সরকারি গুদামে চালের মজুদ যত দ্রুত কমছে, বাজারে চালের দাম তত দ্রুত বাড়ছে। চালের বাজার স্থিতিশীল রাখতে শুল্ক কমিয়ে বেসরকারি খাতেও চাল আমদানির সুযোগ করে দিয়েছে সরকার। তবে আমদানি হবে নিয়ন্ত্রিত। করোনার কারণে গোটা বিশ্বেই খাদ্যশস্যের বাজার ঊর্ধ্বমুখী, যা করোনার প্রাদুর্ভাবের শুরুতেই বিশ্ব খাদ্য সংস্থা আশঙ্কা করছিল। চলতি বছর সরকার অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি পরিমাণ ধান চাল অভ্যন্তরীণভাবে সংগ্রহের উদ্যোগ নিয়েও সফল হতে পারেনি। ফলে সরকারি গুদামে চালের মজুদ সাড়ে পাঁচ লাখ টনের নিচে এসে দাঁড়িয়েছে। অভিজ্ঞতা বলে, সরকারি গুদামে চালের মজুদ যখন বেশ কমে যায়, তখন বাজারে এর নেতিবাচক প্রভাবে চালের বাজারে এর নেতিবাচক প্রভাবে চালের দাম বাড়ে। প্রশ্ন হলো, খাদ্য অধিদপ্তর ধান চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে ব্যর্থ হচ্ছে কেন? সরকার ধান ও চালের যে দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে, ধান-চাল ব্যবসায়ী ও চালকল মালিকরা সেই দামে খাদ্য অধিদপ্তরের কাছে তা বিক্রি করতে রাজি হননি। কারণ বাজারে ধান-চালের দাম বেশি। চলতি বছর বন্যার কারণে আমন ধানের উৎপাদন প্রায় ১৫ লাখ টন কম হবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও দেশের মোট চাহিদার তুলনায় চালের সামগ্রিক মজুদ এত কম নয় যে সেজন্য দাম এত দ্রুত বাড়বে। এই বাড়তির আংশিক কারণ সরকারি গুদামে চালের মজুদ গত বছরের একই সময়ের তুলনায় অর্ধেকে নেমে এসেছে। এখন করণীয় হলো দ্রুত সরকারি মজুদ বাড়ানো। সরকারিভাবে আপদকালীন খাদ্য মজুদ বাড়াতে জিটুজি পদ্ধতিতে কিছু চাল আমদানি করা প্রয়োজন। সরকার উদ্যোগ নিয়েছে বটে, তবে সেটি কবে আসবে তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। এর মধ্যে বাজার নিয়ন্ত্রণে চাল আমদানির শুল্ক কমিয়ে বেসরকারি খাতকে উৎসাহিত করা হলো। এটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত বটে। তবে খেয়াল রাখতে হবে অতীতের মতো সংকটের সুযোগ নিয়ে অতিরিক্ত আমদানি যেন না হয়। এতে ধানের দাম কমে গিয়ে কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হবে। চালের বাড়তি দামের সুবিধা কৃষকের কাছে পৌঁছানো নিশ্চিত করা গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশকে কেন্দ্র করে একটি বৈশ্বিক প্রবণতা ও বিবেচনায় রাখা প্রয়োজন। থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, মিয়ানমার, ভারতসহ চাল রফতানিকারক দেশগুলো যদি দেখে আমাদের দেশে চালের ঘাটতি আছে, তখন তারাও দাম বাড়িয়ে দেয়। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় দেখা গেছে বাংলাদেশের চালের চাহিদা বাড়লেই রফতানিকারক দেশগুলো দাম বাড়িয়ে দেয়। তাদের প্রবণতা হলো, বিশ্ববাজারে চালের দাম নির্ধারণে বাংলাদেশকে ডিটারমাইনিং ফ্যাক্টর হিসেবে বিবেচনা করা। এরই মধ্যে খবর মিলছে, তিন দশক পর ভারত থেকে চাল আমদানি করতে যাচ্ছে সর্বোচ্চ চাল উৎপাদনকারী দেশ চীন। এখান থেকে প্রতীয়মান হয়, আগামীতে চালের আন্তর্জাতিক