বাংলা ছড়ার মুকুটহীন সম্রাট সুকুমার বড়ুয়া। সেই শিশুকাল থেকে মুখে মুখে ছড়া বানানোর কারিগর, পরবর্তীতে টুকরো কাগজে টুকে নেয়া ছড়ার রত্নসম্ভারে সমৃদ্ধ আমাদের সুকুমার বড়ুয়া। তাঁর ছড়ার স্বাভাবিক চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য অন্যসব ছড়াকারের ছড়া থেকে তাঁকে সম্পূর্ণ আলাদা করে চিনিয়ে দেয়। সমাজের অতি চেনা–জানা বিষয় থেকে তুলে আনা খণ্ড খণ্ড চিত্র তাঁর ছড়াকে প্রাণবন্ত করেছে। কোন অতিকথন বা বাড়াবাড়ি তাঁর ছড়ায় কখনও দেখা যায় না। শিশুপাঠ্য উপযোগী থেকে শুরু করে সব বয়সের পাঠকের মনে দোলা লাগানো ছড়ায় সুকুমার বড়ুয়া সিদ্ধহস্ত। এমনকি তাঁর আঞ্চলিক ছড়ায়ও সে চমক চোখে পড়ে। বাংলা ছন্দের স্বরবৃত্ত, মাত্রাবৃত্ত, অক্ষরবৃত্ত কোনটিতেই তাঁকে বেমানান মনে হয়নি। ছন্দ জেনে নেয়ার ন্যাচারাল যোগ্যতায় নিজেকে শানিয়ে নিয়েছেন বলেই তাঁর ছন্দে ত্রুটি ধরা বড়ই কঠিন কাজ। তিনি বলেন, “ছন্দ নিয়ে আমি সিরিয়াসলি কিছু ভাবি না। ছন্দ নিজে এসে আমার কাছে ধরা দেয়”। তাঁর এই সাহসী উচ্চারণেই বোঝা যায়, তিনি কত বড় মাপের ছড়াকার। ওপার বাংলার সুকুমার রায়ের পর আমাদের সুকুমার বড়ুয়াই ছড়ার জাঁদরেল জেনারেল। সুকুমার বড়ুয়া আমাদের শিশুসাহিত্যের অহংকার। যাঁর ছড়ার খ্যাতি দেশ ছাড়িয়ে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছে। তাঁর ছড়ার সহজ সরল সাবলীল প্রকাশভঙ্গিই পাঠকের কাছে প্রধান আকর্ষণ। সুকুমার বড়ুয়ার ছড়া মানেই হাসি, আনন্দ আর কঠিন বাস্তবতার জীবন্ত প্রতিফলন। তাঁর হাতে ছড়ারা প্রাণ খুলে হাসে, কথা বলে। জীবনের নানা অনুষঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। তাঁর ছড়া পড়লে পাঠকের মন ভালো হয়ে যায়। কখনও পাঠক অজান্তে হেসে ওঠে। আবার কখনও বা কঠিন সত্যের মুখোমুখি হয়ে দুঃখে ভারাক্রান্ত হয় পাঠকের মন। এই হলো সুকুমার বড়ুয়া। তাঁর দুএকটি ছড়ার উদ্ধৃতি দিলে বোঝা যাবে। সুকুমার বড়ুয়ার ছড়া সর্বজনীন। সব পাঠকের মনে দোলা দিয়ে যায় তাঁর ছড়া। তার একটি ছড়া এই রকম– সবুজ বনের তোতা খাঁচার ভেতর বন্দি হয়ে ঠোঁট করেছেন ভোঁতা। দেখালে দেখে শেখালে শেখে শোনালে হবে শ্রোতা। এর কথা ওর কানে দিয়ে গণ্ডগোলের হোতা সবুজ বনের হোতা। সুকুমার বড়ুয়ার বৈচিত্রময় মজার