বাংলা-বাঙালির প্রাচীন লোকসংস্কৃতি : বারো মাসের প্রভাব বিশ্লেষণ

সোহেল মো. ফখরুদ-দীন | শুক্রবার , ৩ জানুয়ারি, ২০২৫ at ৬:২৯ পূর্বাহ্ণ

বাংলাবাঙালির লোকসংস্কৃতি এক সমৃদ্ধ ও বৈচিত্র্যময় ইতিহাসের অংশ। প্রাচীনকাল থেকে এই সংস্কৃতি আমাদের গৌরবের অংশ হিসেবে রাজ দরবার থেকে সাধারণ মানুষের গৃহে পালিত হয়ে আসছে। এটি শুধু কেবল আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্য ধারণ করে না, বরং এর মধ্যে গাঢ়ভাবে প্রভাবিত হয়েছে সভ্যতা, কৃষি, ধর্ম, সামাজিক কাঠামো এবং ঋতুপঞ্জিকাও। বাংলার লোকসংস্কৃতি, তার রীতিনীতি, শিল্পকলা, পোশাকআশাক, খাবারদাবার, আচারব্যবহার সবকিছুতেই বিভিন্ন ঋতু ও মাসের প্রভাব লক্ষ করা যায়। বিশেষ করে, বাঙালির বার মাসের ঐতিহ্য, যেখানে প্রতিটি মাসে ঋতু পরিবর্তন এবং প্রাকৃতিক পরিবেশের সঙ্গে মানুষের জীবনযাত্রার সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড়ভাবে জড়িত। মানুষ থেকে শুরু করে বৃক্ষরাজি পর্যন্ত এই এই লোকসংস্কৃতি পালন করে। ঋতু পরিবর্তনে গাছে গাছে ফুল ফলের সমাহার। গ্রামীণ জীবনের অনগ্রসর শিক্ষাহীন সাধারণ মানুষের মুখে মুখে লোকগান, সাধারণত এগুলো গীত হিসেবে পরিচিত। গানে গানে কৃষি জমিন, মাঠঘাট সর্বক্ষেত্রে লোকসংস্কৃতির চর্চা। যা আজ আধুনিককালে কিছুটা বিলুপ্ত প্রায়। কবির গান, পুঁথিপাঠ, জারি, সারি, মারফতি, ভাণ্ডারি, পালাগান, শরীয়তি, সাধুসন্ন্যাসীর মরমী গান ইত্যাদি। নাটকে অন্যতম ‘পোয়ালা গান ও নাট টঅ পোঁয়ার টঅশা’। মাসে মাসে মেলা পার্বণ এ জনপদে আমাদের লোকসংস্কৃতি। গ্রামীণ জীবনের এগুলো ঐতিহ্য। আজ শহরে জীবনে আধুনিকতায় আকাশ সংস্কৃতি ও বিজাতীয় সংস্কৃতি বাঙালির জীবনকে বিপন্ন করতে চলছে। বাংলাবাঙালির বারো মাসের পারিপার্শ্বিক জীবনকাঠামো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সাধারণত বাঙালির বারো মাসের মধ্য দিয়ে চারটি মৌলিক ঋতুগ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ ও হেমন্তপ্রবাহিত হয়। ঋতু পরিবর্তনের সাথে সাথে মানুষের জীবনযাত্রা, খাদ্যাভ্যাস, ধর্মীয় আচরণ, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এবং দৈনন্দিন রীতিনীতি অনেকাংশেই পরিবর্তিত হয়। বাঙালির লোকসংস্কৃতির মধ্যে এই ঋতু পরিবর্তনের প্রভাব বিশেষভাবে দেখা যায়। প্রতিটি মাসের সঙ্গে একটি নির্দিষ্ট উৎসব, ঐতিহ্য বা কর্মকাণ্ড সম্পর্কিত থাকে আমাদের। এই মাসগুলোতে কৃষিকাজ, উৎসব, খাদ্য, পোশাক বা আচারআচরণে বিশেষ পরিবর্তন ঘটে, যা সমাজের সকল স্তরের মানুষের মধ্যে একটি নির্দিষ্ট ঐক্য সৃষ্টি করে। এই নীতিকে বাঙালির ঐতিহ্য হিসেবে চিহ্নিত করে গৌরবে পরিণত হয়।

