প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আরও বিকশিত করার চেষ্টায় সক্রিয় রয়েছে সরকার। একুশে পদক বিতরণ অনুষ্ঠানে গত ২০ ফেব্রুয়ারি তিনি এ কথা বলেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি যেন আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আরও বিকশিত হয়, সেটাই আমাদের প্রচেষ্টা থাকবে। সেই প্রচেষ্টায়ও আমরা সাফল্য অর্জন করব বলে আমি বিশ্বাস করি। বাঙালির ভাষার অধিকার আদায়ের দিন একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালনের বিষয়টি তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে আমরা স্বীকৃতি পেয়েছি। এটা আমাদের সকলকে বিশেষভাবে নজর দিতে হবে। একুশে ফেব্রুয়ারি শুধু আমাদের না, যারা মাতৃভাষা ভালোবাসে এবং মাতৃভাষার জন্য যারা জীবন দিয়েছে এবং মাতৃভাষাকে সংরক্ষণ করা, হারিয়ে যাওয়া মাতৃভাষা খুঁজে বের করা এবং সেগুলো সংরক্ষিত করা, সেটাই আমাদের প্রচেষ্টা। সেই প্রচেষ্টায় আমরা সফলকাম হয়েছি।
আমরা বাঙালি। আঞ্চলিক নানা রীতি-নীতিতে সমৃদ্ধ সংস্কৃতির দেশ আমাদের বাংলাদেশ। আমাদের আছে নিজস্ব সংস্কৃতি। গৌরবময় বাঙালি সংস্কৃতির সে ইতিহাস ধর্ম-বর্ণ, গোত্রীয় রীতি-নীতি, পৈতৃক প্রথার সুষ্ঠু পরম্পরায় পরিচালিত। নিজস্ব সংস্কৃতিতে সমৃদ্ধ এ জনপদের মানুষ বরাবরই রুচিবোধসম্পন্ন এবং স্বাধীনচেতা। এ দেশের মাটি ও মানুষের সাথে মিশে থাকা সংস্কৃতি পাশ্চাত্যের অনেক উন্নত দেশের চেয়েও মার্জিত ও সব মহলে গ্রহণযোগ্য। এখানে পরিবার আছে। সমাজ আছে। আর এ পরিবার ও সমাজের সমন্বয়েই গড়ে উঠেছে এক সুস্থ, সুন্দর, রুচিশীল, মার্জিত সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থা। পহেলা বৈশাখ, পহেলা ফালগুন, নবান্ন উৎসবসহ বিভিন্ন উৎসব বাঙালি সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। এসব সংস্কৃতি আমাদের জাতীয় ও ধর্মীয় জীবনে গভীর প্রভাব ফেলে।
কিন্তু দুঃখের বিষয়, আকাশ সংস্কৃতির নেতিবাচক প্রভাবে দেশের মানুষের আচরণে অন্যরকম প্রভাব পড়ছে। এ ছাড়াও কর্ম ব্যস্ততা, সাংসারিক টানাপোড়েন, সামাজিক সংকীর্ণতা, মানুষের মাঝে উৎসাহ উদ্দীপনার অভাব প্রভৃতির কারণে দেশের মানুষ শুদ্ধ সংস্কৃতি চর্চায় বিমুখ হয়ে উঠছেন বলে জানা গেছে। এটাকে বাংলার সংস্কৃতির বড় ধরনের পরিবর্তন বলে মনে করছেন সংস্কৃতি বিশেষজ্ঞরা। সংস্কৃতি পারস্পরিক বিনিময়যোগ্য। এটি চিরদিন স্থির থাকে না। বিভিন্ন সংস্কৃতির সাথে মিশে এর রূপ পরিবর্তন হবে এটাই স্বাভাবিক। তবে নতুনত্বের নামে কোনো সংস্কৃতির জোর প্রভাবে যখন নিজস্ব সংস্কৃতির মৌলিক অস্তিত্ব হারিয়ে ফেলে, তখন সেটাকে সাংস্কৃতিক আগ্রাসন বলে অ্যাখায়িত করা হয়। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এ সকল সাংস্কৃতিক আগ্রাসনে প্রত্যক্ষ ও বাহ্যিক নেতিবাচক প্রভাব হল নতুন প্রজন্মের কথাবার্তার পরিবর্তন।
ভাষাবিদরা বলেন, বিশ্বায়নের এই যুগে বিভিন্ন ভাষা ও সংস্কৃতি একে অন্যে মিলেমিশে পারস্পরিক মেলবন্ধন ও বৈশ্বিক সংস্কৃতি প্লাটফর্ম রচনা করে বিশ্বজনীনতা লাভ করবে- এটাই তো যুগের হাওয়া। এই যুগের হাওয়ার বিরুদ্ধাচারণ কোনো সুবিধা বয়ে আনবে না। অন্য কোনো ভাষা বা সংস্কৃতির আগ্রাসনে আমাদের স্বকীয়তা যেন নষ্ট না হয় সেদিকে সংশ্লিষ্ট সবার নজর দিতে হবে। প্রয়োজনে ভাষার উন্নয়নে এবং রক্ষণাবেক্ষণে সঠিক ভাষানীতির প্রবর্তন করে মাতৃভাষার সমৃদ্ধি ঘটাতে হবে। বাংলা বানান নিয়ে বর্তমান সমস্যার অন্ত নেই। বাংলাদেশেও এ সমস্যা প্রকট বলে অনেকের ধারণা। একই শব্দের বিভিন্ন বানান লেখা হচ্ছে যত্র-তত্র। সাহিত্য ছাড়াও পোস্টারে, বিজ্ঞাপনে, সাইনবোর্ডে, সংবাদপত্রে, সাময়িকীতে, বেতার-টেলিভিশনে এই ভুলের ছড়াছড়ি অনেকের চোখে ধরা পড়ে। সেই সঙ্গে বাদ পড়ে না অফিস আদালতে ব্যবহৃত লিখিত চিঠিপত্রে, নোট, সারাংশ, প্রতিবেদনে, সভা-সমিতির কার্যপত্রে ও কার্যবিবরণীতে অশুদ্ধ বানানের বিপুল সমাহার। আমরা বাঙালি, বাংলা আমাদের ভাষা। বাংলায় আমরা কথা বলি, আমাদের কথা বলাটা কতটা শুদ্ধ ও সঠিকভাবে করছি তা কি আমরা কখনো ভেবে দেখেছি। অথচ আমরা তো ভাষার জন্য রক্ত দিয়েছি। বাংলা ভাষা আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষার সম্মান লাভ করেছে। বাংলা ভাষার ইতিহাস অনেক গর্ব ও গৌরবের। তাই বাংলা ভাষায় শুদ্ধ কথোপকথন ও বাংলা শুধু রীতির আচারে আমাদের বিশ্বাসী হতে হবে। কিন্তু আমরা তার প্রায়োগিক দিক থেকে অনেকটা দায়সারা আচরণে অভ্যস্ত। বিশেষজ্ঞরা বলেন, মাতৃভাষার প্রতি প্রকৃত আবেগ, ভালোবাসা ও দরদ থাকলে নিজের ভাষার বিকাশে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা দরকার। যাবতীয় সীমাবদ্ধতাকে দূর করার জন্য নানারকম অবয়ব পরিকল্পনা অনায়াসেই গ্রহণ করা যেতে পারে। আর সরকারি প্রণোদনা এ ক্ষেত্রে কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারে।