বাজির ঘোড়া ছুটছে জোর কদমে

আইপিএল জুয়ায় নিঃস্ব হচ্ছেন অনেকে

আজাদী প্রতিবেদন | বুধবার , ১৪ অক্টোবর, ২০২০ at ৫:২৩ পূর্বাহ্ণ

বাজির ঘোড়া ছুটছে জোর কদমে। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে জুয়াড়িদের রোখার নানা প্রচেষ্টার ফাঁক গলে খেলা নিয়ে জুয়া চলছে গলি থেকে রাজপথ সর্বত্রই। আধুনিক ক্রিকেটের সংক্ষিপ্ত অথচ জনপ্রিয় সংস্করণ টি-টুয়েন্টি ক্রিকেট। বিশ্বকাপ, আইপিএল, বিপিএল, যা-ই হোক না কেন, জুয়ার জ্বরে আক্রান্ত হয়ে পড়ে গোটা দেশ। চলতি আইপিএল টুর্নামেন্টও বাদ যায় কেন? করোনার কারণে দর্শকশূন্য গ্যালারিতে চলছে খেলা। তাতে কী! প্রযুক্তির কল্যাণে অনলাইনে জুয়াড়িরা বাজি ধরছে। কোন টিম জিতবে তা তো আছেই, কে কত উইকেট পাবে, জিতলে রানে জিতবে না উইকেটে, নির্দিষ্ট একটি ওভারে রান কত হবে, ইত্যাদি নানা বিষয় নিয়ে জুয়া চলছে।
ক্রিকেটই দেশের মানুষের কাছে ধ্যান-জ্ঞান। ক্রিকেট নিয়ে এদেশের মানুষের আবেগ-ভালোবাসাকে কেন্দ্র করে এক ধরনের অসাধু চক্র প্রতিনিয়তই হাজার হাজার টাকার ফলাফল বাজি, ওভার বাজি, রানবাজিসহ বিভিন্ন ধরনের জুয়া খেলছে। এ জুয়াবাজির ফাঁদে পড়ে অনেকেই হয়ে যাচ্ছেন নিঃস্ব। টাকার লেনদেন নিয়ে অনেক সময়ই ঘটে নানা ধরনের বিপত্তির ঘটনা। পাড়া-মহল্লার অলিগলি, বাজার থেকে শুরু করে নগরীর অভিজাত হোটেলগুলোতেও চলছে আইপিএল নিয়ে জুয়া। চায়ের দোকান, রেস্তোঁরা, সেলুন, রিকশা গ্যারেজ ইত্যাদি কেন্দ্রিক ক্রিকেট জুয়ার আসর বসছে প্রতিদিন। এসব আসরে যোগ দেয়া বেশির ভাগই শ্রমজীবী মানুষ। তাঁরা জুয়ার আসরে এসে প্রতিদিনই নিঃস্ব হচ্ছেন। জড়িয়ে পড়ছেন নানা অপরাধে।
ব্যবসায়ী মো.আইনুদ্দীন প্রকাশ মালু নামের এক ব্যবসায়ী থেকে বাকিতে ১ লাখ ৭০ হাজার টাকার মাছ কিনেছিলেন খুচরা মাছ ব্যবসায়ী বাবলা। কিন্তু মাছ বিক্রির টাকা মহাজনকে না দিয়ে আইপিএলের জুয়ায় খুইয়ে বসেছেন। রাতভর শহরের এখান-ওখান ঘুরে, উপায়ন্তর না দেখে আত্মহত্যার কথাও ভেবেছিলেন তিনি। হঠাৎ তার মাথায় দুষ্ট বুদ্ধি চাপে। তিনি ভাবেন, ছিনতাই নাটক সাজালে কেমন হয় ? সেই ভাবনা থেকে তিনি ছিনতাইয়ের অভিযোগ করলেন পুলিশের বিরুদ্ধেই। সিএমপি কমিশনারের নির্দেশে পরে অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (দক্ষিণ) পলাশ কান্তি নাথ ও সহকারী পুলিশ কমিশনার ( কোতোয়ালী জোন) নোবেল চাকমা অভিযোগটি তদন্ত করেন। সিএমপির অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (দক্ষিণ) পলাশ কান্তি নাথ আজাদীকে বলেন, থানার টহল টিম, ফোর্সসহ পুলিশের সকল সদস্যকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। ডিসি হিল ও মিউনিসিপ্যাল মডেল হাইস্কুলের সামনে থাকা সিসি ক্যামেরার ফুটেজ পর্যালোচনা করা হয়। কিন্তু এমন ঘটনার কোনো সত্যতা পাওয়া যায়নি। এরপর কোতোয়ালী থানা পুলিশ বাবলাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে। জিজ্ঞাসাবাদের এক পর্যায়ে স্বীকার করে যে, আইপিএল নিয়ে জুয়া খেলে সে অনেক টাকা হারিয়েছে। তাই এ ধরনের নাটক সাজিয়েছে।
