পাহাড়ে কেএনএফের সংঘাত, ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞার প্রভাবে বান্দরবানে ধস নেমেছে পর্যটন শিল্পে। দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতির বিরূপ প্রভাব পড়েছে পর্যটন সংশ্লিষ্ট সবধরনের ব্যবসা বাণিজ্যে। এতে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে বান্দরবান জেলা সদর, রুমা, থানচি ও রোয়াংছড়ি চারটি উপজেলায় বিনিয়োগকারীরা। ইতিমধ্যে ব্যাংক ঋণ নিয়ে গড়ে তোলা বেশকয়েকটি আবাসিক হোটেল বিক্রির সিদ্ধান্ত নিয়েছে ব্যবসায়ীরা।
বান্দরবান হোটেল ওনার্স এসোসিয়েশনের সাংগঠনিক সম্পাদক ও হোটেল আরণ্যের মালিক মো. জসিম উদ্দিন বলেন, আগে সারা বছরই পর্যটকে মুখরিত থাকত প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি খ্যাত বান্দরবান জেলা। কিন্তু কোভিড ১৯ ক্ষতির পরই ২০২২ সালের মাঝামাঝি থেকে পাহাড়ে কুকি চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ) সংঘাত, নিরাপত্তা বিবেচনায় ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞার প্রভাবে সেই চিরচেনা পর্যটকে ভরপুর দৃশ্যটা যেন বদলে যায়। কোভিড ১৯ এর পর গত বছরটা ছিল পাহাড়ের পর্যটন শিল্পের জন্য সবচেয়ে খারাপ সময়। গত বছর থেকে আজ পর্যন্ত অনেকটায় পর্যটক শূন্য বলা চলে বান্দরবান। ব্যাংক ঋণ নিয়ে গড়ে তোলা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো টিকিয়ে রাখাটাই হলো বর্তমানে ব্যবসায়ীদের বড় চ্যালেঞ্জ। ইতিমধ্যে বেশকটি আবাসিক হোটেল ও রেস্টুরেন্ট বন্ধ হয়ে গেছে। দীর্ঘ ক্ষতির কারণে যত্ন করে গড়ে তোলা নিজেদের আবাসিক হোটেল বিক্রির সিদ্ধান্ত নিয়েছে অনেকে। অনেকেই ব্যবসা গুটিয়ে নিতে চাচ্ছে। কারণ কবে এ সমস্যার সমাধান হবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই।
এদিকে ২০২৪ সালের শুরুতে জানুয়ারি মাসে শান্তি আলোচনায় কেএনএফের সংঘাত নিরসনের উদ্যোগ এবং ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার ঘটনায় আশানুরূপ পর্যটকদের আগমনে স্বস্তি ফিরেছিল আবাসিক হোটেল, রেস্টুরেন্টসহ পর্যটন সংশ্লিষ্ট ব্যবসা বাণিজ্যে। পর্যটকদের পদচারণায় মুখরিত হয়ে উঠেছিল দর্শণীয় স্থানগুলোও। কিন্তু ফেব্রুয়ারি মাসের শুরুতেই ফের পাহাড়ের সশস্ত্র সংগঠন কুকি চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ‘র) সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা রুমা–থানচিতে ব্যাংক, থানচি বাজারে হামলা, ব্যাংক ম্যানেজারকে অপহরণের ঘটনায় ফের উত্তপ্ত হয়ে উঠে পাহাড়ি জনপদ বান্দরবান। কেএনএফের সন্ত্রাসী তৎপরতা বন্ধে সাড়াশি অভিযানে নেমেছে নিরাপত্তা বাহিনী। ভ্রমণে কোনো নিষেধাজ্ঞা না থাকলেও চলমান সংঘাতের খবরে ভয়ে আতঙ্কে পর্যটক শূন্য হয়ে পড়েছে ফের বান্দরবান জেলা।
