উপন্যাস বাংলা সাহিত্যের অবিচ্ছেদ্য অংশ। উপন্যাসের পরিসর বিস্তৃত, যা মানুষের সমগ্র জীবনের প্রতিচ্ছবি । কয়েক শতাব্দী ধরে বাংলা উপন্যাসে সমাজজীবনের বাস্তবতা ঔপন্যাসিকদের লেখায় সুনিপুণ শিল্পশৈলীতে উঠে এসেছে। দুই শতাব্দী ধরে বাংলা উপন্যাসের পর্যায়ক্রমিক পরিচয় তুলে ধরার প্রয়াসে নিউইয়র্ক প্রবাসী বিশিষ্ট গবেষক ড. মুহম্মদ আবুল কাসেম রচনা করেছেন গবেষণামূলক গ্রন্থ ‘বাংলা উপন্যাসের গতি প্রকৃতিঃ শিল্প অন্বেষা (১৮০০–২০২০)। ৪১৫ পৃষ্ঠার এই বইটিতে গবেষক শুধু দুশো বছরের বাংলা উপন্যাসের গতি প্রকৃতির কথাই তুলে ধরেননি বরং বিশ্বসাহিত্যের প্রেক্ষাপটে বাংলা উপন্যাসের উদ্ভব, বিকাশ ও শ্রেষ্ঠ ঔপন্যাসিকদের সংক্ষিপ্ত পরিচয়ও তুলে ধরেছেন। এক নজরে এই বইটিকে উপন্যাসের বিশ্বকোষও বলা যেতে পারে।
মানুষের জীবনের কথা, জীবন দর্শন , জীবনবোধের বিশ্লেষণ , ইতিহাস ঐতিহ্যের অন্বেষী দৃষ্টিভঙ্গি, আধুনিক বিশ্বের শিল্প সাহিত্যের অভিজ্ঞতার সম্পৃক্ততায় জীবনচিত্রের রূপায়ন করে উপন্যাস। উপন্যাসের বিশ্লেষণের ধারাবাহিকতায় আলোচ্য বইটিতে বিভিন্ন অধ্যায়ে উপন্যাসের শিল্পকথা , আর্থসামাজিক প্রেক্ষিত, উপন্যাসের মূল্যায়ন এবং সর্বশেষ বাংলা ভাষায় অনূদিত উপন্যাস সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে বিশদভাবে। বইটির প্রতিপাদ্য বিষয় উপন্যাস। লেখক ‘উপন্যাসের শিল্পকথা’ অধ্যায়ে বিদেশি ঔপন্যাসিকদের উপন্যাস উল্লেখপূর্বক এর বিস্তারিত বর্ণনা, শিল্পরূপ এবং প্লট ও চরিত্রের প্রাসঙ্গিকতা আলোচনা করেছেন। উপন্যাস শুধুমাত্র মানবীয় চেতনার কেন্দ্রবিন্দু নয়। উপন্যাস মূলত একটি শিল্প আর এর শিল্পরূপ নিয়ে কথা বলতে গেলে বিদেশি লেখকদের রচনার দ্বন্দ্বময় এবং বহুমাত্রিক রূপ নিয়ে আসতে হয়, এ বিষয়টি লেখক বিভিন্ন উপমার মাধ্যমে এ–অধ্যায়ে তুলে ধরেছেন। এ অধ্যায়ে লেখক উপন্যাসের ব্যাপ্তিকে শ্রেণিবিন্যাসের মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলেছেন । লেখক এ পর্বে উপন্যাসের বৈচিত্র্যের উপর নির্ভর করে বাংলা উপন্যাসকে বিভক্ত করে এর বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। যাতে পাঠক উপন্যাস সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান লাভ করতে পারেন । তুলনামূলক ভাবনায় পাশ্চাত্য উপন্যাসের মৌলিক জীবনচিন্তা, সামাজিক সংকট এবং উপরন্তু সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার প্রতিফলনের স্বরূপ ঔপন্যাসিকদের লেখায় যেভাবে উঠে এসেছে গ্রন্থলেখক তার আলোচনা করেছেন সুনিপুণভাবে ।
বইটির আরেকটি অধ্যায় ‘আর্থসামাজিক প্রেক্ষিত ’। এই উপমহাদেশে অষ্টাদশ ঊনবিংশ শতাব্দীর বর্ণিল প্রেক্ষাপট, ঔপনিবেশিক শাসন কাঠামো, স্বাধিকার , মুক্তি আন্দোলন এবং একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সংগ্রামী ঘটনা ধারাবাহিকভাবে লেখক উপস্থাপন করেছেন । মূলত উপন্যাস রচনার ক্ষেত্রে এই অষ্টাদশ এবং ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রতিটি সামাজিক এবং অর্থনৈতিক ব্যবস্থা এবং ঘটনাক্রম ঔপন্যাসিকরা কখনোই এড়িয়ে যেতে পারেননি বরং এসব বিষয় তাঁরা তুলে এনেছেন উপন্যাসে । ব্রিটিশ শাসন, ৪৭ এর দেশভাগ, ৫২এর ভাষা আন্দোলন এবং একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে লেখক আর্থ সামাজিক জীবনযাত্রার চিত্র তুলে ধরেছেন এ অধ্যায়ে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বিশ্বের ইতিহাসে অসামান্য সংগ্রামী ঘটনা । যে স্বপ্ন নিয়ে জনগণ এ যুদ্ধ করেছিল তা অনেকাংশেই সফল হয়নি । বহমান সমাজ ও সময়ের কাঠামোগত অবয়বে এবং সমাজ বিবর্তনের বিকশিত রূপান্তরের শিল্পরূপ এবং জীবনের সত্য স্বরূপ উন্মোচনের চিত্ররূপ হয়ে উঠেছে বাংলা উপন্যাস । বাংলা উপন্যাসে লেখকরা মধ্যবিত্ত সমাজের অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থার চিত্ররূপ যেভাবে তুলে ধরেছেন তার বর্ণনা লেখক এই গ্রন্থে বিস্তৃত করেছেন ।
উপন্যাসের আলোচনায় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো এর শিল্পিত মূল্যায়ন। অর্থাৎ কাল ও সময়ভেদে বিভিন্ন পর্যায়ে উপন্যাসের তাৎপর্য মূল্যায়ন বা আলোচনা । বইটির নামকরণে যেহেতু সময়ের বিষয়কে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে তাই লেখক প্রাথমিক পর্ব (১৮০০–১৯০০ ) এবং আধুনিক পর্ব (১৯০১ –২০২০) এ দুটি ভাগে ভাগ করে বস্তুুনিষ্ঠ আলোচনার সুযোগ পেয়েছেন । প্রাথমিক পর্বে উপন্যাসে বাঙালির মনমানসিকতা, আত্মার বিকাশ , জীবন জিজ্ঞাসা , সমাজ সংস্কার , আত্মসম্মান এসব বিষয় পরিলক্ষিত হয় । আর এ বিষয়গুলো রাজা রামমোহন রায় , বিদ্যাসাগর , শরৎচন্দ্র , বঙ্কিমচন্দ্র , কাজী আব্দুল অদুদ , আবুল মনসুর আহমেদের রচনায় চিত্রিত হওয়ার বিষয় লেখক আলোচনা করেছেন।
উপন্যাসের আধুনিক পর্ব (১৯০১–২০২০ ) বিষয় বৈচিত্র্য, আঙ্গিকের অভিনবত্ব, দৃষ্টিভঙ্গির আধুনিকত্ব এবং জীবনযাত্রার বহুমাত্রিকতায় সমৃদ্ধ । এরই ধারাবাহিকতায় প্রমথনাথ বিশী , মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় , রশীদ করিম , আবুল ফজল , সমরেশ মজুমদারের মতো ঔপন্যাসিকের লেখায় সমৃদ্ধ হয়েছে একশ বিশ বছরের আধুনিক পর্ব । লেখক তাই সাম্প্রতিক আধুনিক ঔপন্যাসিকদের লেখার যথার্থ আলোচনা করেছেন । আধুনিক পর্বের লেখকদের চিন্তা ও মানবিকবোধ সম্পন্ন মুক্তবুদ্ধির মাধ্যমে রচিত উপন্যাসের অন্তর্নিহিত ব্যাখ্যা লেখকের লেখায় ফুটে উঠেছে। এই আধুনিক পর্বের বিংশ শতাব্দীতে ঘটে গিয়েছিল দুইটি মহাযুদ্ধ এবং ভারতীয় উপমহাদেশে দেশভাগ এবং মুক্তিযুদ্ধ। এ ঘটনাপ্রবাহের ভিত্তিতে বেশকিছু উপন্যাস রচিত হয়েছে এবং লেখক এসব ঔপন্যাসিকদের লেখা ব্যাখ্যা করেছেন বিশ্লেষণী ভাষায়। বইয়ের সর্বশেষ অধ্যায়টি হল ‘বাংলা ভাষায় অনূদিত উপন্যাস ’। বিশ্বসাহিত্যের বেশকিছু ধ্রুপদী উপন্যাসের বাংলা ভাষায় অনুবাদের কাজটি করেছেন দুই বাংলার সুদক্ষ লেখকেরা । তারই নিদর্শন ব্যাখ্যা করতে গিয়ে লেখক এ পর্বে দামোদর মুখোপাধ্যায় , মুনতাসীর মামুন , ননী ভৌমিকের মত অনুবাদকের ভূমিকা বিস্তাারিত আলোচনা করেছেন। নিউইয়র্কের মতো একটি ব্যস্ততম শহরে অবস্থান করে লেখক ডঃ মুহম্মদ আবুল কাশেম ধৈর্য, নিষ্ঠা এবং পরিশ্রমের মাধ্যমে এই গবেষণা গ্রন্থটি লিখেছেন । ১৮০০ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত রচিত উপন্যাসের প্রকৃতি এবং জীবন চেতনার পর্যায় লেখক শিল্পিত দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে পর্যালোচনা করার প্রয়াস পেয়েছেন আলোচ্য গ্রন্থে । এটি ২০২৩ সালের জুনে প্রকাশ করেছে ঢাকার প্রকাশক ‘গ্রন্থরাজ্য’ । ৪১৫ পৃষ্ঠার এই বইটি শিক্ষার্থী এবং সাধারণ পাঠকদের মাঝে সমাদৃত হবে বলে আশা করা যায় । বইটির দাম রাখা হয়েছে ৭৫০টাকা ।