বাদশাহ মিয়া চৌধুরী : চট্টগ্রামের স্যার সৈয়দ আহমদ

ডা: মাহমুদ এ চৌধুরী আরজু | শুক্রবার , ৫ আগস্ট, ২০২২ at ৭:১৮ পূর্বাহ্ণ

১৯৫৭ সালে চট্টগ্রামে একটি মহিলা কলেজ (নাসিরাবাদ মহিলা কলেজ) প্রতিষ্ঠিত হলেও আর একটি মহিলা কলেজ প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। সে লক্ষ্যে ১৯৬৭ সালের ৫ আগষ্ট বাদশাহ মিয়া চৌধুরী তার ভায়রা তৎকালীন জাতীয় পরিষদ সদস্য এডভোকেট সিরাজুল ইসলামসহ জেলা প্রশাসকের অফিসে এক সভায় যাচ্ছিলেন মহিলা কলেজ প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে আলোচনা করার জন্য (পরবর্তীতে তা এনায়েত বাজার মহিলা কলেজ হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়)। কিন্তু বিকালে ঘর থেকে বের হওয়ার সময় উনার স্ট্রোক হয় এবং সেই রাতে আন্দরকিল্লার জেনারেল হাসপাতালে পরলোক গমন করেন। উনার অন্তিম ইচ্ছা অনুযায়ী উনাকে আন্দরকিল্লার নজির আহম্মদ রোডস্থ মুসলিম এডুকেশন ক্যাম্পাসের ভিতরে, জামে মসজিদের সামনে কবরস্থ করা হয়। মাত্র ৫২ বছরের বর্ণিল জীবনে মরহুম বাদশাহ মিয়া চৌধুরী চট্টগ্রামে প্রতিষ্ঠা করেছেন বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী বাদশাহ মিয়া চৌধুরী তাঁর জীবদ্দশায় একটি সুশিক্ষিত ও প্রশিক্ষিত আদর্শ সমাজ গড়ার লক্ষ্যে যে অবিস্মরণীয় বিদ্যানুরাগ, সমাজ হিতৈষণা, ধর্মানুরাগ, দয়া-দক্ষিণা ইত্যাদির ছাপ রেখে গেছেন তা অন্যদেরও সেবাধর্মী এবং কল্যাণকর সে সব আদর্শ গুণের অনুসরণ ও অনুকরণের প্রত্যাশায় সমাজে আজ তা উন্মুখ হয়ে রয়েছে। বর্তমানে বস্তুগত সমাজে তাঁর মত নিবেদিতপ্রাণ সমাজকর্মী ও শিক্ষানুরাগীর অভাব অনুভব হয় প্রতি পদে পদে। লালদিঘির মাঠে অনুষ্ঠিত তাঁর নামাজে জানাযায় তরুণ নেতা আবুল খায়ের সিদ্দিকী শোক প্রকাশ করে বলেছিলেন আজকে চট্টগ্রামের ‘স্যার সৈয়দ’ আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন।

৫০ শতকের মাঝামাঝি সময়ে যখন চট্টগ্রামের একদল সমাজকর্মী একটি সাধারণ কলেজ, একটি হাই স্কুল, একটি মহিলা কলেজ, একটি আইন কলেজ ও একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করতে কাজ শুরু করেন এদের অধিকাংশই ছিল ১৮৯৯ সালে খান বাহাদুর আবদুল আজিজ প্রতিষ্ঠিত ‘চট্টগ্রাম মুসলিম এডুকেশন সোসাইটি’র সদস্য। এসব সমাজকর্মের পুরোভাগেই ছিলেন বাদশাহ মিয়া চৌধুরী। পেশায় একজন ইনকাম টেক্স উকিল হলেও তিনি ছিলেন একজন মহানপ্রাণ নিবেদিত সমাজসেবক। সমাজ সেবা ছিল তার নেশার মত। তার সাথে ছিলেন তৎকালীন বঙ্গীয় সরকারের অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা শহীদ উদ্দিন মাহমুদ, অবসরপ্রাপ্ত বিভাগীয় স্কুল সাব ইন্সপেক্টর আব্দুর রহমান, সরকারি কৌশলী বদরুল হক খান, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য ইউ এন ছিদ্দিকসহ আরো অনেকে। এ লক্ষ্যে বাদশাহ মিয়া চৌধুরী জনমত গঠনের কাজে নেমে পড়েন। জাতি, ধর্ম নির্বিশেষে শিক্ষিত সম্প্রদায়ের সমর্থন আদায়ে সক্ষম হন। চট্টগ্রামের জেমসন হলে সভা আহবান করে এই পরিকল্পনা কার্যে পরিণত করার জন্য কতিপয় প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। এর ২ বছরের মধ্যে চট্টগ্রামে একটি কলেজ (বর্তমানে সিটি কলেজ), একটি মহিলা কলেজ (বর্তমানে সরকারি ও একটি আইন কলেজ (বর্তমানে চট্টগ্রাম আইন কলেজ) প্রতিষ্ঠিত করা হয়। এই সব প্রতিষ্ঠানকে চট্টগ্রাম মুসলিম এডুকেশন সোসাইটিতে স্থান দেওয়া হয় এবং প্রাথমিক অর্থ সংস্থানের ব্যবস্থা করা হয়।

