বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের নিরলস সাধক

শিবুকান্তি দাশ | শনিবার , ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ at ৮:৫৬ পূর্বাহ্ণ

বাংলা সাহিত্যের বিলুপ্ত প্রায় পুঁথি সংগ্রহ, সম্পাদনা, সংরক্ষণ, চর্চা ও গবেষণায় নিজ জীবন উৎসর্গ করে স্মরণীয় হয়ে আছেন চট্টগ্রামের কৃতি সন্তান মুন্সী আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ। তাঁর জন্ম ১৮৭১ সালের ১১ অক্টোবর চট্টগ্রামের পটিয়া থানার সুচক্রদণ্ডী গ্রামের এক ঐতিহ্যবাহী উচ্চ মধ্যবিত্ত পরিবারে। তাঁর পিতার নাম শেখ নুর উদ্দিন মুন্সী এবং মায়ের নাম ছিল মিসরিজান। ১৮৮২ সালে করিম সুচক্রদণ্ডী মধ্যবঙ্গ বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। এক বছর পর তিনি ভর্তি হন পটিয়া উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয়ে। ১৮৮৮ সনে সতের বছর বয়সে করিম তাঁর মা মিসরিজানকেও হারান। ১৮৯৩ সালে আবদুল করিম পটিয়া হাই স্কুল থেকে দ্বিতীয় বিভাগে এন্ট্রান্স পাস করেন। তিনি তৎকালীন দক্ষিণ চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার এলাকার প্রথম মুসলমান এন্ট্রান্স পাস করা লোক। এর পর তিনি চট্টগ্রাম কলেজে এফ.(ফার্স্ট আর্টস) ক্লাসে ভর্তি হন। আবদুল করিমের সাহিত্য ও সংস্কৃতি প্রীতি শৈশব থেকে শুরু। বিশেষ করে তাঁদের পারিবারিক সংগ্রহে থাকা বিভিন্ন পুঁথির প্রতি তাঁর বেশ আগ্রহ ছিল। ক্রমে পুঁথি পড়া ও পুঁথি সংগ্রহের নেশা পেয়ে যায় তাঁকে। স্কুলজীবন থেকে সহপাঠিদের দেখাদেখি বিভিন্ন পত্র পত্রিকার নিয়মিত পাঠক ও গ্রাহক হয়ে যান তিনি। দশম শ্রেণির ছাত্র থাকাকালীন তিনি তাঁর দাদা নবী চৌধুরীর সংগ্রহে থাকা অসংখ্য পাণ্ডুলিপি থেকে কাজী দৌলত রচিত ‘সতী ময়নালোর চন্দ্রাণী’ কাব্যের পাণ্ডুলিপি আবিষ্কার করেন। এ সময় তিনি পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন গ্রাম থেকে পাণ্ডুলিপি সংগ্রহ করতে থাকেন।

কর্মজীবনের শুরুতে আবদুল করিম চট্টগ্রাম মিউনিসিপ্যাল স্কুলে শিক্ষকতায় যোগ দেন। কয়েক মাস পরে তিনি সীতাকুণ্ড মধ্য ইংরেজি স্কুলে অস্থায়ী প্রধান শিক্ষকের পদে যোগদান করলেও বেশি দিন চাকরি করেননি। ১৮৯৬৯৭ সালে তিনি চট্টগ্রামের প্রথম সাবজজ আদালতে শিক্ষানবীশ কেরানির পদে চাকরি পান। পরে স্থায়ী হলে পটিয়া মুন্সেফ আদালতে বদলি হয়ে আসেন।