বাজার অস্থির হয়ে উঠতে পারে। এক্ষেত্রে অভ্যন্তরীণ উৎপাদন ও মজুদের সঠিক তথ্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এক্ষেত্রে অতিরিক্ত আমদানি যেমন কৃষককে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে আবার চাহিদা অনুযায়ী যোগান না থাকলে ভোক্তাকে বেশি দামে চাল কিনতে হবে। বাজার ভারসাম্য প্রতিষ্ঠায় সরকারকে ত্বরিৎ এবং সুবিবেচনাপ্রসূত সিদ্ধান্ত নিতে হবে। উৎপাদনের দিকে দৃষ্টি রেখে আমদানির দ্বার যেমন উন্মুক্ত রাখতে হবে, তেমনি বাজার মনিটরিং বাড়াতে হবে। অনেক সময় সঠিক তথ্যের ঘাটতি থাকে বিধায় সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে ফ্যাক্ট চেকের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণভাবে খাদ্যশস্যের উৎপাদন, আমদানি রফতানি, অভ্যন্তরীণ ও বিশ্ব বাজারে চালের দাম ইত্যাদি বিষয়ে আর্লি ওয়ার্নিং সিস্টেমে সক্রিয়ভাবে কাজ করে যেতে হবে। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে আমদানি করে সাময়িকভাবে খাদ্যের মজুদ বাড়ানোর চিন্তা যেমন করা দরকার তেমনি ভবিষ্যৎ খাদ্যোৎপাদন আরো বাড়ানোর দিকেও মনোযোগ দেয়া দরকার সাম্প্রতিক বছরগুলোয় খাদ্যশস্য উৎপাদন বাড়ানোর ক্ষেত্রে আমাদের দুটি সীমাবদ্ধতা তৈরি হয়েছে। প্রথমটা হলো, কৃষিজমি দ্রুত কমে যাওয়া। দ্বিতীয়টা কৃষকের উৎসাহজনক মূল্য না পাওয়া জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব তো রয়েছেই। এসব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে চালের বাজার স্থিতিশীল রাখা, সরকারি মজুদ বৃদ্ধি ও কৃষক-ভোক্তা উভয়কে সন্তুষ্ট রাখতে সমন্বিত পরিকল্পনার বিকল্প নেই। এক্ষেত্রে নির্ভুল তথ্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রতি বছরই ধান-চালের তথ্য পরিসংখ্যান ও বাজার পরিস্থিতি নিয়ে বিব্রত কর অবস্থায় পড়তে হচ্ছে। এখান থেকে পরিত্রাণে একটি শক্তিশালী মনিটরিং সেল গঠন করা আবশ্যক। তাদের কাজ হবে অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি ও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি অনুযায়ী যথাযথ ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ প্রদান। এ আলোকে খাদ্য মন্ত্রণালয় যথাযথ পদক্ষেপ নেবে। এক্ষেত্রে কৃষি মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে খাদ্য ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সমন্বয় আরো জোরদার করা দরকার। করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে চাল আমদানি বাজার আরো সংকুচিত হতে পারে। সুতরাং বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে কূটনৈতিক তৎপরতা বাড়িয়ে দ্রুত তার সঙ্গে কোন কোন দেশ থেকে চাল আমদানি করা যায় তার ব্যবস্থা নিতে হবে। নিয়মিত বাজার নজরদারি ও গুরুত্বপূর্ণ। সরকারি গুদামে চালের মজুদ সামাজিক ও আর্থিক স্থিতিশীলতার রক্ষাকবচ। গোডাউনে পর্যাপ্ত পরিমাণ চাল রাখার একটা মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব আছে। সরকারের কাছে চাল আছে, এ তথ্যই বাজারকে স্থিতিশীল রাখে।