দেশের বাজারে শুধু পেঁয়াজের দর ঊর্ধ্বমুখী নয়, ভরা মৌসুমেও শীতকালীন সবজির দাম নাগালের বাইরে। বিশ্লেষকরা বলেন, ভরা মৌসুমেও যখন সবজির দাম ক্রেতার নাগালের বাইরে চলে যায়, তখন প্রশ্ন ওঠে বাজার তদারকি ও নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার কার্যকারিতা নিয়ে। সামনে রমজান মাস। এ সময়ে প্রতি বছরই এক শ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ী কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেয়। এ বাস্তবতায় বাজার নিয়ন্ত্রণে রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলোর সক্রিয় ও শক্ত ভূমিকা প্রয়োজন। কিন্তু ম্যাজিস্ট্রেট সংকটের কারণে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর নিয়মিত বাজার তদারকি করতে পারছে না। ফলে সিন্ডিকেট ও মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্যের কারণে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম ক্রমেই বাড়ছে। অক্টোবরের তুলনায় নভেম্বরে মূল্যস্ফীতি বেড়েছে। বাজার নিয়ন্ত্রণে জনবল সংকট নিরসনে সরকারের পদক্ষেপ নেয়া উচিত।
আসলে বাজার অস্থিরতা দীর্ঘ সময় ধরে চলছে। বিশেষ করে, বিগত সরকারের সময় ‘বাজার সিন্ডিকেট’ পেয়েছে সুবর্ণ সুযোগ। ইচ্ছামতো তারা সময়ে–অসময়ে পণ্যমূল্য বৃদ্ধি করে হাজার হাজার কোটি টাকা সাধারণ মানুষের পকেট থেকে তুলে নিয়েছে। যদিও চাহিদার অনুপাতে সরবরাহে কোনো ঘাটতি ছিল না। তবু পণ্য মজুদ করে সৃষ্টি করা হয়েছে কৃত্রিম সংকট। বিভিন্ন সমস্যার কথা বলে এই সিন্ডিকেট এখনো জনগণকে জিম্মি করে রেখেছে। যার হাত থেকে নিষ্কৃতি পাওয়া কঠিন। তারা বরাবর তৈলাক্ত থাকে। অত্যন্ত মসৃণ এবং পিচ্ছিল অথচ শক্তিশালী এই সিন্ডিকেটের সঙ্গে যে কোন শক্তিধররা থাকেন তা এক রহস্য।
পত্রিকান্তরে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের ম্যাজিস্ট্রেট–স্বল্পতার কারণে বাজার তদারকি কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। সিন্ডিকেটের প্রভাব মোকাবেলায় ম্যাজিস্ট্রেট–স্বল্পতা একটি গুরুতর প্রতিবন্ধকতা হিসেবে কাজ করছে। পর্যাপ্ত ম্যাজিস্ট্রেট না থাকায় নিয়মিত বাজার তদারকি সম্ভব হচ্ছে না। এ সুযোগে অসাধু ব্যবসায়ী ও মধ্যস্বত্বভোগীরা সহজেই সিন্ডিকেট গড়ে তুলে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করছে। বিশেষ করে পেঁয়াজ, চাল, তেল ও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের ক্ষেত্রে এসব সিন্ডিকেট মজুদদারি ও যোগসাজশের মাধ্যমে দাম বাড়িয়ে ভোক্তাদের জিম্মি করছে।
ম্যাজিস্ট্রেটের সংখ্যা কম হওয়ায় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের অভিযান সীমিত এলাকাভিত্তিক ও অনিয়মিত হয়ে পড়ছে। একবার অভিযান শেষ হলে দীর্ঘ সময় ওই এলাকায় আর নজরদারি না থাকায় সিন্ডিকেট আবার সক্রিয় হয়ে ওঠে। ফলে শাস্তির ভয় কার্যত কমে যায় এবং আইন প্রয়োগের ধারাবাহিকতা নষ্ট হয়। এ দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে বাজারে কারসাজি আরো প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নিচ্ছে। সব মিলিয়ে বলা যায়, ম্যাজিস্ট্রেটের অপ্রতুলতা বাজারে সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য বাড়িয়ে দিচ্ছে এবং ভোক্তা স্বার্থকে মারাত্মকভাবে ক্ষুণ্ন করছে। কার্যকর বাজার নিয়ন্ত্রণ, ন্যায্যমূল্য নিশ্চিতকরণ এবং সিন্ডিকেট ভাঙতে হলে জরুরি ভিত্তিতে ম্যাজিস্ট্রেটের সংখ্যা বাড়ানো ও নিয়মিত নজরদারি জোরদার করা ছাড়া বিকল্প নেই।
বিশেষজ্ঞদের মতে, সাধারণভাবে দ্রব্যমূল্যের বৃদ্ধি বা হ্রাস পাওয়ার বিষয়টি নির্ভর করে বাজারে পণ্যের চাহিদা ও সরবরাহের ওপর। চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম থাকলে পণ্যের দাম বাড়তেই পারে। কিন্তু আমাদের দেশে এ নিয়ম খাটছে না। দেখা যায়, পণ্যের পর্যাপ্ত আমদানি ও সরবরাহ থাকলেও তা বেশি দামে বিক্রি হয়। দ্রব্যমূল্যের এই অযৌক্তিক বৃদ্ধির পেছনে কাজ করে বাজার সিন্ডিকেট বা চক্র। তারা যোগসাজশের মাধ্যমে পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেয়। কখনো কখনো তারা পণ্যের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে। নানা অজুহাত তুলেও বাড়ানো হয় পণ্যের দাম। এ অবস্থায় বেশি দামে পণ্য ক্রয় করা ছাড়া ভোক্তাদের কোনো উপায় থাকে না।
এভাবে দ্রব্যমূল্য, বিশেষত নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধি করা অপরাধ বটে। এজন্য সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের শাস্তি হওয়া উচিত; কিন্তু আমাদের দেশে এ ধরনের ঘটনা বিরল। ফলে কারসাজি করে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির বিষয়টি যেন নিয়মে পরিণত হয়েছে। অসাধু ব্যবসায়ীদের এ প্রবণতা প্রতিরোধ করার দায়িত্ব সরকারের। অসাধু ব্যবসায়ীরা কায়েমি স্বার্থে ইচ্ছেমতো নিত্যপণ্যের দাম বাড়িয়ে দেওয়ার অপচেষ্টা চালালে সরকার যেন হাত গুটিয়ে বসে না থাকে, সেই প্রত্যাশা সাধারণ মানুষের। আমরাও চাই, বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা গ্রহণ করুক।