এর কয়েক বছর পর চট্টগ্রামের সন্তান জাকির হোসেন পূর্ব পাকিস্থানের গভর্নর নিযুক্ত হন। কথিত আছে যে গভর্নর সাহেব চট্টগ্রাম সফরের এক পর্যায়ে হযরত শাহ আমানত এর মাজার জেয়ারত শেষে আন্দরকিল্লা রোড দিয়ে যাবার পথে বাদশাহ মিয়া চৌধুরীর চেম্বারে নিজে (তখন বাদশাহ মিয়া চৌধুরী চেম্বার ছিল আন্দরকিল্লা জামে মসজিদের মূল গেইটের পাশে) হাজির হয়ে চট্টগ্রামে মহিলা কলেজ প্রতিষ্ঠার জন্য ২ লক্ষ রুপি মঞ্জুর হয়েছে বলে জানান। আমার বড় ভাই এ এ হাসনাত এর মুখে শুনেছি ঐ দিনেই সমস্ত কাগজপত্র রেডি করে আমার বড় ভাইকে ঢাকা মেইলে করে ঢাকায় পাঠানো হয়। সকালে উনি গভর্ণর হাউজে কাগজপত্র জমা দেন। এ ছাড়া বাদশাহ মিয়া চৌধুরী বিভিন্ন জায়গা থেকে অর্থ সংগ্রহ করে সিটি কলেজ ও আইন কলেজের জন্য রিজার্ভ ফান্ড তৈরি করে যাতে এ দুটি কলেজ ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এফিলেশন’ লাভ করতে পারে। তিনি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন নাইট কলেজ। উদ্দেশ্য ছিল যে চট্টগ্রামের যে সব ছাত্র মেট্রিক পাশ করে বিভিন্ন সরকারি ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে কেরানীর চাকরি করছে তারা রাত্রে পড়াশুনা করে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করতে পারলে পরবর্তী জীবনে অফিসার পদ লাভ করতে পারবে।

পরবর্তীতে অনেক লোকের সাথে আমার পরিচয় হয় যারা নাইট কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করে অফিসার হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন। কাজেম আলী স্কুলকে দৈন্যদশা থেকে তার প্রচেষ্টায় ও পরিচালনায় এটিকে উন্নত পর্যায়ে নিয়ে আসা হয়। নিজ গ্রামে মাদার্শা হাই স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন এবং বর্তমানে যা উত্তর চট্টগ্রামের একটি শ্রেষ্ঠ স্কুল হিসাবে পরিচিতি লাভ করেছে। তার প্রচেষ্টায় চট্টগ্রামের নাসিরাবাদ এলাকায় ৭ একর জমি সরকার কর্তৃক হুকুম দখল করে মহিলা কলেজের জন্য বরাদ্দ করে এবং সেখানে স্থাপনের কাজে অক্লান্ত পরিশ্রম করেন এবং তিনি পরিচালনা বোর্ডের সভাপতি ছিলেন। তিনি নিজে কলেজের বিল্ডিং নিমাণ কাজ তদারকি করতেন। চাঁদপুরে চাকরিকালীন সময়ে তিনি চাঁদপুর কলেজ প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। এ ব্যাপারে বলা যায় যে, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর ১৯৬০ সালের শেষের দিকে চট্টগ্রামের শিক্ষা অনুরাগী মহল চট্টগ্রামে একটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের জন্য চট্টগ্রামের সকল রাজনৈতিক ও সমাজশক্তি ব্যক্তিবর্গের একতাবদ্ধ করেন। ১৯৬১ সালে ৭ মে চট্টগ্রামে ৩য় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের জন্য এক সভা হয়। বাদশাহ মিয়া চৌধুরী সভাপতি ও প্রফেসর আহমেদ হোসেন কে সাধারণ সম্পাদক করে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় সংগ্রাম কমিটি গঠন করা হয়। এ কমিটি প্রায় বছরকাল সময় কাজ করে ৯ ডিসেম্বর ১৯৬২ সালে লালদিঘির ময়দানে এক জনসভা করেন। সেই সভায় সভাপতিত্ব করেন তৎকালীন প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য এ বি এম ফজলুল করিম চৌধুরী।

