সাগরে মাছ কম ধরা পড়া, সরবরাহে অপ্রতুলতা, সিন্ডিকেটের কারসাজি এবং প্রচুর দামের কারণে বাংলা নববর্ষ পহেলা বৈশাখে বাঙালির পাতে এবার ইলিশ না ওঠার শঙ্কা দেখা দিয়েছে। ঐতিহ্যবাহী পান্তা–ইলিশের আয়োজন বাংলা নববর্ষের উৎসবের অপরিহার্য অংশ হিসেবে পরিগণিত হলেও চলতি বছর ইলিশ সংকট প্রকট। মাছবাজারের পাশাপাশি সুপার শপগুলোতে ইলিশের চড়া দাম দেখা গেছে। তবে আজ–কালের মধ্যে সাগরে থাকা সব বোট ও ট্রলার কূলে ফিরে এলে সরবরাহ কিছুটা বাড়বে এবং দামও কমে আসতে পারে বলে সূত্রগুলো জানিয়েছে।
পহেলা বৈশাখের উৎসবের সাথে কোনো সম্পর্ক না থাকলেও বেশ কয়েক বছর ধরে অঘোষিতভাবে পান্তা–ইলিশ উৎসবের অপরিহার্য উপাদানে পরিণত হয়েছে। মাটির সানকিতে পান্তা–ইলিশ খাওয়া পরিণত হয়েছে ফ্যাশনে, আভিজাত্যে। পাঁচতারকা হোটেল থেকে শুরু করে ছোটখাটো রেস্তোরাঁয়ও সকালে পান্তা–ইলিশের আয়োজন করা হয়। বর্ষবরণের অনুষ্ঠানস্থলেও চড়া দামে বেচাকেনা চলে ইলিশ–পান্তার। পুরো বছরে একদিনও পান্তা না খাওয়া হাজারো মানুষ হুমড়ি খেয়ে পড়েন পহেলা বৈশাখ। পান্তাভাতের সাথে ইলিশ না খেলে অনেকের উৎসবে পূর্ণতা আসে না। এতে করে পহেলা বৈশাখে ইলিশের চাহিদা বহুগুণে বেড়ে যায়। আর এই বাড়তি চাহিদার সুযোগে পুরো বছর চড়া দামে বিক্রি হওয়া ইলিশের গায়ে হাত দেওয়া যায় না। পহেলা বৈশাখের বাজারকে সামনে রেখে আড়তে আড়তে মজুদ করা ইলিশ আকাশচুম্বি দামে বিক্রি হয়। চলে কারসাজিও। দর বাড়ানোর জন্য চলে সংঘবদ্ধ চক্রের বাজার কারসাজি।
অন্যান্য বছরের মতো চলতি বছরও একই ধাঁচে ইলিশের দাম বাড়ানো হয়েছে। তবে এবার নতুন সংকট হচ্ছে সাগর–নদীতে ইলিশ কম ধরা পড়া।
চট্টগ্রামের একাধিক বোট মালিক গতকাল আজাদীকে জানিয়েছেন, মাছের পরিমাণ খুবই কম। জলবায়ু পরিবর্তনের নির্মম প্রভাবে সাগরে ইলিশের পরিমাণ অস্বাভাবিকভাবে কমে গেছে। চৈত্র মাসে ঝড়–বৃষ্টি না হওয়ায় ইলিশের ঝাঁক নদীতে উঠে আসেনি, যা সরবরাহ কমার প্রধান কারণ বলে তারা জানান।
মাছ ব্যবসায়ীরা জানান, বর্তমানে ইলিশ ধরা পড়ছে কম, ফলে বাজারে সরবরাহ কমেছে। এছাড়া বড় আকারের ইলিশের দেখা মিলছে না, যা জেলেদের হতাশ করছে। মিয়ানমার থেকে কিছু বড় ইলিশ আমদানি হয়েছে বলেও জানান তারা।
চাহিদা বৃদ্ধির বিপরীতে সরবরাহ কমে যাওয়ায় কাঁচাবাজারে বেড়েছে ইলিশের দাম। বাজারে দেশি–বিদেশি এক কেজি সাইজের ইলিশ বিক্রি হচ্ছে ১৭শ টাকা থেকে ২ হাজার টাকা দরে। কাজীর দেউড়ি এবং কর্ণফুলী বাজারে গতকাল ইলিশের চড়া দাম হাঁকতে দেখা গেছে। দেড় কেজি ওজনের ইলিশের দাম হাঁকা হচ্ছে আড়াই হাজার টাকা দরে। তবে অনেকক্ষণ অপেক্ষা করেও কোনো ক্রেতাকে এসব মাছ কিনতে দেখা যায়নি।
সুপার শপেও ইলিশের দাম বাড়তি। গতকাল নগরীর একাধিক সুপার শপ ঘুরে দেখা গেছে, ৪শ গ্রাম ওজনের জাটকা ১৭৫০ টাকা, ৬শ গ্রাম ওজনের মাছ ২৪৫০ টাকা এবং ১২শ থেকে ১৪শ গ্রাম ওজনের মাছের দর দেখা গেছে ২৬৪৯ টাকা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেশে ইলিশের উৎপাদন প্রায় দ্বিগুণ বেড়েছে। ২০০৮–০৯ অর্থবছরে যেখানে ইলিশের উৎপাদন ছিল ২.৯৮ লাখ মেট্রিক টন, সেখানে ২০২৩–২৪ অর্থবছরে ৫ দশমিক ২৯ লাখ মেট্রিক টন ইলিশ আহরিত হয়েছে। ইলিশের উৎপাদন বাড়লেও তা সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে থাকে বছরজুড়ে। নববর্ষের আয়োজনেও ইলিশ যথারীতি বহু মানুষের পাতে উঠবে না বলে সূত্রগুলো জানিয়েছে।
ইলিশ শিকারের একাধিক বোটের মালিক মোহাম্মদ কামরুল জানান, আগামী ১৫ এপ্রিল থেকে ৫৮ দিনের জন্য মাছ শিকার বন্ধ হচ্ছে। আজ–কালের মধ্যে সাগরে থাকা সব বোট ফিরে আসবে। এগুলো এলে বাজারে মাছের সরবরাহ বাড়বে। দামও কমে যেতে পারে।