না দেখে একপর্যায়ে ছেলে বাবাকে টিস্যু এগিয়ে দেয়। নিজে চোখ মুছে ছেলের চোখও মুছিয়ে দেন বাবা বাবুল।
সাত বছর আগে চট্টগ্রামে প্রকাশ্য সড়কে এই ছেলের সামনেই গুলি চালিয়ে ও কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছিল তার মা মিতুকে। সেই খুনের প্রধান আসামি হিসেবে এখন বিচার চলছে তার বাবার।
তাদের তিনজনের কান্না আদালত কক্ষে উপস্থিত আইনজীবী, বিচার প্রার্থী, আদালতের কর্মচারী ও সংবাদকর্মীসহ সবাইকে স্পর্শ করে। পরে বেলা ১২টা ৫০ মিনিটের দিকে মামলায় সাক্ষ্যগ্রহণ শুরুর আগ মুহূর্তে মহানগর দায়রা জজ আদালতের পিপি আবদুর রশিদ আদালতের উদ্দেশে বলেন, যেহেতু ওরা (মিতু–বাবুলের সন্তান) মামলার সাক্ষী, তাদের বয়সও কম, এখন একজন সাক্ষী ঘটনার বিষয়ে বলবেন। তাই সাক্ষ্যগ্রহণের সময় তারা থাকতে পারবেন না।
এরপর বিচারক তাদের পিপির অফিস কক্ষে বা কোনো আইনজীবীর কক্ষে নিয়ে বসাতে বলেন। তারপর মামলায় তাদের নানা মোশাররফ হোসেনের সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়।
সাক্ষ্যগ্রহণ শুরুর আগে বাবুল আক্তার হাত তুলে বিচারকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে কিছু বলতে চান। অনুমতি পেয়ে তিনি বলেন, পিবিআইয়ের (পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন) লোকজন সাদা পোশাকে এই আদালত কক্ষে থাকে। গত তারিখে আইও ওমর ফারুক, সাইফুল ও মওদুদ বসে থেকে তথ্য নিয়েছে। পিবিআই এই মামলা তদন্ত করেছে। তারা থাকলে সাক্ষীরা ঠিকমতো সাক্ষ্য নাও দিতে পারে। গত তারিখে আদালত থেকে যাবার সময় তাদের লোক বলল, ‘যাই বলুন সাজা নিশ্চিত’। এভাবে হলে আমি ন্যায়বিচার বঞ্চিত হতে পারি।
এরপর বাবুলের আইনজীবী কামরুল ইসলাম সাজ্জাদ আদালতের উদ্দেশে বলেন, পিবিআই মামলা তদন্ত করেছে। তাদের কেউ কেউ এ মামলার সাক্ষীও। অন্য সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণের সময় তারা কীভাবে অবস্থান করবে?
বিচারক তৃতীয় অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ মো. জসিম উদ্দিন বলেন, এই মামলার অন্য কোনো সাক্ষী একজনের সাক্ষ্য চলাকালে এখানে থাকবে না। আজ তারা কেউ সাক্ষী দিক বা না দিক। ডিউটির কারণেও থাকবেন না। যদি কোনো সাক্ষী থেকে থাকেন, চলে যান।
তারপর মামলায় মোশাররফ হোসেনের সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়ে চলে বেলা ২টা ১০ মিনিট পর্যন্ত। এরপর বিরতি দিলে বাবুল আক্তার আবারও বিচারকের কাছে সন্তানদের সাথে কথা বলার অনুমতি প্রার্থনা করেন। বিচারক বিরতি পর্যন্ত সন্তানদের সঙ্গে বাবুলকে কথা বলার অনুমতি দেন। বিরতির পর বেলা ৩টা ১০ মিনিটে আবার সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়ে চলে সাড়ে ৪টা পর্যন্ত। দিনের কার্যক্রম শেষে আবার বাবাকে দেখতে আদালত কক্ষে এসেছিল দুই ছেলেমেয়ে। তাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাবুল যখন পুলিশ প্রহরায় আদালত কক্ষ থেকে বের হন, তখন তার দুই চোখে জল।
বাবুলের আইনজীবী গোলাম মাওলা মুরাদ বলেন, ২০২১ সালের মে মাসের গ্রেপ্তারের পর থেকে বাবুল আক্তার কারাগারে আছেন। এর মধ্যে তার সঙ্গে সন্তানদের দেখা হয়নি। সন্তানরা বাবাকে দেখতে চেয়েছিল। তাই পরিবারের আরও দুজন নারী সদস্যসহ তারা আজ এসেছিল। স্বাভাবিক নিয়মে আদালতে আসামিদের আনা হলে আত্মীয়স্বজনরা এসে দেখা করেন। আদালতও সন্তানদের সাথে কথা বলতে উনাকে অনুমতি দিয়েছেন। দীর্ঘদিন পরে ছেলেমেয়েদের কাছে পেয়ে তিনি আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েছিলেন।
মিতু হত্যাকাণ্ডের পর বাবুল প্রথমে ঢাকায় শ্বশুরবাড়িতে উঠলেও পরে দুই সন্তানকে নিয়ে আলাদা বাসায় চলে যান। দুই বছর আগে বাবুল গ্রেপ্তার হওয়ার পর থেকে তার পরিবারের কাছেই থাকছে শিশু দুটি। তাদের দেখা পেতে মামলার তদন্ত কর্মকর্তাদেরও বেশ কাঠখড় পোহাতে হয়েছিল। শিশু দুটির নানা–নানির অভিযোগ, তাদের নাতি–নাতনিদের দেখা তারা পাচ্ছেন না বাবুলের পরিবারের জন্য।