বাংলার সুফিসাধক হযরত শাহজাহান শাহ

ড. মোহাম্মদ জাফর উল্লাহ | মঙ্গলবার , ৮ অক্টোবর, ২০২৪ at ৬:০২ পূর্বাহ্ণ

সুফিসাধকরাই মানবতার প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে যুগে যুগে দেশদেশান্তরে ইসলামের উদারতার বাণী প্রচার করেছেন। আমাদের মাতৃভূমিও এর ব্যতিক্রম নয়। যেসব সুফিসাধকের আগমনে বঙ্গভূমি ঋদ্ধ হয়েছে তাঁদের মধ্যে হযরত শাহজাহান শাহ অন্যতম। সুফিবাদ ও তাসাউফ হলো একটি মানবিক বিপ্লবের নাম। কালের বিভিন্ন বাঁকে এটি বিভিন্ন রূপে বিকশিত হয়েছে। জাগতিক লোভলালসায় মগ্ন সমাজকে এটি পবিত্র আত্মা ও মোহমুক্ত জীবনের প্রতি উদ্বুদ্ধ করেছে। নৈতিক অবক্ষয়ের স্তুূপে দাঁড়িয়ে এটি আত্মার পরিশুদ্ধতার সিঁড়ি বেয়ে উত্তম চরিত্রের গগনে উঠার পথ দেখিয়েছে।

মুসলিম অধ্যুষিত পশ্চিম ও মধ্য এশিয়া এবং উত্তর ভারত থেকে বিভিন্ন সময়ে শত শত সুফি দরবেশ বাংলাদেশে আগমন করেন। তাঁরা নানা তরিকার, বিশেষ করে চিশতিয়া ও সোহরাওয়ার্দীয়া সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। সুফিবাদ বহির্দেশ থেকে আমদানিকৃত হলেও কালপরিক্রমায় বাংলাদেশ সুফিবাদ বিস্তারে উপযুক্ত ক্ষেত্রে পরিণত হয়। সুফিবাদ সমগ্র বাংলাদেশের গ্রামগ্রামান্তরে ছড়িয়ে আছে। সুফিদের খানকাহ ও দরগাহ দেশের প্রত্যান্তাঞ্চলে দেখা যায়।

সুদূর ইয়ামান থেকে আসা হযরত শাহজাহান শাহ (রাহ.)-কে ইতিহাসের নিরিখে মূল্যায়ন করতে হলে সমকালীন চট্টগ্রাম ও তৎসন্নিহিত আরাকান রাজ্যের রাজনৈতিক উত্থানপতন সম্পর্কেও আমাদের কিছু মৌলিক বিষয় জানা দরকার। বংলার প্রথম স্বাধীন সুলতান ফখরুদ্দীন মুবারক শাহ ১৩৪০ খ্রি. চট্টগ্রাম বিজয়ের পর আরব, ইয়েমেন, পারস্য, আফগানিস্তান ও তুরস্ক থেকে অনেক মুসলিম সুফিসাধক চট্টগ্রাম এসে ইসলাম প্রচার শুরু করেন।

চতুর্দশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে সুলতান ফখরুদ্দীন মোবারক শাহ চট্টগ্রাম দখল করেন বলে ইতিহাস থেকে জানা যায়। তবে তা স্থায়ী হয়নি। পরবর্তীকালে এই অঞ্চল আবার ত্রিপুরা ও আরাকান রাজার দখলে চলে যায়। ফখরুদ্দীন মোবারক শাহ’র চট্টগ্রাম অভিযানের উপর ভিত্তি করে চতুর্দশ ও পঞ্চদশ শতকে চট্টগ্রামে বহু সুফিসাধকের আগমন ঘটে। তাঁদের মধ্যে একজন উচ্চমার্গের অলি ও সুফিসাধক ছিলেন হযরত শাহজাহান শাহ। সুফিগণের আগমনে চট্টগ্রামে ইসলামধর্মের গোড়াপত্তন ঘটে এবং সুফিদের ধ্যানসাধানায়, অলৌকিক ক্রিয়াকলাপে অনেক লোক ইসলাম ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হয় এবং ইসলাম গ্রহণ করে।

