বান্দরবানে পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট প্রকল্প বাতিলের শঙ্কা

দীর্ঘ ৮ বছরেও হয়নি জমি অধিগ্রহণের কাজ

আলাউদ্দীন শাহরিয়ার, বান্দরবান | মঙ্গলবার , ২২ জুলাই, ২০২৫ at ৫:৪৪ পূর্বাহ্ণ

দীর্ঘ আট বছরেও বান্দরবানে পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট প্রকল্পের জমি অধিগ্রহণের কাজ এগোয়নি। কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তরের কর্মকর্তাসহ সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, উপযুক্ত জমি পেলেও অধিগ্রহণ সম্ভব হয়নি রাজনৈতিক নেতাদের ছত্রছায়ায় কিছু সুবিধাভোগীর বিরোধিতায়। প্রকল্পের মেয়াদ এবছরের ৩০ জুন শেষ হয়েছে, দ্রুত জমি অধিগ্রহণ কার্যত্রুম শেষ না হলে প্রকল্পটি বাতিল হওয়ারও আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।

সংশ্লিষ্টদের তথ্যমতে, ২০১৮ সালে বান্দরবানসহ ২৩টি জেলায় পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট স্থাপনের প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। এই প্রকল্পের বর্ধিত মেয়াদ ৩০ জুন শেষ হয়। এরমধ্যে জমি অধিগ্রহণের প্রক্রিয়া শুরু না হওয়ায় বান্দরবানে পলিটেকনিক স্থাপনে কাজ বাতিল হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকল্প সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের। পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের জন্য যোগাযোগ সুগম এবং উপযুক্ত প্রাকৃতিক ও সামাজিক পরিবেশে ৫ একর জমির প্রয়োজন। ২০২৪ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত আওয়ামীলীগের নেতারা তাঁদের নিজেদের কিংবা আত্মীয়দের জমি অধিগ্রহণের জন্য চাপ দিয়ে আসছিলেন। কিন্তু ওই জমি ইনস্টিটিউটের জন্য উপযোগী ছিলনা। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর এখন আবার অন্য একটি রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়ায় থাকা ব্যক্তিরা অধিগ্রহণ প্রক্রিয়ায় বাধা দিচ্ছেন।

নামপ্রকাশ না করার শর্তে কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলেন, আওয়ামীলীগ সরকারের পতনের পর বান্দরবানচট্টগ্রাম সড়কের সুয়ালক মাঝেরপাড়া এলাকায় একটি জমি পাওয়া যায়। সবদিক বিবেচনায় জমিটি উপযোগী হওয়ায় জেলা প্রশাসনকে অধিগ্রহণের প্রস্তাব দেওয়া হয়। কিন্তু অধিগ্রহণের প্রক্রিয়া চলমান অবস্থায় একটি পক্ষ থেকে আপত্তি আসে। তাদের অভিযোগ, জমির মালিকদের মধ্যে আওয়ামীলীগের এক নেতার ভাইয়ের জমিও রয়েছে। এছাড়াও তাদের দাবি। ওই জায়গার পাশে পাহাড়িদের পাড়া। শিক্ষার্থীদের সঙ্গে স্থানীয় পাহাড়িদের সহিংসতা হতে পারে। প্রধান সড়কের পাশে হওয়ায় শিক্ষার্থীরা সড়ক অবরোধ কর্মসূচি দিতে পারেন। সরেজমিনে প্রস্তাবিত জায়গায় গিয়ে দেখা গেছে, এলাকাটি পাহাড়িদের পাড়াসংলগ্ন নয়। আশপাশে কোনো ঘরবাড়িও নেই। পাড়া ও প্রস্তাবিত ইনস্টিটিউটের মধ্যেখানে একটি পাহাড় রয়েছে। স্থানীয় উছামং মারমা ও নাসির উদ্দিনের দাবি, শুরুতে ইনস্টিটিউট নিয়ে কারোর আপত্তি ছিলনা। কিন্তু গতমার্চে একটি রাজনৈতিক দলের নাম ব্যবহার করে বহিরাগত কিছু নেতাকর্মী জায়গাটি অধিগ্রহণে আপত্তি জানানোর জন্য স্থানীয় লোকজনদের প্রলোভন দেখিয়ে উদ্বুদ্ধ করেছে। ঐ বহিরাগতদের দাবি, পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট প্রধান সড়ক থেকে দুয়েক কিলোমিটার দূরে সুলতানপুরে হলে নিরাপদ হবে।

তবে সুলতানপুরে প্রস্তাবিত দ্বিতীয় জায়গায় গিয়ে দেখা গেছে, সেটি প্রধান সড়ক থেকে অনেকখানি দূরে এবং তিন ফসলি জমি। সেখানে নির্মাণে ব্যয় বেড়ে যাবে কয়েকগুণ। শিক্ষার্থী শিক্ষকদের যাতায়াতে কষ্ট হবে এবং তিন ফসলি জমির শষ্য উৎপাদন ব্যহত হবে।

