মুক্তিযুদ্ধের আগে ও পরের বহু প্রকৃত ঘটনা ও স্মৃতি বিস্মৃতি হয়ে গেছে। বাঙালির মুক্তির সংগ্রাম একটি সাধারণ ঘটনা নয়, এটি মহাকাব্যের চেয়েও অনেক বিস্তৃত। এই যুদ্ধের ইতিহাস ছিল ৬৮ হাজার গ্রাম বাংলার ঘটনাবহুল ইতিহাস। মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত মর্মকথা বুঝতে হলে পুরো ৬০এর দশকের রাজনৈতিক আন্দোলনের ঘটনা বহুল ইতিহাসের দিকে মনোনিবেশ করতে হবে। ঐ এক দশকে কার কি ভূমিকা, পাকিস্তানের রাজনীতিতে কোন দল বা কোন ব্যক্তির কি ভূমিকা ছিল, কে কখন কি কথা বলেছে তা লক্ষ্য করতে হবে। বিশেষত বাম প্রগতিশীল ধারার রাজনীতির ইতিহাস বেশি জানা প্রয়োজন। বাঙালির মুক্তির সংগ্রামের প্রকৃত ইতিহাসের শিক্ষাই বাম আন্দোলনকে সমাজ বিপ্লবের সঠিক ধারাতে নিয়ে যেতে পারে।
মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে প্রতিক্রিয়াশীল সামপ্রদায়িক গোষ্ঠী, প্রতিবিপ্লবী ধারার ডান ও তথাকথিত বাম নামধারীদের বিভ্রান্তি, অপপ্রচার থেকে বেরিয়ে আসা আজকের দিনে দেশপ্রেমিক বামপন্থীদের জরুরি কর্তব্য হওয়া উচিত। গণতান্ত্রিক আন্দোলন আর সমাজ বিপ্লবের কর্ম কৌশলের যৌক্তিক সমন্বয়কে এগিয়ে নেয়াই হলো বামপন্থীদের সামনে প্রধান কর্তব্য। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে এদেশের কতিপয় বামপন্থীরা বিভ্রান্তের চোরাগলিতে নিজেদের হারিয়েছিল। আবার কেউ কেউ মুক্তিযুদ্ধকে সিআইএ-এর ও ভারতের ষড়যন্ত্র বলে পাকিস্তানের পক্ষে নিয়েছে। এখনও কিছু বাম দল সাম্রাজ্যবাদের আশ্রিত লুটেরা বুর্জোয়াদের লুন্ঠনকে মুক্তিযুদ্ধের ব্যর্থতা বলে যুক্তি দাঁড় করার চেষ্টা করছে। অপর দিকে কিছু বাম দল আওয়ামী ও বিএনপি বলয়ের মধ্যে ঘুরপাক খেয়ে চলছে। মুক্তিযুদ্ধবিরোধী ও বিভ্রান্ত ধারার কতিপয় বামপন্থী এই ধরনের প্রচারে এখনও লিপ্ত।
বর্তমান সময়ে, তরুণদের ক্ষুদ্র একটি অংশ বিপ্লবের রোমান্টিসিজমে তাড়িত হয়ে মুক্তিযুদ্ধের সময়ে বিভ্রান্ত বাম ধারার পথ ধরে বিপ্লবের ছন্দ ফিরে পাওয়ার চেষ্টা করছে। এই জন্য তখনকার কতিপয় বাম দলের নেতাদের উক্তি ও তাদের ভূমিকাকে পেছনে ফিরে দেখা প্রয়োজন। এখানে তেমন কয়েকটি ঘটনা উল্লেখ করতে চাই। কোনো নেতাকে ছোট করার উদ্দেশ্যে নয়, ইতিহাসের সত্য জানার প্রয়োজনে।