বাঙালি বারো মাসের বিশ্লেষণ:

. চৈত্র (চৈত্র সংক্রান্তি): চৈত্র মাসের সমাপ্তির সময় সাধারণত ‘চৈত্র সংক্রান্তি’ উদযাপন করা হয়। এটি মূলত পুরনো বছরের শেষ এবং নতুন বছরের আগমনের উপলক্ষে হয়। এ সময় কৃষকরা পুরানো ফসল কাটে এবং নতুন ফসলের জন্য প্রস্তুতি নেয়। খাবারে নতুন পাটাল, লাউ, শশা, খেজুরের রস ইত্যাদি থাকে। লোকসংস্কৃতির নানা ধরনের উৎসব এখানে কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করে।

. বৈশাখ: বাঙালি নববর্ষ উদযাপন বা পহেলা বৈশাখ বাঙালি সংস্কৃতির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উৎসব। বৈশাখের প্রথম দিন বাঙালি নববর্ষের শুরুতে বৈশাখী মেলার আয়োজন করা হয়। এই সময় গ্রীষ্মকালীন তাপ থেকে মুক্তি পেতে নানা রকম ফলমূল, বিশেষ করে পেঁপে, আম, জাম ইত্যাদির উপস্থাপন দেখা যায়। এ ছাড়া, বৈশাখী পোশাক, নাচগান, বৈশাখী খাবারপিঠা, চিড়া, মিষ্টান্নএসবও সমাজে এক বিশেষ পরিবেশ তৈরি করে।

. জ্যৈষ্ঠ: জ্যৈষ্ঠ মাসে গরম প্রচণ্ড বৃদ্ধি পায়। গ্রীষ্মের মাঝামাঝি সময়ে পানীয়, ফল, দই, ছানাসহ ঠাণ্ডা খাবারের প্রতি মানুষের আগ্রহ বৃদ্ধি পায়। সাংস্কৃতিকভাবে, মেলা এবং অন্যান্য সামাজিক অনুষ্ঠান জ্যৈষ্ঠ মাসে অতিরিক্ত গুরুত্ব পায়।

. আষাঢ়: আষাঢ় মাসে বর্ষা শুরু হয়, যার ফলে বৃষ্টি ও অতি শীতল পরিবেশ তৈরি হয়। এ সময় কৃষির জন্য উপকারী হলেও, সামাজিক অনুষ্ঠান সীমিত হয়ে যায়। এই সময় বিশেষ করে মেঘ, বৃষ্টি এবং হালকা খাবারের প্রতি আকর্ষণ বৃদ্ধি পায়। সাথেই আষাঢ় মাসে ‘গঙ্গাস্নান’ ও অন্যান্য ধর্মীয় আচারও পালিত হয়।

. শ্রাবণ: শ্রাবণ মাসে বর্ষার মধ্যগগনে বৃষ্টির সোঁদা মাটি ও প্রকৃতির অনন্য সৌন্দর্য দৃশ্যমান হয়। এ সময় হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা শিবপূজা করেন। শ্রাবণ মাসে বাঙালি শিল্পকলা, গান, কবিতা, সাহিত্য ও মেলার আয়োজন বিশেষভাবে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।

. ভাদ্র: ভাদ্র মাসে ফসল কাটার আগে এক ধরনের উত্তেজনা থাকে। সমাজে লোকসংস্কৃতির প্রতি আগ্রহ বাড়ে, বিশেষ করে নৃত্য, গান এবং নাটক মঞ্চায়ন করা হয়। এ সময় কৃষ্টির পালা, ভাদ্রপদ উৎসব ইত্যাদি বিশেষভাবে পালিত হয়।

