আমরা সবাই নকশিকাঁথা পছন্দ করি। প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী নকশিকাঁথা এখন স্থান করে নিয়েছে বিশ্বের দরবারে। নকশিকাঁথা আমাদের দেশীয় ঐতিহ্য, আমাদের অহংকার। এদেশের কারুশিল্পীদের নিপুন হাতের অনবদ্য সৃষ্টি। সেই আদিকাল থেকে আজ অবধি নকশিকাঁথার আবদার একটুও কমেনি। বরং সময়ের বিবর্তনে নকশিকাঁথার চাহিদা আরও বেড়েছে। যুক্ত হয়েছে আধুনিক ফ্যাশনেবল সব ডিজাইন আর নতুন নতুন নকশা। বর্তমানে ঘরের বিছানাতে শোভা আনতে নকশিকাঁথার জুড়ি মেলা ভার। নকশিকাঁথা হলো সাধারণ কাঁথার উপর নানা ধরনের নকশা করে বানানো বিশেষ প্রকারের কাঁথা। নকশিকাঁথা ভারত এবং বাংলাদেশের লোকশিল্পের একটা অংশ।
সূচিকর্মে অলঙ্কৃত কাঁথাকে বলা হয় নকশিকাঁথা। অনেক জায়গায় নকশিকাঁথাকে সাজের কাঁথা বা নকশি খেতাও বলা হয়ে থাকে। পুরনো এবং প্রারম্ভিক পর্বের কাঁথা হত সহজ, সরল, যা চলমান ফোঁড়ে বানানো হত। কালের আবর্তে কাঁথার ফোঁড় বা সেলাইয়ে নানা বৈচিত্র্য যোগ হয়েছে। সাধারণ কাঁথায় অন্তপুরবাসীনী নারী তার মনের মাধুরী মিশিয়ে তাকে শিল্পে রূপ দিয়েছে। তার ঘর, তার বাইরের জগৎ, চিন্তা, ফুল, পাখি, লতাপাতা নকশা হয়ে স্থান পেয়েছে কাঁথায়, যার নাম হয়েছে নকশিকাঁথা।
সাধারণত পুরাতন কাপড়ের পাড় থেকে সুতা তুলে অথবা তাঁতীদের থেকে নীল, লাল, হলুদ প্রভৃতি সুতা কিনে এনে কাপড় সেলাই করা হয়। একাধিক পুরানো জিনিস একত্রিত করে নতুন একটি প্রয়োজনীয় জিনিস তৈরি করা হয়। কাঁথা তৈরির কাজে পুরানো শাড়ি, লুঙ্গি, ধুতি ইত্যাদি ব্যবহৃত হয়। প্রয়োজন অনুযায়ী কাঁথার পুরুত্ব কম বা বেশি হয়। পুরুত্ব অনুসারে তিন থেকে সাতটি শাড়ি স্তরে স্তরে সাজিয়ে নিয়ে স্তরগুলোকে সেলাইয়ের মাধ্যমে জুড়ে দিয়ে কাঁথা তৈরি করা হয়। ঘরের মেঝেতে পা ফেলে পায়ের আঙ্গুলের সঙ্গে কাপড়ের পাড় আটকিয়ে সূতা খোলা হয়। সাধারণ বা কাঁথাফোঁড়ে তরঙ্গ আকারে সেলাই দিয়ে শাড়ির স্তরগুলোকে জুড়ে দেয়া হয়। বিভিন্ন রঙের পুরানো কাপড় স্তরীভূত করা থাকে বলে কাঁথাগুলো দেখতে বাহারী রঙের হয়। সাধারণত শাড়ির রঙিন পাড় থেকে তোলা সুতা দিয়ে কাঁথা সেলাই করা হয় এবং শাড়ির পাড়ের অনুকরণে কাঁথাতে নকশা করা হয়। আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে নকশিকাঁথা। এ যেন লোকায়ত শিল্পদর্শনের মূর্ত প্রতীক।
