বাবর আলীর অন্নপূর্ণা-১ জয়

প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে গড়লেন ইতিহাস

হাসান আকবর | মঙ্গলবার , ৮ এপ্রিল, ২০২৫ at ৬:৪৯ পূর্বাহ্ণ

হিমালয়ের ভয়ংকর ও কঠিনতম পর্বতশৃঙ্গ অন্নপূর্ণা১ জয় করে ইতিহাস গড়লেন বাংলাদেশের পর্বতারোহী ও চিকিৎসক ডা. বাবর আলী। গতকাল সোমবার ভোরে তিনি ৮,০৯১ মিটার বা ২৬,৫৪৫ ফুট উচ্চতার এই শৃঙ্গ জয় করেন। তিনিই হলেন প্রথম বাংলাদেশি যিনি এ চূড়ায় পা রাখলেন।

অভিযানের সার্বিক ব্যবস্থাপনায় ছিলেন ভার্টিক্যাল ড্রিমার্সের প্রেসিডেন্ট ফরহান জামান। তিনি আজাদীকে জানান, গতকাল ভোরে গাইড ফুর্বা অংগেল শেরপার সঙ্গে চূড়ায় পৌঁছান বাবর আলী। বাবরের এই সাফল্য শুধুমাত্র ব্যক্তি পর্যায়ের নয়, এটি বাংলাদেশের পর্বতারোহণ ইতিহাসে নতুন মাইলফলক।

বাবর আলী চট্টগ্রামভিত্তিক পর্বতারোহণ সংগঠন ভার্টিক্যাল ড্রিমার্সের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ও সাধারণ সম্পাদক। এর আগেও তিনি ইতিহাস গড়েছেন। ২০২৪ সালে প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে একই অভিযানে জয় করেছেন পৃথিবীর সর্বোচ্চ পর্বত মাউন্ট এভারেস্ট এবং চতুর্থ সর্বোচ্চ শৃঙ্গ লোৎসে। ২০২২ সালে তিনি ছিলেন প্রথম বাঙালি, যিনি পর্বতারোহণের জগতে অন্যতম চ্যালেঞ্জিং চূড়া আমা দাবলাম জয় করেন।

জানা যায়, অন্নপূর্ণা১ বিশ্বের দশম উচ্চতম পর্বত, তবে মৃত্যুর হার বিবেচনায় এটি ভয়ংকর। এই পর্বতজয়ীদের মৃত্যুহার বর্তমানে প্রায় ১৪ শতাংশ। ২০১২ সাল পর্যন্ত এ হার ছিল ৩২ শতাংশ, যা বিশ্বে সর্বোচ্চদের মধ্যে একটি। চলতি বছরের এপ্রিল পর্যন্ত মাত্র ৫১৪ জন পর্বতারোহী এই পর্বত জয় করেছেন আর প্রাণ হারিয়েছেন অন্তত ৭৩ জন।

ভার্টিক্যাল ড্রিমার্স সূত্র জানিয়েছে, অন্নপূর্ণা১ জয় করার চ্যালেঞ্জ নিয়ে ২৪ মার্চ বাবর আলী বাংলাদেশ থেকে পাড়ি জমান নেপালে। কাঠমান্ডু হয়ে পোখারায় পৌঁছে ২৮ মার্চ তিনি উঠেন অন্নপূর্ণা বেসক্যাম্পে। একদিন বিশ্রামের পর শুরু হয় ধাপে ধাপে যাত্রাক্যাম্প(৫২০০ মিটার), ক্যাম্প(৫৭০০ মিটার) ও ক্যাম্প(৬৫০০ মিটার)। ক্যাম্প৩ থেকে ৬ এপ্রিল রাতে শুরু হয় ‘সামিট পুশ’। প্রতিকূল আবহাওয়া ও তুষারঝড়ের মধ্যেও দমে যাননি তিনি। ৭ এপ্রিল ভোরে চূড়ায় পৌঁছান। হিমালয়ের ভয়ঙ্কর শৃঙ্গ অন্নপূর্ণা১ এর শীর্ষে তিনি উড়ান বাংলাদেশের পতাকা।

অভিযানের ব্যবস্থাপক ফরহান জামান বলেন, বাবরের সাফল্য আমাদের পর্বতারোহণ ইতিহাসে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে। তার মতো পরিশ্রমী ও নিবেদিত অভিযাত্রী আমাদের জন্য অনুপ্রেরণা।

পর্বতজয় শেষে বাবর আলী গতকাল ক্যাম্প৩ থেকে নেমে ক্যাম্পএ অবস্থান করছিলেন জানিয়ে সূত্র বলেছে, আজ ক্যাম্পএ নামবেন। আগামীকাল পৌঁছাবেন বেসক্যাম্পে। এরপর তিনি ধীরে ধীরে সমতলে নেমে আসবেন।

