রমজানের বাড়তি চাহিদার কথা মাথায় রেখে প্রচুর পরিমাণ সয়াবিন তেল আমদানি হয়েছে। আমদানি হয়েছে সয়াবিন সিডও। কিন্তু বাজারে সয়াবিন তেলের সংকট দেখা দিলেও বিপুল পরিমাণ সয়াবিন সিড (তেল উৎপাদনের মূল উপকরণ) অনেকগুলো জাহাজে রয়েছে। বিভিন্ন গন্তব্যে পৌঁছার পরও খালাস না করে জাহাজে মজুত করে রাখা সয়াবিন সিডের পরিমাণ ৮৯ হাজার ৮৫০ টন; যা দ্রুত খালাস করা হলে বাজারে তেলের সংকট অনেকাংশে কমতে পারে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, একসময় দেশের ভোজ্যতেলের বাজারে বড় বড় আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান থাকলেও বর্তমানে হাতে গোনা দুয়েকটি প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণে চলে এসেছে। আলোচিত প্রতিষ্ঠান এস আলম গ্রুপ ভোজ্যতেলের একটি বড় অংশের নিয়ন্ত্রক ছিল। তারাও অনেকটা কোণঠাসা হয়ে রয়েছে। এতে করে বর্তমানে ভোজ্যতেলের বাজার নিয়ন্ত্রণে কয়েকটি ছোট প্রতিষ্ঠানের সাথে দু–তিনটি বড় প্রতিষ্ঠান যুক্ত হয়েছে। ফ্রেশ গ্রুপ ও বিশ্বাস গ্রুপ এমন দুটি প্রতিষ্ঠান। এ দুটি গ্রুপ উল্লেখযোগ্য পরিমাণ সয়াবিন সিড আমদানি করলেও এর একটি বড় অংশ জাহাজে রয়েছে।
সূত্র জানিয়েছে, গতকালের হিসাব অনুযায়ী, বিশ্বাস গ্রুপের সয়াবিন সিড বোঝাই ৪৪টি লাইটারেজ জাহাজ বিভিন্ন নদী বন্দরে ভাসছে। এর মধ্যে রূপসী ঘাটে রয়েছে তাদের ৮টি জাহাজ, আশুগঞ্জ ঘাটে ২টি, কাঁচপুর ঘাটে ২৯টি, নগরবাড়ী ঘাটে ২টি, ঝালকাঠি ঘাটে ১টি, পাগলা ঘাটে ১টি এবং নিতাইগঞ্জ ঘাটে ১টি সয়াবিন সিড বোঝাই জাহাজ ভাসছে। ফ্রেশ গ্রুপের আমদানি করা সয়াবিন সিড নিয়ে ১২টি জাহাজ অলস ভাসছে। এর মধ্যে দাউদকান্দি ঘাটে ১টি, তৈলব ঘাটে ১টি, মেঘনা ঘাটে ৯টি এবং পটুয়াখালী ঘাটে ১টি জাহাজ সয়াবিন সিড নিয়ে ভাসছে। এসব সিড থেকে সয়াবিন উৎপাদন করে বাজারে ছাড়া হলে তা ইতিবাচক প্রভাব ফেলত বলে সূত্রগুলো মন্তব্য করেছে।
বাজার বিশ্লেষকদের মতে, দেশে সয়াবিন তেলের চাহিদা বাড়লেও আমদানিকৃত কাঁচামাল বন্দরে পড়ে থাকায় বাজারে তেলের সরবরাহ কমে যাচ্ছে। ফলে দামও বৃদ্ধি পাচ্ছে। তারা বলেন, জানুয়ারি মাসে সয়াবিন তেল আমদানি হয়েছে ১ লাখ ১৭ হাজার টন, যা দেশের গড় মাসিক চাহিদা ৮৭ হাজার টনের তুলনায় প্রায় ৩৪ শতাংশ বেশি। একই সময়ে সয়াবিন বীজ আমদানি হয়েছে ৩ লাখ টন, যা থেকে প্রায় ৪৫,০০০ টন সয়াবিন তেল উৎপাদিত হয়েছে।
তেলের এত যোগান থাকার পরও বাজার অস্থিতিশীল ছিল। ফেব্রুয়ারি মাসেও ৮০ হাজার টনের বেশি সয়াবিন তেল আমদানি হয়েছে। মার্চ মাসে চট্টগ্রাম বন্দরে পাঁচটি ট্যাংকারে ৭৮ হাজার টন সয়াবিন তেল আমদানি হয়েছে। রমজানের প্রথম সপ্তাহের মধ্যে আরো প্রায় ৫০ হাজার টন তেল এসেছে। এত তেল আসার পরও বাজার নিয়ে থেমে নেই কারসাজি। আমদানিকৃত সয়াবিন বীজ থেকে তেল উৎপাদন প্রযুক্তি দেশের খুব বেশি কোম্পানির কাছে নেই। হাতে গোনা কয়েকটি কোম্পানি সয়াবিনের বীজ থেকে তেল উৎপাদন করে। তারা বাই প্রোডাক্ট দিয়ে মৎস্য ও পশু খাদ্য উৎপাদন করে। জানা যায়, সাধারণত সয়াবিন বীজ থেকে প্রায় ১৮ থেকে ২০ শতাংশ তেল পাওয়া যায়। অর্থাৎ ১ টন সয়াবিন বীজ থেকে প্রায় ১৮০ থেকে ২শ কেজি তেল উৎপাদিত হয়। অবশিষ্ট অংশ হিসেবে যে সয়ামিল পাওয়া যায় তা পোলট্রি, গবাদি পশু ও মাছের খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