সূুফিরা আধ্যাত্মিকসাধক। আধ্যাত্মিক সাধনায় উচ্চমার্গে উন্নীত সাধক ইচ্ছে করলে অলৌকিকভাবে মানব জগতের উপকার সাধন করতে পারেন। যা পবিত্র কুরআনসুন্নাহ সমর্থন করে। উল্লেখ্য, ফখরুদ্দীনের চট্টগ্রাম বিজয়ের (১৩৪০ খ্রিঃ) পরবর্তী তিন শতাব্দী যাবত চট্টগ্রামের উপর রাজনৈতিক কর্তৃত্ব নিয়ে, ত্রিপুরার হিন্দু রাজা, আরাকানের বৌদ্ধরাজা এবং তার পাশাপাশি বিদেশী পর্তুগীজ ঔপনিবেশিক শক্তির সাথে বাংলার মুসলিম সুলতানদের লড়াই অব্যাহত থাকে। ১৪০৬ খ্রিষ্টাব্দে আরাকানের রাজা ছিলেন সেং সোয়ামন। চট্টগ্রাম তখন তাঁরই অধিকারে। তিনি বর্মী রাজার হাতে পরাজিত হয়ে বাংলায় আশ্রয় নেন। বাংলায় তখন রাজা গণেশের পুত্র যদু ইসলাম গ্রহণ করে জালালউদ্দীন নাম ধারণ করে শাসনভার পরিচালানা করছিলেন। প্রায় ২৪ বছর রাজ্যহারা আরাকান রাজা চট্টগ্রামে অবস্থান করেন। পরে সুলতান জালাল উদ্দীনের সহায়তায় রাজ্যহারা আরাকান রাজা আবার তাঁর সিংহাসন ফিরে পান। এই সাহায্যের কৃতজ্ঞতা স্বরূপ আরাকান রাজার পৃষ্ঠপোষকতায় মুসলিম সুফিসাধকেরা চট্টগ্রামে ধর্ম প্রচারের সুযোগ পান।

খ্রিষ্টীয় পঞ্চদশ শতকের গোড়ার দিকে আরাকান রাজা কর্তৃক চট্টগ্রাম দখলের এ সময়কালের সাথে হযরত শাহজাহান শাহ’র (রহ.) চট্টগ্রাম আগমনের সময়কালটি অনেকটাই সমসাময়িক বলে মনে হয়। কারণ ধলই দরবার শরীফের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়এই মাজার শরীফ সংস্কারের বিষয়টি নিয়ে ধলই দরবার শরীফ কমপ্লেক্সের সেক্রেটারী মাওলানা মুহাম্মদ নুরুল আলম চৌধরী উল্লেখ করেছেনআমাদের পূর্বপুরুষগণ মাজার শরীফ প্রশস্ত ও মেরামত করার সময় একটি শিলালিপি পেয়েছিলেন। তাঁরা শিলালিপিটি গবেষণা করে তাঁর ওফাত দিবস নির্ধারণ করেছেন। এই সূত্র ধরে ২০শে মাঘ, ১৪২ বাংলা, মোতাবেক ২রা ফেব্রুয়ারী, ২০০৬ খ্রি. তারিখে তাঁর ৫০০ তম ওফাত বার্ষিকী উদযাপন করা হয়েছে।