অথচ দেশের পর্যটন শিল্পের অপার সম্ভাবনাময় জেলা হচ্ছে বৈচিত্র্যময় বান্দরবান। এখানে পাহাড়ের চৌদ্দটি জনগোষ্ঠীর সহাবস্থানে সামপ্রদায়িক সমপ্রীতির খ্যাতি রয়েছে দেশজুড়ে। জেলায় রয়েছে পাহাড়ের প্রকৃতি এবং শৈল্পিক ছোয়ায় সাজানো দর্শণীয় স্থান নীলাচল, মেঘলায় দুটি ঝুলন্ত সেতু, ক্যাবলকার, বাংলার দার্জিলিং খ্যাত চিম্বুক পাহাড়, নীলগিরি, নীলদিগন্ত, তমাতুঙ্গী, শৈলপ্রপাত ঝর্ণা, রুপালী ঝর্ণা, মুরুং ঝর্ণা, রিজুকঝর্ণা, জাদীপাই ঝর্ণা, তিনাপসাইতার ঝর্ণা, দামতুয়া ঝর্ণা, বাকলাই ঝর্ণা, লাংলুক ঝর্ণা, বুদ্ধিস টেম্পল, স্বর্ণ মন্দির, রামজাদী, রেমাক্রী বড়পাথর, দেবতাখুম, নাফাখুম, অমিয়খুম জলপ্রপাত, রহস্যময় আলীর সুরঙ্গ, দেশের সর্বচ্চ পাহাড় চূড়া ক্যাওক্রাডং, তাজিংডং, সাকাহাফং, শিপ্পি পাহাড়ের মতো চোখজুড়ানো সব দর্শণীয় পর্যটন স্পট।
এখানে পর্যটকরা কখনো লেকের পানিতে প্যাডেল বোটে, কখনো ক্যাবল কারে এবং কখনো নীলাচলের রোমাঞ্চকর দোলনায় প্যারাসেইলিংয়ে আকাশে উড়ার স্বপ্ন পূরণের সমস্ত আয়োজন রয়েছে।
ট্যুরিস্ট জিপ গাড়ি সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. কামাল বলেন, ট্যুরিস্ট নির্ভরশীল তিন শতাধিক গাড়ির রয়েছে বান্দরবান। সংঘাত ও নিষেধাজ্ঞার কারণে গত বছরটি পর্যটক শূন্য থাকায় অর্থকষ্টে খেয়ে না খেয়ে দিন কাটিয়েছে পাঁচ শতাধিকের মত পরিবহণ শ্রমিক। তবে নতুন বছরের শুরুতে পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হলেও ফের অস্থিরতায় পর্যটকশূন্য জেলা। ভাড়া না থাকায় অর্থকষ্টে মানবেতর জীবন কাটাচ্ছে অধিকাংশ শ্রমিক। সাহায্য সহযোগিতার হাত বাড়ানোর দাবি জানাচ্ছি।
স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত পণ্যের নারী ব্যবসায়ী শ্রীমতি তঞ্চঙ্গ্যা বলেন, পর্যটক না থাকায় বেচাকেচা মোটেও নেই। বেচাকেনা না থাকায় কমেছে হস্তশিল্প ও কোমর তাঁতে পোশাক তৈরিও। এখানে উৎপাদিত কোমর তাঁত কাপড়ের দোকানদার এবং উৎপাদনকারী সবাই নারী তাই দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতির কারণে অনেকেই বিকল্প কর্মসংস্থানের পথ খোঁজছে।
বান্দরবানের জেলা প্রশাসক শাহ মোজাহিদ উদ্দিন বলেন, বান্দরবানে পর্যটকদের ভ্রমণে কোনো বাধা নেই। তবে নিরাপত্তাগত সমস্যার কারণে রুমা, থানচি, রোয়াংছড়ি উপজেলায় পর্যটকদের ভ্রমণে নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে। সদর উপজেলার নীলাচল, চিম্বুক, মেঘলা, নীলগিরি, প্রান্তিকলেক, রুপালি ঝর্ণা, শৈলপ্রপাতসহ অসংখ্য পর্যটন স্পট এবং লামা, আলীকদম ও নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার দর্শণীয় স্থানগুলো খোলা রয়েছে। ভ্রমণ পিপাসুদের নিরাপত্তা ও আরামদায়ক ভ্রমণের জন্য কাজ করছে স্থানীয় প্রশাসনসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।