৬০ এর দশকে চীন সফর থেকে আসার পর মজলুম জননেতা আবদুল হামিদ খান ভাসানী বলেছিলেন, “ডোন্ট ডিস্টার্ব আইয়ুব”। ‘৬৯ সালে গণঅভ্যূত্থানের পর দেশের মানুষ যখন একটি সাধারণ গণতান্ত্রিক নির্বাচনের জন্য উদগ্রীব হয়ে ছিলেন তখন তিনি এক জনসভা করে বলেছিলেন, “ভোটের বাঙে লাথি মার, পূর্ব বাংলা স্বাধীন কর, ভোটের আগে ভাত চাই”। এইসব আমার কথা নয়, ইতিহাসের সত্যতা। রাজনীতিতে ভুল ও হটকারী স্ববিরোধী সিদ্ধান্ত অনেক ত্যাগী দলকে বিভক্ত ও গণবিছিন্ন করেছে। যুদ্ধকালীন সময়ে ন্যাপ ভাসানী কয়েকভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। ভারতে ট্রেনিং নেবে, কি নেবে না পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি (মা.লে.) প্রশ্ন ছাড়াও ভাসানী ন্যাপের সাধারণ সম্পাদক মশিউর রহমান জাদু মিয়া ভারতে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ না নিয়ে ফেরত আসেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে, মোহাম্মদ তোহা এবং আবদুল হকের নেতৃত্বে পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি (এম.এল)-এর কতিপয় নেতা মুক্তিযুদ্ধকে দুই কুকুরের লড়াই বলে প্রকারান্তে পাকিস্তানকে রক্ষার পক্ষ নিলো। তারা ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তান পুনরুদ্ধার করার পক্ষে ছিলেন। ‘৭৫ এর পর মোহাম্মদ তোহা সহ একাংশের নেতা তাঁদের ভুল স্বীকার করে নিলেও, অন্য অংশ আবদুল হকের সেই পথে আজ অব্দি রয়ে গেছে। তাদের বর্তমান জোট এনডিএফ (মূল দল বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টি) এখনো দেশের স্বাধীনতা স্বীকার করে না। সিরাজ সিকদারের সর্বহারা পার্টি বর্তমানে এক ডজন এরও বেশি গ্রুপে বিভক্ত। তারা এক গ্রুপ অন্য গ্রুপের ছায়াও সইতে পারে না। এইসব গ্রুপ কখনো কখনো শ্রেণী শত্রু খতমের নীতির অন্তরালে ব্যক্তিগত বদলা নেয়ার ভাড়াটিয়া হিসেবেও ব্যবহার করার কথা শোনা যায় । রাজনীতির পার্থক্য নিয়ে ব্যক্তিগত শত্রুতায় খুনাখুনি করা এবং এলাকার আধিপত্য বিস্তারের মত ঘটনাও দেখা যায়।
বর্তমানে বামদের মধ্যে কয়েক ধরনের অবস্থান দেখা যায় –স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের ধারার বিশ্বাসী বাম, বিভ্রান্ত বাম, দালাল বাম, মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা বিরোধী বাম। বামদের মধ্যে বিছিন্ন কিছু গ্রুপ বা ব্যক্তি আছে, যারা ভারতের নকশালবাড়ী ধারা অর্থাৎ চারু মজুমদার, কানু সান্যালের লাইনকে বিপ্লবের সঠিক ধারা মনে করে। আবার কেউ কেউ নিজেকে টটস্কি পন্থী বলে দাবী করে। ষাটের দশকে আন্তর্জাতিক দ্বন্দ্বে চীনপন্থী (মাওপন্থী) বলে পরিচিত একটি পার্টি ভাঙনের মাধ্যমে অর্ধশত পার্টি ও গ্রুপে তৈরী হতে দেখা গিয়েছিল। সাংগঠনিক শৃঙ্খলা, গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতা যারা মানে না তারা হলো নৈরাজ্যবাদী। দেশ ও জনগণের মেজাজকে উপেক্ষা করে একরৈখিকভাবে শুধু