বাঙালির অসামপ্রদায়িক চেতনার প্রধান উৎসব

পহেলা বৈশাখ

| শুক্রবার , ১৪ এপ্রিল, ২০২৩ at ৫:০৩ পূর্বাহ্ণ

আজ পহেলা বৈশাখ। বাংলা নববর্ষের প্রথম দিন। আমাদের জাতীয় উৎসব। আমাদের আরো অনেক উৎসব আছে। এর মধ্যে কিছু ধর্মীয় উৎসব আর আছে কিছু ঋতু উৎসব।

আজ যাত্রা শুরু হলো নতুন আরেকটি বাংলা বছরের। বাংলা বর্ষপঞ্জিতে যুক্ত হলো নতুন বছর ১৪৩০। তাকে স্বাগত জানাতে, উদযাপন করতে সমগ্র বাঙালি জাতি আজ এক কাতারে। ধর্ম, বর্ণ, গোত্র নির্বিশেষে বাঙালির একমাত্র অসামপ্রদায়িক উৎসবের দিন এটি। বড় দৃঢ়তার সঙ্গে বলতে পারি, পহেলা বৈশাখ বাঙালির অসামপ্রদায়িক চেতনার প্রধান উৎসব। এটা বাঙালির প্রাণের উৎসব। আর এই উৎসবের প্রাণভোমরা মঙ্গল শোভাযাত্রা। বৈশাখী উৎসবের একটি আবশ্যিক অঙ্গ মঙ্গল শোভাযাত্রা। এটির সূচনা হয় ঢাকায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের উদ্যোগে পহেলা বৈশাখের সকালে এই শোভাযাত্রাটি বের হয়ে শহরের বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে পুনরায় চারুকলা ইনস্টিটিউটে এসে শেষ হয়। এই শোভাযাত্রায় গ্রামীণ জীবন এবং আবহমান বাংলাকে ফুটিয়ে তোলা হয়। শোভাযাত্রায় সকল শ্রেণীপেশার বিভিন্ন বয়সের মানুষ অংশগ্রহণ করে। শোভাযাত্রার জন্য বানানো হয় বিভিন্ন রঙের মুখোশ ও বিভিন্ন প্রাণীর প্রতিকৃতি। ১৯৮৯ সাল থেকে এই মঙ্গল শোভাযাত্রা পহেলা বৈশাখ উৎসবের একটি অন্যতম আকর্ষণ হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। জাতিসংঘের ইউনেস্কো বাংলাদেশ সরকারের সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আবেদনক্রমে ২০১৬ খ্রিষ্টাব্দের ৩০শে নভেম্বর বাংলাদেশের মঙ্গল শোভাযাত্রাকে বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ অধরা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে। এই উৎসবে মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান, আদিবাসী, ধনীগরিব, সকল বাঙালি এক মোহনায় মিলিত হচ্ছে। ফলে এই উৎসবের মূল চেতনা হয়ে দাঁড়িয়েছে অসামপ্রদায়িক বাংলাদেশ।

পহেলা বৈশাখ নিয়ে ভাষাসংগ্রামী আহমদ রফিক বলেছেন, ‘আমাদের এখানে ধর্মনিরপেক্ষ আর কোনো জাতীয় উৎসব নেই। অসামপ্রদায়িকতার দিক থেকে বিবেচনা করলে পহেলা বৈশাখ অধিক গুরুত্বপূর্ণ। প্রকৃতিগতভাবেও বৈশাখ গুরুত্বপূর্ণ। একদিকে ফসলি মাস, অন্যদিকে কালবৈশাখী। সব মিলিয়ে বৈশাখ উদ্দীপনামূলক এক মাস, যা আমাদের জীবনে নতুন মাত্রা যোগ করে।’