. অশ্বিনী: অশ্বিনী মাসে কৃষকদের কৃষির কাজ শেষ হয়ে নতুন ফসলের বীজ বপন করা হয়। আকাশে হালকা ঠাণ্ডা বাতাস এবং রাতে ঘুমানোর সময় রিল্যাঙেশন, স্থানীয় মেলাএগুলো সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অংশ হয়ে ওঠে।

. কার্তিক: কার্তিক মাসে শীতের আগমন ঘটে। এই সময় ধান কাটা, কৃষি কাজের উৎসব চলে। কার্তিক মাসে বাড়িতে মিষ্টি বানানো এবং পূজা দেওয়ার প্রচলন আছে। স্থানীয় মহিলারা এই সময় ‘করমা’ উৎসব পালন করেন।

. অগ্রহায়ণ: অগ্রহায়ণ মাসে ধান কাটার উৎসব প্রধান হয়। এটি মূলত কৃষিভিত্তিক উৎসব। গ্রামের মানুষ ধান কেটে বিভিন্ন আচার পালন করে, এর মাধ্যমে কৃষি এবং স্থানীয় জীবনযাত্রা ও সংস্কৃতির আন্তঃসম্পর্ক প্রতিফলিত হয়।

১০. পৌষ: পৌষ মাসে শীতকালীন আয়োজন ও মেলা প্রাধান্য পায়। পিঠা তৈরি, মাঘী পূজা, ঘরোয়া মেলা ইত্যাদি সাংস্কৃতিক অনুষঙ্গ হয়ে ওঠে।

১১. মাঘ: মাঘ মাসে হেমন্ত ও শীতকাল শেষ হতে থাকে এবং গ্রীষ্মের আগমন শুরু হয়। মাঘে হেমন্তের শেষে আঞ্চলিক ঐতিহ্য অনুযায়ী উৎসব এবং সাংস্কৃতিক কার্যক্রম চালু থাকে। মাঘে আঞ্চলিক খাবারের পাশাপাশি ধর্মীয় অনুষ্ঠানও বিশেষ ভূমিকা রাখে।

১২. ফাল্গুন: ফাল্গুন মাসে বসন্তের আগমন ঘটে। বসন্ত উৎসব এবং হোলি উৎসবের মাধ্যমে মানুষ প্রকৃতির প্রতি ভালোবাসা এবং আনন্দ প্রকাশ করে। শিল্পকলা, নৃত্য, গান এবং সাহিত্যের প্রতি মানুষের আগ্রহ আরও বৃদ্ধি পায়।

বাঙালি সমাজে বার মাসের প্রভাবের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, ঋতুর পালাবদলের সাথে সাথে নিজেদের সংস্কৃতি, খাদ্যাভ্যাস, জীবনযাত্রা, আচারআচরণ ও ধর্মীয় রীতির প্রতি এক অনবদ্য সাদৃশ্য তৈরি হয়। বাঙালির লোকসংস্কৃতি যেমন আমাদের সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের প্রতিফলন, তেমনি বারো মাসের প্রভাব তার জীবনযাত্রাকে আরো সমৃদ্ধ করেছে। তাই, বাঙালির বারো মাসের ঐতিহ্য কেবল ঋতুবৈচিত্র্যের প্রতিফলন নয়, এটি একটি সামাজিক ঐক্য, সংস্কৃতি ও জীবনধারার অংশ হিসেবেই বিবেচিত হয়। মূলত এই সংস্কৃতি আমাদের গৌরবের ও অহংকারের প্রতীকী।

লেখক : প্রাবন্ধিক

পূর্ববর্তী নিবন্ধরাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর দরুদ পাঠের ফজিলত
পরবর্তী নিবন্ধজুম্‌’আর খুতবা