নকশি কাঁথার প্রতিটি ফোঁড়ে জড়িয়ে আছে কত সুখ–দুঃখের কথা, কত জীবনের কথা, কত হাসি, কত কান্না, কত চোখের নোনা জল, কত হারানো বেদনার হাহাকার, কত জীবনের কত বিবর্ণ কথা, কত আবেগ কত সুরের মূর্ছনা, কত রমনীর বক্ষ ছেঁড়া করুণ আর্তনাদ, কত যুগ–জনমের হতাশা ব্যর্থতার গোপন চিত্র, কত প্রেম ভালোবাসার নিবেদন, কত বিরহিনীর কত বিরহ যন্ত্রণা, কত রমনীর প্রাণের গহীন উচ্ছ্বাস! সেই সবের খবর কে আর রাখে? নকশি কাঁথা দেখে চোখ জুড়ায়, মন ভরে। প্রাচীন আমল থেকে নকশি কাঁথা বাঙালির ইতিহাস ঐতিহ্যের স্বাক্ষর বহন করছে। বাঙালির প্রাণে প্রাণে মিশে আছে নকশিকাঁথার সৌন্দর্য। বাঙালি নারীর নিখুঁত রুচি আর নিখাঁদ ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ হচ্ছে নকশিকাঁথা। এটি বাঙালি নারীর প্রাণের স্পন্দন। এর সঙ্গে রয়েছে বাঙালি নারীর হৃদয়ের নিবিড় সখ্যতা। নকশিকাঁথা আর বাঙালি রমনীর জীবন যেন প্রাণে প্রাণে একাকার। এক একটি নকশিকাঁথা এক একটি ইতিহাস। হতে পারে অসংখ্য জীবনের ইতিহাস।
নকশিকাঁথা সাধারণত একদিনে তৈরি হয় না, সময় নিয়ে ধীরে ধীরে এতে কারুকার্য ফুটিয়ে তোলা হয়। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে এটি একসময়ে বাংলার নারীদের অবসরের অনুষঙ্গ ছিল। পূজা–পার্বণ কিংবা অন্য কোনো অনুষ্ঠানে উপহার হিসেবে দেওয়ার নজিরও পাওয়া যায়। বাংলার প্রবাদে, গল্প, গানে কিংবা কবিতায় অমর হয়ে আছে নকশিকাঁথা। আছে পল্লীকবি জসীম উদদীনের আখ্যানকাব্য ‘নকশিকাঁথার মাঠ’। এই আখ্যানকাব্য দিয়েই বাংলা সাহিত্যে উঠে এসেছে কীভাবে কাঁথায় সূচের প্রতিটি পরতে পরতে ফুটে উঠতে পারে ভালোবাসা আর বেদনার কাহিনি।
নকশি কাঁথার বেশির ভাগ এখন ভারত ও বাংলাদেশে উৎপাদন হয় বাণিজ্যিক ব্যবহারের উদ্দেশ্যে, অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক বাজার উভয়ের জন্যেই। গ্রামের বুননকারীদের দিয়ে কাঁথা বানিয়ে এনে কাঁথা এখন বাণিজ্যিকভাবেই ক্রয় বিক্রয় হয়। মেশিনে তৈরি জিনিসপত্রের প্রাচুর্য এবং রুচির পরিবর্তন এক সময়ের শিল্পসমৃদ্ধ এ নকশিকাঁথাকে বিলুপ্তির দিকে নিয়ে যায়। তবে বর্তমান বছরগুলিতে বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গে নৃতাত্ত্বিক শিল্পকলার প্রতি মানুষের আগ্রহ কাঁথাশিল্পের পুনরুজ্জীবনে উৎসাহের সৃষ্টি করেছে। আর্থসামাজিক পরিবর্তনের সাথে সাথে কাঁথাও হারিয়ে যেতে বসেছিল। যুগ যুগ ধরে চলে আসা নকশিকাঁথার মহামূল্যবান নকশাও ছিল ঝুঁকিতে। তবে বর্তমান বাংলাদেশ আর ভারতের বিভিন্ন এলাকায় এই নকশিকাঁথার বুননকে কুটির শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে নানা সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। নকশিকাঁথা বাঙালি সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের এক নিদর্শন। প্রায় প্রতিটি বাঙালিরই এই ঐতিহ্যকে টিকিয়ে রাখতে চেষ্টা করা উচিত।
লেখক: প্রাবন্ধিক।