চট্টগ্রাম কলেজে পড়ার সময় থেকে পুঁথি সংগ্রহ, সম্পাদনা ও গবেষণামূলক রচনা লিখতে শুরু করেন। অক্ষয় কুমার সরকারের সম্পাদনায় প্রকাশিত মাসিক ‘পূর্ণিমা’ পত্রিকায় ‘অপ্রকাশিত প্রাচীন পদাবলী’ শিরোনামে তাঁর লোক সাহিত্য বিষয়ক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। এভাবেই কবি নবীনচন্দ্র সেন তাঁর সাথে পত্রযোগে পরিচিত হন। উল্লেখ্য, কবি নবীনচন্দ্র সেন তখন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে কর্মরত ছিলেন। এক সময় তিনি বিভাগীয় কমিশনারের একান্ত সচিব রূপে চট্টগ্রামে বদলি হয়ে আসেন। তিনি আবদুল করিমকে পটিয়া থেকে বদলি করে চট্টগ্রাম কমিশনার অফিসে কেরানি পদে নিজের কাছে নিয়ে আসেন। এ বিষয়টি একই অফিসে অনেকেই ভালো চোখে দেখেননি। ফলে তাঁরা দু‘জনই তাঁদের ষড়যন্ত্রের শিকার হন। আবদুল করিম বছর খানেক চাকরি করার এক পর্যায়ে স্বগ্রাম নিবাসী কালী শংকর চক্রবর্ত্তী প্রকাশিত সাপ্তাহিক ‘জ্যোতি’ পত্রিকার এক সংখ্যায় কমিশনার অফিসের একটি গোপনীয় সংবাদ প্রকাশিত হয়। একই পত্রিকায় আবদুল করিমের নামে একটি বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হয়। যেখানে ছিল “প্রাচীন গীত, পুঁথি, বার মাস্যা প্রভৃতি যিনি সংগ্রহ করিয়া দিবেন তাহাকে আমরা এক বৎসরকাল ‘জ্যোতি’ পত্রিকা বিনামূল্যে দান করিব”। এটা দেখে নবীন চন্দ্র সেন ও আবদুল করিমের বিরোধীরা এ দু‘জনের বিরুদ্ধে তৎকালীন কমিশনারের নিকট অভিযোগ করে বসেআবদুল করিমের মাধ্যমে অফিসের গোপনীয় সংবাদটি ফাঁস হয়েছে এবং নবীন চন্দ্র সেনও এটাতে জড়িত আছে। সরকারি কর্মচারী হিসেবে তাঁরা দু‘জনেই পত্রিকাটির সাথে যোগাযোগ রেখেছেন যা চাকরি বিধির পরিপন্থী। অথচ নবীন চন্দ্র সেন এ ব্যাপারে কিছুই জানতেন না এবং আবদুল করিমও সাহিত্য বিষয়ক একটি বিজ্ঞাপন ছাপানো অতোাঁ দোষণীয় হয়ে পড়বে তা বুঝতে পারেননি। শেষ পর্যন্ত দু’জনের মধ্যে আবদুল করিমকে চাকরিচ্যুত এবং নবীন চন্দ্র সেনকে অন্যত্র বদলি করা হয়। আবদুল করিম পরবর্তীতে আনোয়ারা মধ্য ইংরেজি বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষকের শূন্য পদে নিয়োগ পান। আনোয়ারা স্কুলে আবদুল করিম ১৮৯৯১৯০৫ পর্যন্ত প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন। এ স্কুলে শিক্ষকতাকালীন আবদুল করিম অনেক পুঁথি সংগ্রহ করেন। ১৯০১ সালে কোলকাতার বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ থেকে নরোত্তম ঠাকুরের ‘রাধিকার মানভঙ্গ’ গ্রন্থটি তাঁর সম্পাদনায় এ সময় প্রকাশিত হয় যেটির মুখবন্ধ লেখেন আচার্য্য হরপ্রসাদ শাস্ত্রী।

আনোয়ারা উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষকতাকালীন আবদুল করিম গুরুত্বপূর্ণ বেশ কিছু কাব্য সংগ্রহ করেন। প্রথম যে পুঁথিটি তিনি সেখানে পান তা হল মহাকবি আলাওলের বিখ্যাত ‘পদ্মাবতী’ কাব্য। আবদুল করিমের সাহিত্য চর্চা শুধু পুঁথি সংগ্রহে সীমাবদ্ধ ছিল না। তিনি লিখেছেনও প্রচুর। বাংলা১৩০২ সালে পূর্ণিমায় ‘অপ্রকাশিত প্রাচীন পদাবলী’ দিয়ে শুরু করে ১৩০৭, ১৩০৯, ১৩১০, ১৩১২ ও ১৩১৮ সনের সাহিত্য পরিষদ পত্রিকায় তাঁর সংগৃহীত পুঁথির বিবরণ প্রকাশিত হয়। এছাড়াও পূর্ণিমা, জ্যোতি, সাধনা, আরতি, নবনূর, সুধা, প্রকৃতি, মোহাম্মদী, আল এসলাম, মাহে নও, আশা, সাহিত্য পরিষদ পত্রিকা, বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতি পত্রিকা ইত্যাদি পত্রিকায় তাঁর লেখা গুরুত্ব সহকারে প্রকাশিত হয়েছিল। পুঁথিসাহিত্য, ভাষাসংস্কৃতি, ইতিহাসঐতিহ্য ভিত্তিক তথ্যবহুল তাঁর লেখা মূল্যবান প্রবন্ধ সংখ্যা ছয় শতাধিক।