সরেজমিন গত সোমবার রাতে নগরীর হাজারীগলি ও ঘন্টাখানেক পর রেলস্টেশন গিয়ে আইপিএল নিয়ে রমরমা বাজির দৃশ্য চোখে পড়ে। কাছে ভিড়তেই দেখা যায় হাতবদল হচ্ছে টাকা। ফোনে রেট জেনে বাজি ধরছেন শাহজাহান (ছদ্মনাম) নামে একজন। এ বিষয়ে তিনি বলেন, বিরক্ত করবেন না তো, মেজাজ খারাপ, এই মাত্র টাকা হারালাম। ম্যাচে পাওয়ার প্লেতে কত রান হবে, ৫/১০ ওভারে কত রান হবে, টোটাল রান কত হবে, কোন প্লেয়ার বেশি রান করবে সব কিছুতেই চলে বাজি। অনেক সময় বাজিকরদের টাকা জমা রাখেন রাস্তার মোড় বা গলির ভেতরের দোকানিরা। বাজির এমন দর কষাকষি চলে রীতিমতো প্রকাশ্যে। ভালো দলের সঙ্গে খারাপ দলের খেলা হলে দর কষাকষিটা হয় ভিন্নভাবে।
আইপিএলে বাজির নেশায় লাখ টাকা হারিয়ে এই জুয়া খেলার ফাঁদ থেকে বের হয়ে এসেছেন তন্ময় আহমেদ (ছদ্মনাম) নামের আরেকজন। ক্রিকেটের এই সর্বনাশা জুয়া সম্পর্কে তিনি জানান, ১০০ টাকা থেকে শুরু হয়ে একপর্যায়ে চলে হাজার হাজার টাকার জুয়া। ব্যক্তিগত পর্যায়েও জুয়া হয়। আবার সিন্ডিকেটের মাধ্যমে জুয়ার কেনাবেচাও হয়। এ লোভেই নিঃস্ব হচ্ছেন শত শত তরুণ। সুদে টাকা নিয়ে জুয়ায় নামার নজিরও আছে। কীভাবে এই জুয়া খেলা হয় জানতে চাইলে তিনি বলেন, অনেকে এটাকে ‘ইস্টু’ খেলাও বলেন। প্রথম দিকে এই খেলা ছিল কোন দল জিতবে? এটার ওপর বাজি ধরতো সবাই। আস্তে আস্তে ওটার সঙ্গে শুরু হয় কোন খেলোয়াড় কত রান করবে? কত ওভারে কত রান হবে, পাওয়ার প্লে-তে কত রান আসবে, এই ক্রিকেটার হাফ সেঞ্চুরি না কি সেঞ্চুরি করবে, মোট রান কত হবে, টসে কোন দল জিতবে?- এসব নিয়ে’ একটি উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, যেমন ধরুন মুম্বাই ইন্ডিয়ানস আর রয়েল চ্যালেঞ্জারস ব্যাঙ্গালোর এবার ভালো দল। তাই এ দুই দলের খেলার দর ধরা হয় সমান। অর্থাৎ এক হাজার টাকা জুয়ায় জিতলে দুই হাজার টাকা পাওয়া যাবে। আবার রয়েল চ্যালেঞ্জারস ব্যাঙ্গালোরের সাথে কলকাতা নাইট রাইডারসের খেলা পড়লে খেলার দর হবে ১০:১৫। অর্থাৎ কলকাতার পক্ষে যারা এক হাজার টাকা বাজি ধরেছিলেন, জিতলে তারা আড়াই হাজার টাকা পাবেন। ভালো দলের সঙ্গে খারাপ দলের খেলা হলে দর কষাকষিটা হয় ভিন্নভাবে। খেলা শেষে এজেন্ট তার সুবিধাজনক স্থান ও সময়ে পরাজিত জুয়াড়ির কাছ থেকে টাকা নিয়ে জয়ী জুয়াড়ির কাছে হস্তান্তর করেন। এজেন্টরা জয়ী জুয়াড়ির কাছ থেকে টাকা হস্তান্তরের বিনিময়ে কমিশন পান বলেও জানান তিনি।
চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার ( গোয়েন্দা-উত্তর) শাহ মোহাম্মদ আবদুর রউফ আজাদীকে বলেন, পাড়ায় পাড়ায় চলতে থাকা বাজি বা জুয়ার ব্যাপারে আমরা কিছু প্রমাণ পেয়েছি। তবে এলাকাবাসীকেও বিষয়টি নিয়ে আরো সচেতন হতে হবে। যদি কারও কাছে এ ব্যাপারে অভিযোগ থাকে তাহলে আমাদের জানালে অ্যাকশন নেব এবং অভিযুক্তকে তাৎক্ষণিকভাবে গ্রেপ্তার করে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধইউপিডিএফ নেতাসহ ৫ জনের বিরুদ্ধে মামলা
পরবর্তী নিবন্ধহালদায় আবারো ভেসে উঠল মৃত ডলফিন