হযরত শাহজাহান শাহ (রাহ.) এর ওফাত দিবস হচ্ছে২রা ফেব্রুয়ারী ১৫০৬ খ্রি., মোতাবেক ২০শে মাঘ, ৯১২ বাংলা সন। মাজার শরীফটি সংস্কারের সময় সেখানে যে শিলালিপিটি পাওয়া যায় তাতে মগী ভাষায় সনতারিখ লিখা ছিল। উল্লেখ্য, উক্ত সংস্কারের কাজের সময় মাজার সন্নিহিত অপর একটি কবরের কিছু মাটি খুঁড়া হয়ে যায়। এতে কবরের অভ্যন্তরে একজন সদ্য সমাহিত লাশের মত ধবধবে সাদা কাফন ও একটা ‘আসা’ বা লাঠি দেখা যায়। এগুলো থেকে সুগন্ধি বের হতে থাকে বলে নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা যায়। এই কবরটিও এ মাহান অলি হযরত শাহ জাহান শাহর কোন এক বুজুর্গ খাদেমের বলে মনে করা হয়। এই সময় মাজারে যে ইট পাওয়া যায়, তা পঞ্চদশ ঈসায়ী সনের তৈরী বলে মাজার কর্তৃপক্ষ সূত্রে প্রকাশ। ইতিহাসের পাতা বেয়ে চট্টগ্রামের সমসাময়িক ধর্মীয় অবস্থার প্রতি দৃষ্টিপাত করলে দেখা যায়তখন এখানে মগরাজ্য ছিল। স্থানীয় অধিবাসীগণ ছিল মগ। তাদেরকে তিনি (হযরত শাহজাহান শাহ) ইসলামের সুশীতল পরশ ও আধ্যাত্মিক ক্ষমতা বলে বিনা যুদ্ধে আল্লাহর মনোনীত পবিত্র ধর্ম ইসলামে দীক্ষিত করেন। হযরত শাহজাহান শাহ (রাহ.) এবং তাঁর সময়কাল সম্পর্কে ধলই দরবার শরীফের সেক্রেটারীর এ বক্তব্যটি বিশ্লেষণ করে বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ প্রফেসর রেজাউল করিম বলেনআমার কাছে ইতিহাসের নিরিখে এটি অত্যন্ত যুক্তিসঙ্গত বলে মনে হয়। কারণ ‘রাজমালা’ গ্রন্থের বিবরণ এবং পাকিস্তান স্টাডিজ কর্তৃক ১৯৭০ সনে প্রকাশিত চট্টগ্রামের ইতিকথা পুস্তকের বক্তব্যের রেফারেন্সগুলোর সাথে ধলই দরবার শরীফের এই দাবীগুলো যথেষ্ট সামঞ্জস্যপূর্ণ।

ইয়ামেন থেকে আগত প্রায় পাঁচশত বছর পূর্বে হাটহাজারীর ধলই গ্রামে শায়িত কুতুল ইরশাদ হযরত শাহজাহান শাহ একজন অতি উচ্চমার্গের ওলিআল্লাহ ছিলেন। এটি সর্বজন স্বীকৃত। তাঁর জন্মবৃত্তান্ত আমাদের কাছে ঐতিহাসিকভাবে না থাকলেও তিনি যে, একজন সিদ্ধপুরুষ তা আমাদের কাছে পূর্ণিমার চাঁদের ন্যায় উজ্জ্বল। পাঁচশত বছরব্যাপী চলমান জনশ্রুতি, তাঁর সম্পর্কে প্রাপ্ত ওলিআল্লাহগণের মন্তব্য, জাতিধর্মবর্ণ নির্বিশেষে তাঁর থেকে আশির্বাদপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের সাক্ষ্যপ্রমাণ এর উৎকৃষ্ট দলিল। অলীকুল শিরোমণি হযরত শাহ জাহানশাহ (রা.) সম্পর্কে জনশ্রুতির ইতিহাস প্রায় পাঁচশত বছরের অধিক। এ সুদীর্ঘ সময়ব্যাপী বংশ পরম্পরায় এলাকার অধিবাসীদের মধ্যে তাঁর কেরামত ও ঘটনাবলির অজস্র কাহিনী অকাট্যভাবে স্বীকৃত।

পাঁচশত বছর পূর্বে যেখানে কোন মুসলিমের নামে কোন জায়গা জমি এতদাঞ্চলে ছিলো না সেখানে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ জনভূমি সত্যিই সুফিসাধকগণের অপরিসীম ত্যাগের ফসল। তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধায়ভক্তিতে আমাদের দেহমন ঝুঁকে যায়। হযরত শাহজাহান শাহসহ সকল সুফিসাধকের ত্যাগের প্রতি সশ্রদ্ধ প্রণাম জানাই। তাঁদের রেখে যাওয়া স্মৃতিকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠোক আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি; যাতে থাকবে না কোন হিংসাবিদ্বেষ, হানানহানি। মানুষ মানুষের জন্য স্লোগানে মুখরিত হবে আমাদের দেশ। জয় হোক মানবতার, জয় হোক সুফিসাধকগণের আদর্শের।

লেখক : অধ্যাপক, আরবি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

পূর্ববর্তী নিবন্ধপুরাতন সার্কিট হাউজের সামনের মাঠটি সবুজ ও উন্মুক্ত রাখা জরুরি
পরবর্তী নিবন্ধচামড়া শিল্পের উন্নয়নে চাই যথাযথ ব্যবস্থাপনা