পয়লা বৈশাখ আমাদের সকল সঙ্কীর্ণতা, কূপমণ্ডুকতা পরিহার করে উদারনৈতিক জীবনব্যবস্থা গড়তে উদ্বুদ্ধ করে। আমাদের মনের ভিতরের সকল ক্লেদ, জীর্ণতা দূর করে আমাদের নতুন উদ্যোমে বাঁচার অনুপ্রেরণা দেয়। আমরা যে বাঙালি, বিশ্বের বুকে এক গর্বিত জাতি, পয়লা বৈশাখের বর্ষবরণে আমাদের মধ্যে এই স্বাজাত্যবোধ এবং বাঙালিয়ানা নতুন করে প্রাণ পায়, উজ্জীবিত হয়। অন্যদিকে পহেলা বৈশাখ বাঙালির একটি সার্বজনীন লোকউৎসব। এ দিন আনন্দঘন পরিবেশে বরণ করে নেওয়া হয় নতুন বছরকে। কল্যাণ ও নতুন জীবনের প্রতীক হলো নববর্ষ। অতীতের ভুলত্রুটি ও ব্যর্থতার গ্লানি ভুলে নতুন করে সুখশান্তি ও সমৃদ্ধি কামনায় উদযাপিত হয় নববর্ষ।

এ কথা নিঃশঙ্ক চিত্তে বলতে পারি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা আমৃত্যু অসামপ্রদায়িক চেতনা ধারণ করে দেশের জন্য, মানুষের জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করেছেন। তাঁর আজন্ম লালিত স্বপ্ন ছিল এই দেশকে অসামপ্রদায়িক সোনার বাংলা হিসেবে গড়ে তোলা। কিন্তু তিনি তাঁর সেই স্বপ্ন সম্পূর্ণ বাস্তবায়ন করে যেতে পারেননি। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বাস্তবায়নে কাজ করছেন তাঁরই সুযোগ্য কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা। আজকের বাংলাদেশ তাঁর নেতৃত্বেই অসামপ্রদায়িক চেতনা ধারণ করছে।

গবেষকরা বলেন, নতুন বছরের উৎসবের সঙ্গে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর কৃষ্টি ও সংস্কৃতির নিবিড় যোগাযোগ। গ্রামের মানুষ ভোরে ঘুম থেকে ওঠে, নতুন জামাকাপড় পরে এবং আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধবের বাড়িতে বেড়াতে যায়। বাড়িঘর পরিষ্কার করা হয় এবং মোটামুটি সুন্দর করে সাজানো হয়। বিশেষ খাবারের ব্যবস্থাও থাকে। কয়েকটি গ্রামের মিলিত এলাকায়, কোন খোলা মাঠে আয়োজন করা হয় বৈশাখী মেলার। মেলাতে থাকে নানা রকম কুটির শিল্পজাত সামগ্রীর বিপণন, থাকে নানারকম পিঠা পুলির আয়োজন। অনেক স্থানে ইলিশ মাছ দিয়ে পান্তা ভাত খাওয়ার ব্যবস্থা থাকে। এই দিনের একটি পুরনো সংস্কৃতি হলো গ্রামীণ ক্রীড়া প্রতিযোগিতার আয়োজন। এর মধ্যে নৌকাবাইচ, লাঠি খেলা কিংবা কুস্তি একসময় প্রচলিত ছিল। বাংলাদেশে এরকম কুস্তির সবচেয়ে বড় আসরটি হয় ১২ বৈশাখ, চট্টগ্রামের লালদিঘি ময়দানে, যা জব্বারের বলি খেলা নামে পরিচিত।

পহেলা বৈশাখের বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে বাঙালির অসামপ্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক চেতনার বহিঃপ্রকাশ ঘটতে থাকে। কালক্রমে বর্ষবরণ অনুষ্ঠান আর কেবল আনন্দউল্লাসের উৎসব নয়, বরং বাঙালি সংস্কৃতির একটি শক্তিশালী ধারকবাহক হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। আমরা আমাদের সকল পাঠক ও সুধীজনকে জানাই নববর্ষের শুভেচ্ছা।

পূর্ববর্তী নিবন্ধ৭৮৬
পরবর্তী নিবন্ধএই দিনে