বানবাসী অসহায় মানুষ : তিস্তা ব্যারেজ ও জলমগ্ন চট্টগ্রাম

জসীম চৌধুরী সবুজ | মঙ্গলবার , ২১ জুন, ২০২২ at ৬:১০ পূর্বাহ্ণ

সীতাকুণ্ডে বিএম কনটেইনার ডিপোর মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় পোড়ালাশের গন্ধ এখনো বাতাসে ভেসে আসছে। এই ভয়াবহ বিপর্যয়ে হতাহতদের পরিবারের আহাজারি এবং হাসপাতালে দগ্ধদের যন্ত্রণার সকরুণ দৃশ্য আড়াল না হতেই সামনে এসে পড়ল মহাবিপর্যয়। সিলেট-সুনামগঞ্জে একটি বন্যার ধকল কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই আবার স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় তলিয়ে গেছে বৃহত্তর সিলেটের সিংহভাগ এলাকা। ভারতের মেঘালয় ও আসাম রাজ্যে তিন/ চার দিনের টানা ভারী বর্ষণ ছিল ১২৬ বছরের ইতিহাসে তৃতীয় সর্বোচ্চ রেকর্ড। সেই বৃষ্টির পানির ঢল ভাসিয়ে নিচ্ছে বাংলাদেশকে। মেঘালয়ের পানি এসে সিলেট বিভাগ এবং আসামের পানি ব্রহ্মপুত্র নদসহ অন্যান্য নদ-নদী দিয়ে এসে রংপুর বিভাগের সবকটি জেলাকে প্লাবিত করে দিয়েছে। অতিবৃষ্টির পানির চাপ সামলাতে আসামের কার্ভি লাংপিং পানিবিদ্যুৎ কেন্দ্রে সবকটি গেট একসাথে খুলে দেওয়ায় সিলেট অঞ্চলে স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় মানবিক বিপর্যয়ের সৃষ্টি হয়েছে। একই অবস্থা ভারতীয় তিস্তা ব্যারেজের। সেখানে উজানে ব্যারেজের সবকটি গেট খুলে দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে অভিন্ন ৫৪ টি নদ-নদীর মধ্যে ৫১ টিতে আন্তর্জাতিক নদী আইন অমান্য করছে ভারত। তিস্তা নদীর পানি বণ্টন চুক্তি ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির আপত্তির অজুহাতে। কেন্দ্রে বিজেপির মোদী সরকারের এ ব্যাপারে খুব বেশি আগ্রহও নিকট অতীতে পরিলক্ষিত হয়নি। বিজেপি বলেছিল ২০২১ সালে পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনে মমতা ব্যানার্জি বিদায় নিবে। বিজেপি পশ্চিমবঙ্গেও রাজ্য সরকার গঠন করবে। তখন তারা তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি করবে। বিজেপির সেই আশা পূর্ণ হয়নি। মমতা তৃতীয় বারের মত আবার ক্ষমতায়। অতএব তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যা থেকে বাংলাদেশ আরও কতকাল যে বঞ্চিত থাকবে তা একমাত্র ভবিতব্যই বলতে পারে।

ভারত শুকনো মৌসুমে আমাদের পানি প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত করছে। তিস্তা ব্যারেজ, ফারাক্কা বাঁধসহ নানাভাবে নদনদীর স্বাভাবিক পানি প্রবাহকে আটকে দেওয়ায় শুকনো মৌসুমে বাংলাদেশ শুকিয়ে চৌচির হচ্ছে। আবার বর্ষাকালে উজানের পানি ছেড়ে দিলে বাংলাদেশ বন্যার পানিতে তলিয়ে যাচ্ছে। উভয় মৌসুমেই হাজার হাজার কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতি ছাড়াও বাংলাদেশের পরিবেশগত বিপর্যয়ও এ কারণে বেড়ে চলেছে। বাংলাদেশ পানি ব্যবস্থাপনার জন্য তিস্তা ব্যারেজ প্রকল্প নামে একটি মহাপ্রকল্প গ্রহণ করেছে। চীন সরকার এই প্রকল্পে কারিগরি ও আর্থিক সহায়তা দিতে সম্মত হয়েছে। সবকিছু চূড়ান্ত হওয়া সত্ত্বেও দিল্লীর আপত্তিতে বাংলাদেশ এই প্রকল্প অনুমোদনের জন্য একনেক বৈঠকে উপস্থাপন করতে পারছে না। ভারত তার সীমান্ত ঘেঁষে বিপুল সংখ্যক চীনা নাগরিকের উপস্থিতিকে নিরাপত্তাজনিত হুমকি মনে করছে। বাস্তবে কি তা-ই। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ১১৫ কিলোমিটার তিস্তা নদী প্রবাহিত। প্রস্তাবিত প্রকল্পে নদী শাসন, খনন, নদীর প্রশস্থতা কমিয়ে উভয় তীরে বাঁধ নির্মাণ এবং তার উপর চার লেনের সড়ক করা হবে। এতে অনেক হেক্টর ভূমি উদ্ধার হবে। যা সেচের আওতায় আনা হবে। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে এই প্রকল্পে থাকবে বড় জলাধার। যেখানে বর্ষাকালে আসা পানি আটকে রাখা হবে, যা শুকনো মৌসুমে প্রয়োজন মত আমাদের সেচ কাজে ব্যবহার করা যাবে। এই প্রকল্প নিয়ে ভারতের ভয় সেখানটায়। বর্ষায় যদি আমাদের ব্যারেজের সবকটি গেট বন্ধ থাকে তাহলে উজানের বিস্তীর্ণ এলাকা পানির নিচে তলিয়ে যাবে। এখন ভারতের ছেড়ে দেওয়া পানিতে আমাদের যে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে তিস্তা ব্যারেজ বাস্তবায়িত হলে তা থেকে আমরা পরিত্রাণ পাব। এটা হলে তিস্তাসহ অভিন্ন সকল নদ-নদীর পানি বণ্টন নিয়ে তালবাহনা করার সুযোগও ভারতের থাকবে না। আন্তর্জাতিক নিয়ম মেনে পানি বণ্টন চুক্তি করতে ভারত বাধ্য থাকবে। তাই আমাদের বৃহত্তর স্বার্থে তিস্তা ব্যারেজকে অগ্রাধিকার প্রকল্প তালিকায় এনে দ্রুত বাস্তবায়নের প্রত্যাশা আমরা করতে পারি। বিশ্বব্যাংকের খবরদারি-চোখরাঙ্গানি উপেক্ষা করে আমরা যেভাবে পদ্মা সেতু নির্মাণ করেছি সেভাবে তিস্তা ব্যারেজও হতে পারে। পদ্মা সেতু আমাদের আস্থা ও বিশ্বাস অনেক বাড়িয়ে দিয়েছে।