মুন্সী আবদুল করিমের এহেন অসামান্য অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ চট্টগ্রামের পণ্ডিত সমাজ ‘চট্টল ধর্মমণ্ডলী’ ১৯০৯ সালে তাঁকে ‘সাহিত্য বিশারদ’ উপাধি দিয়ে সম্মানিত করেন। ১৯২৩ সালে নদীয়ার পণ্ডিত সমাজ ‘সাহিত্য সভা’ তাঁকে ‘সাহিত্য সাগর’ উপাধিতে ভূষিত করেন। আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ সম্পাদিত গ্রন্থগুলো হলকবি বল্লবের ‘সত্যনারায়ণের পুঁথি’, দ্বিজরতি দেবের ‘মৃগলুদ্ধ’, রামরাজার ‘মৃগলুদ্ধ সম্বাদ’, দ্বিজ মাধবের ‘গঙ্গামঙ্গল’, আলীরাজা কানু ফকীরের ‘জ্ঞানসাগর’, বাসুদেব ঘোষের ‘শ্রীগৌরাঙ্গ সন্ন্যাস’, শেখ ফয়জুল্লাহর ‘গোরক্ষবিজয়’, আলাওলের ‘পদ্মাবত্মী, মুসলমান বৈষ্ণব কবি, কালকেতুর ‘চৌতিশা’।

মাতৃভাষা বাংলার জন্য আবদুল করিমের ছিল নাড়ির টান। ‘নবনূর’ পত্রিকায় (১৯০৩) ‘বাঙালা ভাষায় মুসলমানী সাহিত্য’, ‘আল এসলাম’ পত্রিকায় (১৯১৮) ‘বঙ্গভাষা ও সাহিত্য বনাম ও বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য’ শীর্ষক প্রবন্ধ, ১৯১৪ সালে কলকাতায় অনুষ্ঠিত বাংলা সাহিত্য সম্মেলনে পঠিত অভিভাষণ: ‘বাংলার মুসলমানগণের মাতৃভাষা’ শিরোনামে ও আবদুল করিম মাতৃভাষা বাংলার গুরুত্ব বিষয়ে তাঁর দৃঢ় অবস্থান ব্যক্ত করেন। তিনি বলেন, ‘বাঙালা ভাষা ভিন্ন অন্য কোন ভাষা বাঙালি মুসলমানের মাতৃভাষা ও জাতীয় ভাষা হইতে পারে না’। তিনি আরো বলেন, ‘বাংলার হিন্দুদিগের মতো বাংলার মুসলমানদেরকেও বাঙালি ভিন্ন আর কিছু বলা যায় না। এই ভাষাতে তারা চিন্তা করে সংসারের যাবতীয় কাজ কর্ম করে’। সাহিত্য বিশারদ জীবিতাবস্থায় ১৯৫০ সালে তাঁর সংগৃহীত মুসলমান রচিত পুঁথিগুলি (৬৯৫টি) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে দান করেন। ১৯৫৩ সালে তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর ভাইপো ড. আহমদ শরীফ হিন্দু রচিত পুঁথিগুলি (৩৮১ টি) রাজশাহী বরেন্দ্র গবেষণা যাদুঘরে দান করেন। বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদেও তাঁর সংগৃহীত অনেক পুঁথি দেয়া হয়েছে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর সংগৃহীত পুঁথি, বই, পত্র পত্রিকা, ম্যাগাজিন ইত্যাদির এক বিশাল সংগ্রহশালা সযত্নে সংরক্ষণ করা হয়েছে। বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির নিরলস সাধক মুন্সী আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ ১৯৫৩ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

লেখক : শিশুসাহিত্যিক, সাংবাদিক ও সংগঠক

পূর্ববর্তী নিবন্ধক্ষণজন্মা খনা
পরবর্তী নিবন্ধহল্যান্ড থেকে