বাজলো তোমার আলোর বেণু

কুমুদিনী কলি | শুক্রবার , ২০ অক্টোবর, ২০২৩ at ৫:২২ পূর্বাহ্ণ

হেমন্তের পয়লা প্রসঙ্গ! কচি হেমন্ত! শরতের মতো হেমন্তেরও খুব অল্প সময়ের জন্য আসা। শরৎ, হেমন্তের ব্যাপারটাই অন্যরকম। কেমন আলাদা। দক্ষিণের জানালায় এলিয়ে পড়া রোদের লুটোপুটিতে ঘরময় আলো ছড়িয়ে পড়া। রোদে যেনো সোনারঙ উপচে পড়ছে। সেই সোনারোদে কেমন একটা নরম নরম উষ্ণতা থাকে। সোনারোদে দখিন হাওয়ার মাখামাখিআর উঠোন ভরা শিউলি, চাঁপার শেষ সময়ে দুএকটা স্বর্ণচাঁপার গাছ আলো করা সৌন্দর্য।

এই সেদিন দেখলাম, ভরা বর্ষার শেষে এই পয়লা হেমন্তে গাছ আলো করে ফুটে আছে কামিনী ফুল। ছাতিমের শাখায় শাখায় প্রস্তুতি শুরু হলো বলে, বুনো ছাতিমের সেকি সুবাস! থমকে দাঁড়াতে হয়! ঝকঝকে নীলাকাশ, কাশফুল আর নদীজল, বাতাসে কীসের যেনো টান, হাওয়ায় যেনো মাদকতা ছড়ানো।

শরতের প্রথম এবং প্রধান আকর্ষণ দুর্গাপূজা। যদিও পঞ্জিকা অনুযায়ী শরতের দুর্গাপূজা এবার হেমন্তের শুরুতেই। তবুও শরতের রেশ থেকেই যায়। শরতের সমগ্র প্রকৃতি এত নিপুন সাজে সজ্জিত হয়ে থাকে, মনে হয় প্রকৃতিমাতা তার সমস্ত সৌন্দর্য দিয়ে দেবী দুর্গাকে বরণ করে নেয়। চারিদিকে সাজ সাজ রব। প্রিয় শহর, গ্রাম, মফস্বল সেজে উঠছে দেবীকে বরণে। কী অক্লান্ত পরিশ্রম সবার, নির্ঘুম রাত। তারপরও ক্লান্তিহীন, মা আসছে! চারিদিকে কেবল তাঁর আগমনী বার্তা! দুর্গাপূজার আগে মহালয়া একটা বিশেষ, তাৎপর্যপূর্ণ দিন। পিতৃপক্ষ আর দেবীপক্ষের মধ্যিখানে এই দিনটি মহালয়া নামে পরিচিত। মহালয়ার দিন তিল তর্পণ করার মধ্যদিয়ে মর্ত্যবাসী মানুষ স্বর্গীয় পূর্বপুরুষদের আত্মার শান্তি কামনা করেন আর তাঁদের আশীর্বাদ প্রার্থনা করেন।

মহালয়ার পরদিন থেকেই মূলত দুর্গাপূজার শুরু, যা শেষ হয় দশমীর বিসর্জনে। বাঙালির বহু প্রতীক্ষিত মিলনমেলা এই দুর্গাপূজা। শারদীয় দুর্গাপূজা অকালবোধন নামেও পরিচিত। বসন্তকালেও দেবী দুর্গার বাসন্তী রূপকে পূজা করা হয়, তা বাসন্তী পূজা নামে সমাদৃত। প্রকৃতপক্ষে, বাসন্তী পূজাই আদি পূজা হিসেবে যুগ যুগ ধরে প্রচলিত হয়ে এসেছে। কিন্তু রামরাবণের যুদ্ধে বিজয়ী হবার জন্য রাম দেবীর এই অকালবোধনের আয়োজন করেন, ত্রেতা যুগে। সেই থেকে অকালবোধনের এই শারদীয় দুর্গাপূজা বাসন্তী পূজাকেও ছাপিয়ে যায়, আর রূপ নেয় এক সামাজিক উৎসবে। যেখানে জাতিধর্মবর্ণ নির্বিশেষে সবাই অংশ নেয়।

মহালয়ার ভোরে ধূপ, প্রদীপ জ্বালিয়ে মর্ত্যবাসীরা দেবী দুর্গাকে বরণ করে নেয়। মহালয়ার ঊষালগ্নে বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্রের সেই দরাজ কণ্ঠে মহিষাসুর মর্দিনী না শুনলে বাঙালির পূজা যেনো শুরু হতেই চায় না। এ যেনো প্রতিটি বাঙালির চিরায়ত অভ্যেস। সেই চণ্ডীপাঠ, সেই দরাজ কণ্ঠে ‘বাজলো তোমার আলোর বেণু’ ছড়িয়ে পড়ে ভোরের আকাশে বাতাসে।

ঊষালগ্নের মাদকতায় মোড়ানো স্বর্গীয় পরিবেশ, হিম হিম হাওয়া, শিউলির সৌরভ, গৃহস্থ বাড়ির মন্দিরে জ্বলে ওঠা ধূপের গন্ধ চোখ ভিজিয়ে দেয়।

মহালয়ায় পূজার প্রারম্ভ মানেই দশমীর বিসর্জনের দিকে তিলে তিলে এগিয়ে যাওয়া। তাই পুজো আসি আসি করা দিনগুলোই বেশ ভালো। আসা মানেই তো যাবার তোড়জোড় শুরু! তাই এই অপেক্ষাটুকুই ভালো। প্রতিটা মুহূর্তের অপেক্ষা। মহামায়ার আগমনের অপেক্ষা। তাঁকে ঘিরে সাধারণ সবার উন্মাদনা। পুজোর পাঁচটা দিনের অপেক্ষা! পাঁচদিনের শেষে বিসর্জনের মধ্য দিয়ে মন আকুল করা বিদায়! একবছরের অপেক্ষার অবসান। তাই এমন ঘটা করে শুরু না হওয়াটাই আমার জন্য বেশ মঙ্গলজনক। শুরু করলেই তো শেষের পথে একধাপ এগিয়ে যাওয়া। পায়ে পায়ে বিসর্জনের বিদায়ী লগ্নে এগিয়ে যাওয়া! চোখের জলে নবমীর রাতে শেষবারের মতো মহামায়ার অনন্ত অসাধারণ মুখখানি দেখে নেয়া। রাত পেরোতেই বিজয়া দশমীর বিদায়ঘণ্টা বেজে ওঠে। ইচ্ছে করে রাতটুকু রাত হয়েই থাকুক, ভোর যেনো না হয়! তাই অন্তরাত্মার আকুল আবেদনে মন বলে ওঠে-‘পোহাইয়ো না নবমীর নিশি!

পূর্ববর্তী নিবন্ধমায়ের আগমনী
পরবর্তী নিবন্ধআখেরাতের প্রস্তুতি