ফরহান জামান বলেন, গত বছর এভারেস্টলোৎসে সামিটের পর এবার অন্নপূর্ণা১ শীর্ষে পৌছানোর মাধ্যমে বাবর আলী বাংলাদেশের পর্বতারোহণের ইতিহাসে একটি নতুন অধ্যায় যুক্ত করেছে। ওর কঠোর পরিশ্রম এবং নিরলস অধ্যবসায়ের প্রতিফলন এই সাফল্য। আমরা আশা করি এই অর্জন বাংলাদেশের পর্বতারোহণে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে। আমাদের ইচ্ছা ছিল এবার বাবরকে একসাথে তিন পর্বতে পাঠাব। কিন্তু দুঃখজনকভাবে পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে একটি পর্বতেই থামতে হয়েছে। আশা করছি এমন সাফল্যের পর বাবরের আগামীর পদযাত্রা পৃষ্ঠপোষকদের কল্যাণে আরেকটু সুগম হবে। কারণ বাবরের লক্ষ্য এই তিনটিতেই থামা নয়, ১৪টি আটহাজারী শৃঙ্গের সবকটিতে লালসবুজের পতাকা উড্ডয়ন।

নেপালের গন্ডকিতে অবস্থিত অন্নপূর্ণা পর্বত স্থানীয়দের কাছে ফসলের দেবী হিসেবে পূজনীয়। এর চারটি চূড়া আছে। যার মধ্যে শীর্ষ হলো পৃথিবীর দশম শীর্ষ পর্বত ৮,০৯১ মিটার উচ্চতার অন্নপূর্ণা১। ১৯৫০ সালের ৩ জুন ফ্রান্সের মরিস হেরজগ ও লুইস লেচেনাল প্রথম এই পর্বত চূড়া স্পর্শ করেন, যা যেকোনো আটহাজারী শৃঙ্গে প্রথম মানব সাফল্য। ওই হিসেবে এই বছর অন্নপূর্ণা১ প্রথম সামিটের প্লাটিনাম জুবিলি। এই ৭৫ বছরের মধ্যে ২০০৯ সালে অন্নপূর্ণাএ একবার বাংলাদেশি অভিযান হয়। তবে অন্নপূর্ণাএ এটিই প্রথম অভিযান এবং প্রথমবারেই এলো সাফল্য।

এই অভিযানের আয়োজক পর্বতারোহণ ক্লাব ভার্টিক্যাল ড্রিমার্সের পক্ষ থেকে জানানো হয়, উচ্চতার সঙ্গে নিজেকে খাপ খাওয়ানোর পর পর্বতারোহীরা অনুকূল আবহাওয়ার জন্য বেসক্যাম্পে অপেক্ষা করেন। আবহাওয়ার পূর্বাভাসে বাবর আলী জানতে পারেন, অনুকূল আবহাওয়া থাকবে ৬ এপ্রিল পর্যন্ত। তাই পরিকল্পনা মোতাবেক ৩ এপ্রিল চূড়ার দিকে উঠতে শুরু করেন তিনি। ওইদিন ক্যাম্প১ থেকে পরদিন উঠে যান ক্যাম্প২ এ। এর মধ্যেই শুরু হয় তুষারঝড়। প্রতিকূল আবহাওয়ার মধ্যে বাবর পৌঁছে যান ক্যাম্প(৬৫০০ মিটার)। সাধারণত ৭ হাজার ৪০০ মিটার উচ্চতায় ক্যাম্প তৈরি করে পর্বতারোহীরা চূড়ায় আরোহণের চূড়ান্ত পদক্ষেপ (সামিট পুশ) নেন। কিন্তু আবহাওয়া বিবেচনায় বাবর আলী ক্যাম্প৩ থেকেই সেই পদক্ষেপ নেন ৬ এপ্রিল রাতে। গতকাল ভোরে তিনি পর্বতটি জয় করেন।

অনেকগুলো ছয়হাজারী পর্বত বাদেও বাবর প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে ভারতের দীর্ঘতম সড়ক কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী করেছেন সাইক্লিং, প্রথম বাঙালি হিসেবে পায়ে হেঁটে পাড়ি দিয়েছেন শ্রীলঙ্কার এ মাথা থেকে ও মাথা। প্লাস্টিক দূষণের বার্তা ছড়াতে তিনি ৬৪ দিনে হেঁটেছেন বাংলাদেশের ৬৪ জেলা। এছাড়া লেখক হিসেবে আছে বাবর আলীর খ্যাতি। তিনি ম্যালরি ও এভারেস্ট, পায়ে পায়ে ৬৪ জেলা, সাইকেলের সওয়ারি, এভারেস্ট ও লোৎসে শিখরে নামে ৪টি বই লিখেছেন। বাবর চট্টগ্রামের হাটহাজারী উপজেলার নজুমিয়া হাটের লেয়াকত আলী ও লুৎফুন্নাহার বেগমের দ্বিতীয় সন্তান। তিনি চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের ৫১তম ব্যাচের ছাত্র।

পূর্ববর্তী নিবন্ধসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পহেলা বৈশাখ উদযাপনের নির্দেশ
পরবর্তী নিবন্ধযেসব দেশ অনুরোধ করেছে, সেগুলোর সঙ্গে আলোচনা শিগগির : ট্রাম্প