এ কথা বলা বাহুল্য যে, পণ্যের দাম অনেকটা নির্ভর করে বাজার ব্যবস্থাপনার ওপর। উৎসব বা বিশেষ বিশেষ সময়ে কিছু কিছু পণ্যের চাহিদা বাড়ে। আর চাহিদা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে পণ্যের মূল্যও বাড়তে থাকে। অর্থনীতিবিদরা বলেন, আমরা যদি সরবরাহ ব্যবস্থাকে ভালো রাখতে পারি, তাহলে সেই চাহিদাটা মূল্যবৃদ্ধির দিকে যাওয়ার কথা নয়। কিন্তু আমরা দেখি অনেকে এই সুযোগটা নিয়ে মজুতদারি করেন। এ কারণে বাজারে পণ্যের দাম বাড়ে। মজুতদারি যাতে না হয় সেদিকে নজরদারি করতে হবে। দুঃখজনক হলেও সত্যি যে আমাদের বাজার ব্যবস্থাপনায় নজরদারি, খবরদারির ক্ষেত্রে দুর্বলতা থাকে। বিশেষজ্ঞরা বলেন, আন্তর্জাতিক বাজার, শুল্ক এবং এক্সচেঞ্জ রেট বা বিনিময় হারের সমন্বয়ে আমদানি মূল্য নির্ধারিত হয়।
আমদানি পর্যায় থেকে একটি পণ্য যখন খুচরা পর্যায়ে আসে, তখন মধ্যস্বত্বভোগীরা বাজারের ওপর নানাভাবে প্রভাব বিস্তার করে। কোনো সময় সিন্ডিকেশন করে, কোনো সময় তারা নিজেরাই এগুলো করে। কিন্তু আমরা দেখি যে আমদানি পর্যায়ে দাম এবং ভোক্তা পর্যায়ের দামের মধ্যে একটা বড় পার্থক্য থাকে। একই রকম দেখি স্থানীয় পণ্যের ক্ষেত্রে উৎপাদক পর্যায়ে এবং ভোক্তা পর্যায়ে। এ জন্য বাজার ব্যবস্থাপনা এখানে গুরুত্বপূর্ণ। স্থানীয় কিংবা আমদানি যেকোনো পণ্য যখন সড়ক কিংবা নৌপথে আসে, তখন এগুলোতে নানা ধরনের চাঁদাবাজি হয়। এই বিষয়গুলোতেও জিরো টলারেন্স দরকার। যাঁরা পণ্য আমদানি করছেন, আমরা জানি কত টাকা তাঁদের লেগেছে। অনেক সময় ভোক্তা পর্যায়ে মজুতদারি করে বাজারে সরবরাহ ঠিকমতো করা হয় না। এ ছাড়া আগাম ব্যবস্থাপনায়ও নজর দেওয়া দরকার। আগাম ব্যবস্থাপনা মানে হলো আমার চাহিদা কত, সরবরাহ কত, আমার চাহিদা বাড়তে পারে কতটুকু–এগুলো একটা বিশ্লেষণেরও জায়গা। আমাদের দেশে এ ধরনের বিশ্লেষণগুলো ঠিকমতো করা হয় না। তারপর হলো সরকারের নিজস্ব স্টক ম্যানেজমেন্ট এবং টিসিবি। এটা দিয়েও তারা বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। এখন যেমন সরকার কিছু নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য এক কোটি মানুষকে দিতে যাচ্ছে। মাছের খাবারের দাম বেড়েছে, বেড়েছে ধান উৎপাদনের খরচও। এগুলো সহনীয় পর্যায়ে রাখতে হলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা বাজেটে নিতে হবে। এ জন্য নীতিনির্ধারকদের ভাবতে হবে। সবার আগে বাজারদর এবং বাজার ব্যবস্থাপনা ঠিক রাখার জন্য পদক্ষেপ নিতে হবে।
আমরা জানি, বাজার ব্যবস্থাপনার শৃঙ্খলা রক্ষার্থে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরসহ বিভিন্ন সংস্থার সদস্যদের উপস্থিতিতে নানা সময়ে বৈঠক হয়ে থাকে। কিন্তু এসব বৈঠকের কোনো সুফল ভোক্তা শ্রেণি পায় না, বৈঠকের সুফল পায় ব্যবসায়ী শ্রেণি। আসলে ভোক্তার স্বার্থরক্ষা করতে হলে সরকারের পক্ষ থেকে যে প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ তৈরি করার কথা, তা হচ্ছে না। ফলে কিছু ব্যক্তি–গোষ্ঠীর হাতেই চলে যাচ্ছে নিত্যপণ্যের বাজারের নিয়ন্ত্রণ। তারা কারসাজি করলেও সরকারের তখন আর কিছু করার থাকে না। এই পরিস্থিতির অবসান ঘটাতে হবে। মুক্তবাজার অর্থনীতির মানে এই নয় যে, ব্যবসায়ীরা যা ইচ্ছা তা–ই করবে আর সরকার চেয়ে চেয়ে তা দেখবে। বস্তুত, বাজার ব্যবস্থাপনায় শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হলে সরকারের কঠোর অবস্থানের কোনো বিকল্প নেই। বাণিজ্যমন্ত্রী এবং সংশ্লিষ্টরা শুধু মুখেই বলে চলেন, অসাধু পন্থা নেওয়া হলে সংশ্লিষ্টদের শাস্তির আওতায় আনা হবে। কিন্তু বাস্তবে কেউ শাস্তি পায় না।
বিশেষজ্ঞদের অভিমত হলো, বর্তমানে বাজারে দ্রব্যমূল্য অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছেছে। প্রতিদিনই কোনো না কোনো পণ্যের দাম বাড়ছে। করোনাভাইরাস মহামারির পর বাজারে সব ধরনের পণ্যের দাম বাড়ার ফলে মধ্যবিত্ত ও নিম্ন আয়ের মানুষ হিমশিম খাচ্ছেন। টাকার অবমূল্যায়ন হয়েছে, ডলারের দাম বেড়েছে। আবার ডলার–সংকটও হয়েছে। সব মিলিয়ে মানুষ স্বস্তিতে নেই। কারখানাগুলোতে উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে। ফলে জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে। ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের প্রণোদনা দিয়ে টিকিয়ে রাখতে হবে। আমরা মনে করি, মানুষের ক্রয়ক্ষমতা ঠিক রাখার জন্য ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। কম গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়ন প্রকল্প বন্ধ করে কৃষক, শ্রমিক, মেহনতি মানুষের স্বার্থ দেখতে হবে। বিদ্যুৎ, জ্বালানি তেল, গ্যাস, ভোজ্যতেল, চিনি, পেঁয়াজসহ সব ধরনের মসলার দাম সহনীয় পর্যায়ে রাখতে পদক্ষেপ নিতে হবে।