এ সভা থেকে পরে দেশের প্রেসিডেন্ট ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান ও পূর্ব পাকিস্তানের গভর্ণর লে. জেনারেল আজম খানের নিকট স্মারক লিপি প্রদান করা হয়। কিন্তু তৎকালীন প্রাদেশিক শিক্ষামন্ত্রী মফিজ উদ্দিন আহমেদ সাহেব কুমিল্লার লোক হওয়াতে কুমিল্লায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করতে থাকেন। পরবর্তীতে ৮ জানুয়ারী ১৯৬৩ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে চট্টগ্রামে পূর্ণ দিবস হরতাল পালন করা হয়। অনেকে হয়তো জানে না যে বাদশাহ মিয়া চৌধুরীকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্ণর লে: জেনারেল আজম খানের অফিস থেকে Mr. Chowdhury, Go Slow বলে সতর্ক করা হয়েছিলো। পরবর্তীতে অনেক আন্দোলন ও আলোচনার পর ১৯৬৫ সালে ১৭ জানুয়ারী পশ্চিম পাকিস্তানের রাওয়ালপিণ্ডিতে মন্ত্রীসভার বৈঠকে পূর্ব পাকিস্তানের ৩য় বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রামে স্থাপনের সিদ্ধান্ত হয় এবং জাতীয় অর্থনৈতিক কাউন্সিল অর্থ অনুমোদন দেয়। তখন পর্যন্ত বাদশাহ মিয়া চৌধুরীর নেতৃত্বে চট্টগ্রামের শিক্ষা দরদী ব্যক্তিবর্গ সংগ্রাম অব্যাহত রেখে রাস্তায় ছিলেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে ‘দৈনিক আজাদী’ পত্রিকার ভূমিকা খুবই উল্লেখযোগ্য। এই আন্দোলনের সঙ্গে ইতিবাচক সংবাদ পরিবেশন করে ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছিলেন। এজন্য কুমিল্লায় দৈনিক আজাদী পত্রিকা প্রকাশ্যে পুড়ানো হয়।

আমাদের দেশের শিক্ষিতজনরা জানেন ও চিনেন স্যার সৈয়দ আহমদ কে ছিলেন এবং কেন তিনি বিখ্যাত। ভারতবর্ষের পিছিয়ে পড়া মুসলমানদের সমাজে ও দেশ উপযোগী করে গড়ে তুলার জন্য তিনি আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। অসাম্প্রদায়িক এ মানুষটি প্রকৃত ইসলাম প্রতিষ্ঠার জন্য মাদ্রাসাও প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। তার শিক্ষার সম্প্রসারণ ও কুসংস্কার মুক্ত প্রকৃত মুসলমান সৃষ্টির জন্য এ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো এখনো ভূমিকা রেখে চলছে। কুসংস্কার এবং শিক্ষায় পিছিয়ে পড়া ভারতবর্ষের মুসলমানরা প্রগতির ঝাণ্ডার পথ খুঁজে পায় আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর থেকে। ঠিক এরকম একজন মানুষ ছিলেন বাদশাহ মিয়া চৌধুরী। তিনি কখনো একক প্রচেষ্টায় আবার কখনো মুসলিম এডুকেশন এর মাধ্যমে চট্টগ্রামে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠার কাজটি করেছিলেন। চট্টগ্রামে এ ‘স্যার সৈয়দ আহমদ’ খ্যাত শিক্ষানুরাগী বাদশাহ মিয়া চৌধুরীর অক্লান্ত পরিশ্রমে প্রতিষ্ঠা পায় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়সহ চট্টগ্রামে অনেক স্কুল ও কলেজ। নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার চাইতে শিক্ষার অবকাঠামো উন্নয়নেই ছিল তাঁর মৌলিক আদর্শ। তাই এখনো বাদশাহ মিয়া চৌধুরী সকলের কাছে স্মরণীয় ও বরণীয়।
লেখক: শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ ও বাদশাহ মিয়া চৌধুরীর কনিষ্ঠ পুত্র

পূর্ববর্তী নিবন্ধজুম্‌’আর খুতবা
পরবর্তী নিবন্ধশোক ভুলে কর্মীদের জেগে ওঠার আহ্বান ফখরুলের