এ লেখা যখন লিখছি তখনও টানা ভারী বর্ষণ অব্যাহত রয়েছে। বৃষ্টির পানিতে তলিয়ে গেছে চট্টগ্রাম মহানগরীর অধিকাংশ এলাকা। নদ-নদীর পানিও বাড়ছে। চট্টগ্রাম অঞ্চলেও বন্যার পদধ্বনি শোনা যাচ্ছে। দুর্ভোগের নগরীতে পরিণত হয়েছে চট্টগ্রাম। বাসাবাড়ি-দোকানপাট-গুদাম- ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সব পানির নিচে তলিয়ে আছে। সিটি মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরীর বাড়ির আঙ্গিনায়ও হাঁটু সমান পানি। নগরীর জলাবদ্ধতা রোধে সাড়ে পাঁচ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ)। ২০১৭ সালে শুরু হওয়া এই প্রকল্প কাজ ২০২০ সালে শেষ হলে নগরবাসী জলাবদ্ধতার কবল থেকে মুক্তি পাবে এমনটাই ধারণা দেওয়া হয়েছিল। তিনবছর পর নির্দিষ্ট সময়ে কাজ শেষ করতে না পারায় প্রকল্প মেয়াদ আরও দুই বছর বাড়িয়ে ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত করা হয়েছিল। সেই মেয়াদও শেষ হতে আর মাত্র কয়েকদিন বাকি। প্রকল্প কাজ শেষ হওয়ার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। প্রকল্প মেয়াদ আবারও বাড়বে। হয়তোবা খরচও। নগরবাসীর দুর্ভোগ-দুর্দশাও একই সাথে বাড়ছে। এ থেকে পরিত্রাণ কবে মিলবে তা কেউ বলতে পারছে না।

নগরীর আকবর শাহ এলাকায় পাহাড় ধসে চারজনের মৃত্যু হয়েছে। ২০০৭ সালের ১১ জুন এই চট্টগ্রামে পাহাড় ধসে একদিনে সর্বোচ্চ ১২৭ জনের মৃত্যুর ঘটনাটি বারবার চোখের সামনে ভেসে ওঠে। এরপর থেকে পাহাড়ের পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাস বন্ধ করতে প্রশাসনের আপ্রাণ চেষ্টা বারবার বিফলে যাচ্ছে। এখানে চলছে চোর-পুলিশ খেলা। প্রশাসন অবৈধ এসব বস্তি উচ্ছেদ করে আসলে পরদিন আবার সেখানে গজিয়ে ওঠে ঘরবাড়ি। স্বল্প আয়ের নিম্নবিত্ত লোকজন কম ভাড়ায় মৃত্যু ঝুঁকি নিয়ে এসব বস্তিতে বসবাস করে। স্থানীয় রাজনৈতিক প্রভাবশালী কিছু অসাধু ব্যক্তি সরকারি খাস জায়গা, রেলের বা অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের জায়গা-জমি দখলে নিয়ে তাতে কলোনি বানিয়ে ভাড়া দেয়। মাসে লাখ লাখ টাকা তারা এভাবে আয় করে। প্রাণ যায় কিছু নিরীহ আমজনতার।

লেখক : সাংবাদিক, প্রাবন্ধিক।

পূর্ববর্তী নিবন্ধএকটি হঠাৎ মৃত্যু : হরিষে বিষাদ!
পরবর্তী নিবন্ধঈদে বাসের আগাম টিকেট বিক্রি শুরু ২৪ জুন