ছড়ার শেষ নেই। যেমনঃ ছারপোকা লো ছারপোকা কার নাতি তুই কার খোকা? দুধ খাবি না মধু খাবি মিষ্টি গুঁড়ে পেট ভরাবি? ওসব খেলে রক্ত হবে হাতপাগুলো শক্ত হবে নইলে দেবো অন্য জিনিষ গরম পানি কিংবা ফিনিশ । ছড়ায় এমন কৌতুক আমাদের শিশুসাহিত্যে দ্বিতীয়টি আছে বলে জানা নেই। কৌতুকাশ্রয়ী এমন অনেক মজার মজার ছড়ার সুকুমার বড়ুয়া লিখেছেন, যা আমাদের শিশুসাহিত্যে তথা ছড়া সাহিত্যের এক অমূল্য সম্পদ। এমনি সব মজার মজার ছড়ায় ঠাঁসা সুকুমার বড়ুয়ার বইগুলো। তাঁর কয়েকটি ছড়ার বই হলো– পাগলা ঘোড়া, ভিজে বেড়াল, চন্দনা–রঞ্জনার ছড়া, এলোপাতাড়ি, নানারঙের দিন, চিচিং ফাঁক, কিছু না কিছু, ঠুসঠাস, নদীর খেলা, কোয়াল খাইয়ে, ছোটদের হাট, লেজ আবিস্কার ইত্যাদি। ৮৮ বছর বয়সে এসেও সুকুমার বড়ুয়ার লেখালেখি থেমে নেই। লেখালেখি ছাড়াও বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে তাঁকে ঘিরে ধরে শিশুরা। শিশুদের সাথে কথা বলে, অটোগ্রাফ দিয়ে তাঁর কোন ক্লান্তি নেই । শিশুদের সাথে হাস্যোজ্জ্বল ছবি তুলে কখনও বা ছড়া শুনিয়ে তাদের তৃপ্ত করেন তিনি। সুকুমার বড়ুয়ার জন্ম ০৫ জানুয়ারি, ১৯৩৮। চট্টগ্রামের রাউজান থানার বিনাজুরি গ্রামে তাঁর জন্ম । বাবা সর্বানন্দ বড়ুয়া ১৯৪৩ সালের মন্বন্তরে নিরুদ্দেশ হয়ে যান। আর ফিরে আসেননি। তাঁর বয়স যখন ২৩ বছর তখন তিনি মাকে হারান। সুকুমার বড়ুয়া নিজেই বলেন, তিনি পড়াশুনা করেছেন মাত্র আড়াই ক্লাশ। তোমরা হয়তো ভাবছো, মাত্র আড়াই ক্লাশ পড়ে কী করে এমন খ্যাতি অর্জন করা যায়? হ্যাঁ, একথা সত্য যে, তিনি একাডেমিক পড়াশুনার বাইরে প্রচুর পড়াশুনা করেই এ যোগ্যতা অর্জন করেছেন। যে পড়াশুনার সীমা পরিসীমা নেই। শুধুমাত্র ছড়া লিখেই ১৯৭৭ সালে তিনি বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার পেয়েছেন। একুশে পদক ছাড়াও ঢালী মনোয়ার স্মৃতি পুরস্কার, বৌদ্ধ একাডেমি পুরস্কার, বাংলাদেশ শিশু একাডেমি পুরস্কার, অগ্রণী ব্যাংক শিশুসাহিত্য পুরস্কার, জনকণ্ঠ পুরস্কার ছাড়াও অনেক অনেক পুরস্কার তিনি অর্জন করেছেন। ০৫ জানুয়ারি সুকুমার বড়ুয়ার ৮৮ তম জন্মদিন। জন্মদিনে আমরা তাঁর সুস্থ স্বাভাবিক জীবন কামনা করছি। দীর্ঘ জীবন যাপন করে তিনি আমাদের ছড়ার অঙ্গনকে আরো সমৃদ্ধ করবেন এ প্রত্যাশা সবার।