সেদিন গ্রাম থেকে এসএসসি পাসের পর ছেলেকে শহরের নামকরা কলেজে ভর্তির উদ্দেশে বাবা ছোট স্যুটকেসটি কাঁধে নিয়ে রওয়ানা দেয়। এই ছোট স্যুটকেসটির ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটও রয়েছে। ঠাকুরদাও ষাটের দশকে, এই স্যুটকেসটি কাঁধে নিয়ে তাঁর ছেলেকে সাতকানিয়া কলেজ হোস্টেলে ভর্তি করিয়েছিলেন।
পুরনো স্যুটকেসের দলিল–দস্তাবেজের ভাঁজে, হঠাৎ চোখে পড়ে, সযত্নে সুরক্ষিত কয়েকটি খাম। খাম খুললেই সামনে এল দুই যুগ আগেকার তারিখের চিঠি। লেখা কিছুটা চুপসে এলেও, বারবার পড়ার পরেও নতুন মনে হয়। স্নেহের বাবু….দিয়েই চিঠিগুলো শুরু। কলেজে ভর্তি করানোর পর মাঝেমধ্যেই বাবা এসব চিঠি পাঠাতেন। পহেলা বৈশাখ, নববর্ষ উপলক্ষে, বাড়িতে আসার জন্য চিঠি লিখেছেন বাবা। বাড়ি যেতেই হবে। হোস্টেল বন্ধু–বান্ধবদের সাথে, ডিসি হিল, সি আর বি তে ঘোরাঘুরির পরিকল্পনা ভেস্তে গেল। যাই হোক, হোস্টেল সুপার থেকে, ছুটি নিয়ে বাড়ি আসা হল।
মুখে বা আচরণে, স্নেহের আতিসহ্য না দেখালেও খাবারের তালিকায় থাকত প্রতি বেলায় দেশী কৈ, মাগুর থেকে শুরু করে দেশী মুরগী, পিঠা–পুলিসহ রকমারি আয়োজন। হোস্টেলের ফার্ম মুরগী, তেলাপিয়া বা রুই মাছ কোনোভাবেই এ কয়দিনে পাতে আসত না। হোস্টেল লাইফে যাওয়ার পুর্বে ঘরের খাবারের তালিকা এত সমৃদ্ধ ছিল না। আগে বাবার নিজস্ব ছক অনুযায়ী, লাইফস্টাইল ঠিকমত না মিললে ভালোমন্দ শুনতে হত। ব্যবহারে বিরক্তি প্রকাশ পেত। মাঝেমধ্যে ভয়ে তটস্থ থাকতে হত। কিন্তু হোস্টেল থেকে ১ম বারের মতো বাড়ি আসার পর পরিবেশ একেবারেই অন্যরকম হয়ে যায়। হোস্টেল থেকে আগমনে, বাড়ির ছোটরাও কয়েকদিনের জন্য বকাঝকার হাত থেকে রেহাই পেল। তারা কানে কানে এসে বলে, একদিন তারাও হোস্টেলে থেকে পড়াশোনা করবে। বাড়ির ছোটরা সহ সবার বাড়তি খাতির পেতে ভালোই লাগল। মায়ের ব্যস্ততার কথা তো আর বলার অপেক্ষা রাখে না। বলা হয়ে থাকে, স্নেহ–ভালোবাসা নিচের দিকে ধাবিত হয়। অসুখ–বিসুখ সহ যেকোনো সংকটকালে বাবাদের তৎপরতা ব্যতিব্যস্ততা চিরন্তন।
বৈশাখের কাঠফাটা রোদ, বিদ্যুৎ কালেভদ্রে আসে। শহরের বৈদ্যুতিক পাখায়, কিছুটা অভ্যস্ত হওয়ার পর, বাড়িতে প্রচণ্ড গরমে ত্রাহি অবস্থা। রক্তচক্ষু, আপাত রগচটা বাবার মুখের উপর ‘না’ করতে না পারার কারণে প্রায়শ অনুরোধে ঢেঁকি গিলতে হয়। ভেতরে ভেতরে ফুঁসলেও কিছুই করার থাকে না। রাতে বাবার সাথে ঘুমোতে যেতে হল। পড়াশোনার খবর, হোস্টেলের পরিবেশ, বন্ধু–বান্ধবদের খবরাখবর নিতে থাকে। আর বাবার হাতে হাতপাখা চলতে থাকে। বাবার নানান প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে কোনো একসময় ঘুমিয়ে পড়ি। বিদ্যুৎ আর সে রাতে আসেনি। তীব্র ভ্যাপসা গরমে, হাত পাখার বাতাস, গায়ে লাগে না বললেই চলে। তাই রাতে, নিয়মিত বিরতিতে ঘুম ভেঙে যাচ্ছিল। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে লক্ষ্য করি যখনই ঘুম ভাঙে তখনই হাতপাখা চলতেই থাকে। রাতে অন্তত আট–দশবার ঘুম ভাঙে। কিন্তু, হাতপাখা বন্ধ অবস্থায় একবারও পাইনি। ঐ সময় ব্যাপারটায় কিছুটা অবাক হলেও, রহস্য ভেদ করতে পারিনি। পরবর্তীতে, নিজে বাবা হওয়ার পর বুঝতে পারি, সেই হাতপাখার রহস্য ছিল সন্তান বাৎসল্য।