স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান উক্যনু মারমা জানান, প্রস্তাবিত জায়গাটি আশপাশে কোনো জনবসতি নেই, পাহাড়িদের পাড়া বা গ্রামও অনেকদূরে। জমির মালিকদের একজন আওয়ামীলীগের নেতার বড়ভাই প্রাইমারি শিক্ষক। অন্যান্য অভিযোগের সঙ্গে এটাই আপত্তির মূল কারণ। আর আপত্তি তুলতে উদ্ভুদ্ধকারীরা চাচ্ছে ইনস্টিটিউট সুলতানপুরে তাদের জমিতে বাস্তবায়িত হোক।

এদিকে প্রস্তাবিত জায়গার মালিক ইদ্রিছ চৌধুরী, শহীদুল আলম, তানজিনা আফরিন বলেন, জমির মালিকরা সবাই শিক্ষক আর সরকারি কর্মচারী। এলাকার স্বার্থে জায়গাটি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের জন্য দিতে রাজি হয়েছেন। এখানে ইনস্টিটিউট হলে যোগাযোগ ব্যবস্থা শিক্ষার্থীদের যাতায়াত সহজ হবে।

স্থানীয় বাসিন্দার আকাশ মার্মা, উসাচিং মার্মা, গড়াঅং বলেন, পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের এটিই উপযুক্ত জমি। জায়গাটির আশপাশে চাবোর্ড অফিস, নির্মাণাধীন রেডক্রিসেন্ট হাসপাতাল, প্রাইমারি শিক্ষক প্রশিক্ষণ সেন্টার (পিটিআই), মেডিকেল অ্যাসিস্ট্যান্ট ট্রেনিং স্কুল (ম্যাটস), ম্রো আবাসিক স্কুল, আনসার ব্যাটেলিয়নের মত গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাও রয়েছে। ইনস্টিটিউট এখানেই হতে হবে। যারা আপত্তির কথা বলেছেন তারা কেউই এলাকার বাসিন্দা নয়, সবাই বহিরাগত। মিথ্যে অভিযোগে ষড়যন্ত্রের কারণে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি বাতিল হলে আন্দোলন কর্মসূচি পালন করা হবে।

পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক পরিষদের চেয়ারম্যান কাজী মুজিবুর রহমান বলেন, জেলায় পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট হোক সেটি একটি গোষ্ঠী চাচ্ছেনা। প্রস্তাবিত জায়গায় কোনো জনবসতি নেই, তারপরও বহিরাগতদের হাজির করে পাহাড়ি বাঙালি সহিংসতার খোঁড়া অজুহাত দেখিয়ে কৌশলে প্রকল্পটি বাতিলের ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে। এমনটি হলে পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের দাবিতে আন্দোলনে নামবে নাগরিক পরিষদ। ইতিমধ্যে স্থানীয়রা পলিটেকনিকের দাবিতে গণস্বাক্ষর নিয়ে উর্ধতন বরাবরে জমা দিয়েছেন।

প্রকল্প পরিচালকের কাছে পাঠানো অভিযোগের তদন্ত প্রতিবেদন প্রসঙ্গে সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মারুফা সুলতানা জানিয়েছেন, তদন্তকালে প্রস্তাবিত জায়গায় উপস্থিত অধিকাংশ লোকজন কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তরের প্রস্তাবিত জায়গায় পলিটেকনিক করার বিপক্ষে মতামত দিয়েছেন। তাঁরা সামপ্রদায়িক সমপ্রীতি বিনষ্ট হওয়ার আশঙ্কা করছেন, আমি স্পটে যাদের পেয়েছি তাদের মতামতের ভিত্তিতেই প্রতিবেদন দিয়েছি।

কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক কবির হোসাইন বলেন, উপযুক্ত জায়গা পাওয়া না গেলে বান্দরবানে পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট হবেনা। মাঝেরপাড়া এলাকার জায়গাটি ইনস্টিটিউটের জন্য উপযোগী। সুলতানপুরে প্রস্তাব করা জায়গা প্রধান সড়ক থেকে দূরে হওয়ায় শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের যাতায়াতে অসুবিধা হবে।বান্দরবানের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক এসএম, মনজুরুল হক বলেন, মাঝেরপাড়া প্রস্তাবিত জায়গাটি দেখে পছন্দ হয়েছে সবার। পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের জন্য উপযুক্ত জমি। কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জমিটি পরিদর্শন করে চূড়ান্ত করলেই অধিগ্রহণের কাজটি শুরু করা হবে। কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তরে জায়গাটি পরিদর্শনের জন্য লেখা হয়েছে।

বান্দরবান জেলা শিক্ষা প্রকৌশল বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মিজানুর রহমান বলেন, পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট হলে এই এলাকার শিক্ষার্থীদের উচ্চ শিক্ষার সুযোগ তৈরি হবে, কর্মসংস্থান তৈরি হবে। জমি অধিগ্রহণ চূড়ান্ত হলেই অবকাঠামো নির্মানের টেন্ডার আহবান করা হবে। দ্রুত কাজটি করা না গেলে প্রকল্পটি বাতিল হবার আশঙ্কা রয়েছে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধরাঙামাটির মারিশ্যা-বাঘাইহাট সড়কে পাহাড় ধস
পরবর্তী নিবন্ধলায়ন্স ক্লাব অব চিটাগাং রোজ ভ্যালির সভা