শ্রেণীর কথা বলে তারা বাম সংকীর্ণতার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। আরেকপক্ষ শ্রেণীকে উপেক্ষা করে জাতীয় সমস্যা সমাধানের জন্য লুটেরা বুর্জোয়াদের সাথে কৌশলগত আপোষ করে আসছে, তারা হলো বাম সুবিধাবাদী। এরা বর্তমান ব্যবস্থার বিরুদ্ধে লড়াই করতে ভয় পায়, যদি না ক্ষমতাসীনের সাথে সম্পর্কের অবনতি ঘটে। এরা দুই পক্ষই মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ধারার বাইরে অবস্থান করছে। এদের দেখানো ভ্রান্তপথ কখনো বাম আন্দোলনের বিকল্প গড়ার পথ হতে পারে না।
রাজনীতির লাইন এক হলে কৌশলের ক্ষেত্রে ভিন্নতা নিয়েও গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতার নীতির ভিত্তিতে কমিউনিস্টেরা এক পার্টিতে কাজ করতে পারে। ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দ নিয়ে মার্কসবাদী লেনিনবাদী বিপ্লবী পার্টির নেতৃত্বের মধ্যে বিভাজন যারা করে তারা বুর্জোয়া সংস্কৃতির দোষে দুষ্টু। কথায় কথায় সকলে লেনিনের উদ্ধৃতি দেয়, কিন্তু পার্টি জীবনে লেনিনের কাজ থেকে শিক্ষা নিতে দেখা যায়না। বলশেভিক পার্টিতে ভিন্নমত থাকার পরেও মহান অক্টোবর বিপ্লব সফল ভাবে সম্পূর্ণ হয়েছিল। বুর্জোয়া লেজুড়বৃত্তি বা বাম সুবিধাবাদ, বাম হঠকারি ও বাম সংকীর্ণতার উর্দ্ধে উঠে সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে বামপন্থীদের নিজস্ব ধারা তৈরী করা প্রধান কর্তব্য হওয়া উচিত। দেশের শ্রমিক শ্রেণী ও মেহনতি মানুষের উপর অন্তহীন শোষণ ও লুটপাটের মহোৎসবকে প্রতিরোধ করতে হবে। এখানে বামপন্থী শক্তিকে শ্রেণী আন্দোলনে ও জাতীয় আন্দোলনে চ্যাম্পিয়ন হতে হবে। সে জন্য বামপন্থীদের অতীতের ব্যর্থতা, ভুলগুলো স্বীকার করে নিয়ে যা গৌরবের তাকে তুলে ধরতে হবে নতুন প্রজন্মের কাছে। এক্ষেত্রে ভুল, বিভ্রান্তি, সংকীর্ণতা, হটকারিতা বা সুবিধাবাদী ভ্রান্ত জাল থেকে বেরিয়ে আসার কোন বিকল্প নেই। শোষণ, বঞ্চনা, গণতন্ত্রহীনতা, সামপ্রদায়িক উন্মাদনা, লুটপাট ও মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তির বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ গণ প্রতিরোধ গড়ে তোলা আজ সময়ের দাবী।
এই উপমহাদেশে কমিউনিস্ট আন্দোলনের শত বছরের ত্যাগের ও গৌরবের ইতিহাস আছে। আমাদের পূর্বসূরি কমরেডগণ পাহাড়তুল্য ত্যাগে, শ্রমে, ঘামে, রক্তে এই উপমহাদেশকে বাম আন্দোলনের উর্বর ভূমিতে পরিণত করছেন, যা কখনোই ব্যর্থ হতে দেওয়া যায় না। সকল বিভ্রান্ত দূর করে সঠিক ধারার বাম আন্দোলন সামনে এগিয়ে যাবেই ।
লেখক : সম্পাদকমণ্ডলী সদস্য, সিপিবি, চট্টগ্রাম জেলা