বাংলাদেশ ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট কো–অর্ডিনেশন সেলের (বিডব্লিউটিসিসি) লাইটার জাহাজের মাধ্যমে গত বছরের ডিসেম্বর থেকে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত তিন মাসে আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান নারিশ ট্রেডার্স ১১ হাজার টন, নাহার এগ্রো ৩ হাজার ৮৫০ টন, মীরসরাই ট্রেডার্স ৪ হাজার ৯৫০ টন, এবি ট্রেড ৬ হাজার ৩০০ টন, হেলাল ব্রাদার্স ৩ হাজার ৯৬০ টন, প্যারাগন ৫৫ হাজার টন, সুস্মা ফুড ৫৫ হাজার টন, আরবি ৬ হাজার ৩শ টন, ফ্রেশ ৬২ হাজার ১শ টন এবং বিশ্বাস ৯৫ হাজার ৫৫০ টন সয়াবিন সিড পরিবহন করেছে বলে জানিয়েছেন বিডব্লিউটিসিসির নির্বাহী পরিচালক মেজর (অব.) জি এম খান।
বাজারে সয়াবিন তেলের সংকটের পেছনে অবৈধ মজুতদারি, বাজার ব্যবস্থাপনায় সংকট, সরবরাহ চেইনে বিঘ্নসহ বেশ কিছু কারণ রয়েছে। সরকার কঠোর পদক্ষেপ নিলে দ্রুত তেলের দাম সহনীয় পর্যায়ে নেমে আসবে বলে সূত্র জানিয়েছে।
ভোক্তারা অভিযোগ করেছেন, সংকটের সুযোগ নিয়ে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী তেলের দাম বাড়িয়ে দিচ্ছেন। অথচ জাহাজে থাকা বিপুল পরিমাণ কাঁচামাল যদি দ্রুত খালাস হয়, তাহলে সরবরাহ বেড়ে বাজারে স্থিতিশীলতা ফিরে আসবে।
জেলা প্রশাসনের এক কর্মকর্তা জানান, বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে এবং দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের প্রতিবেদনের উদ্ধৃতি দিয়ে সূত্র জানায়, দেশে বছরে ভোজ্যতেলের চাহিদা রয়েছে ২৩ থেকে ২৪ লাখ টন। এর মধ্যে রমজানে চাহিদার পরিমাণ ৩ লাখ টন। ১ জানুয়ারি ২০২৪ থেকে ৫ জানুয়ারি ২০২৫ পর্যন্ত আমদানি হয়েছে ১৮ লাখ ৫৭ হাজার ৫৪৮ টন। এছাড়া দেশীয় উৎপাদন করা হয় ২ লাখ ৫০ হাজার টন। আমদানি পর্যায়ে এখনো পাইপলাইনে আছে ৮ লাখ ১২ হাজার ৫৬৫ টন। আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্য নিম্নমুখী হওয়ায় স্থানীয় বাজারে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। ট্যারিফ কমিশনের এ প্রতিবেদন অনুযায়ী সয়াবিন তেলের দাম নিম্নমুখী হওয়ার কথা। কিন্তু উলটো বাড়ছে।
চট্টগ্রাম চেম্বারের সাবেক পরিচালক মাহফুজুল হক শাহ গতকাল আজাদীকে বলেন, ৫–৭ বছর আগেও ১২ থেকে ১৪টি কোম্পানি তেল আমদানি করত। বর্তমানে তা ৪–৫টিতে নেমে এসেছে। কিন্তু কী পরিমাণ তেল প্রয়োজন, কী পরিমাণ তেল আসছে তা মনিটরিং হচ্ছে না বলে মনে করেন তিনি। এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজলে তেল মজুতের আসল রহস্য বেরিয়ে আসবে। তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম কমছে। অথচ দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমাদের বাড়ছে।