বাংলায় সুফিবাদ, বাঙালি সংস্কৃতি ও বর্তমান প্রেক্ষাপট

ড. আবদুল আজিম শাহ্‌ | বুধবার , ৩ জুলাই, ২০২৪ at ১১:০৩ পূর্বাহ্ণ

সপ্তম শতাব্দীতে আরব থেকে সুফিদের মাধ্যেমে ভারতবর্ষে ধর্মের প্রচার প্রসার শুরু হয়। সুফিরা এ অঞ্চলে খানকাহ প্রতিষ্ঠা করে মানুষকে সত্যের বাণী শুনিয়েছেন। সুফিরা ছিলেন উদার, কল্যাণকারী বিনয়ী সহ বহুগুণে গুণান্বিত। সুফিধারার পাশাপাশি রক্ষণশীলধারার আগমন ঘটলেও এরা মানুষকে খুব একটা প্রভাবিত করতে পারেনি। সুফিদের উত্তমচরিত্রের কারণে মানুষ সহজেই তাঁদের গ্রহণ করে নেয়। তাঁরা বিভিন্ন তরিকার মাধ্যমে খোদাপ্রাপ্তির পথকে সহজ করেছেন। সর্বধর্ম সমন্বয়, জীবেপ্রেম ও সম্প্রীতির বন্ধন ছিল তাঁদের চেতনায়। কট্টরতাকে প্রশ্রয় দেয়নি। সুফিদের সাথে রক্ষণশীলদের চিন্তা চেতনায় আকাশপাতাল পার্থক্য। উত্তম আদর্শের জন্য সকলধর্মানুসারিরা সুফিদের খানকায় নিয়মিত যাওয়াআসা করতেন। ফলে এদের খানকাহ/মাজার শরিফ হয়ে ওঠে সকল জাতির প্রেমভক্তি ও মুক্তির কেন্দ্র।

২০১৪ সালে বাংলা একাডেমির অমর একুশে স্মারক বক্তৃতায় ইতিহাসবিদ সালাউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘বাংলাদেশে ইসলাম প্রচারের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় রক্ষণশীল মৌলবীদের প্রচারণার চেয়ে সুফিসাধক, পীরদরবেশরা ইসলাম প্রচারে অধিক কার্যকর ভূমিকা রেখেছে। এসব মরমী সাধকদের অনেকে তাঁদের ব্যক্তিগত চারিত্রিক গুণাবলীর কারণে সব শ্রেণির কাছে শ্রদ্ধাভাজন হয়েছিলেন। ধর্মের ক্ষেত্রে তাঁরা ঐতিহ্য, সহিষ্ণুতার মাধ্যমে বাংলার মন ও মানসকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে। আমাদের সংস্কৃতিক ঐতিহ্যে যে ধারাটি প্রাধান্য পেয়ে এসেছে, সেটি সংঘাত বা বিরোধের ধারা নয় বরং বিভিন্ন মতবাদের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ও ধর্ম সমন্বয়ের ধারা। সুফিদের জন্য এদেশে সকল ধর্মের মানুষের সহাবস্থান ছিল’। সুফি ধারাবাহিকতায় মাইজভান্ডার শরিফের হজরত সৈয়দ আহমদউল্লাহ (.)মাইজভান্ডারী ‘তৌহিদে আদিয়ান’ প্রতিষ্ঠা করেন। তৎপরবর্তী আরেক মহানসুফি হযরত মতিয়র রহমান শাহ্‌(.) ফরহাদাবাদি সুবুদ্ধির দর্শনের মাধ্যমে ধর্মভেদাভেদ, কর্তৃত্ব নয়; বরং সহযোগিতাসহমর্মিতার দ্বারা সকলধর্মানুসারির সহাবস্থানসহ বিশ্বকে একটি পরিবার মনে করার শিক্ষা দিয়েছেন। এভাবে শিখেছি কীভাবে জ্ঞান ও সংস্কৃতিকে ধরে রাখতে হয়। সুফিরা সাধনার মাধ্যমে ইলহামপ্রাপ্ত হয়ে সকলকে সঠিকপথের সন্ধান দিয়েছেন। অতএব তাঁদের দেখানো পথই সঠিক পথ। তাঁরা শিখিয়েছেন শবে বরাত, মুহররম, ঈদমিলাদুন্নবী(.), মিলাদকিয়াম, ফাতেহা সহ অন্যান্য ধর্মীয় উৎসব কীভাবে পালন করতে হয়। এছাড়া জাতীয় উৎসব ও সংস্কৃতি পালন করতেও উদ্বুদ্ধ করেছেন। শববরাত ভারতসহ বাংলার মুসলিমরা অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে পালন করে। এ রাতে প্রেমিকবান্দাগণ আল্লাহর সন্তুষ্টির আশায় নফল নামাজ, কোরআন তেলাওয়াত, জিকিরে মগ্ন থাকে। অতীত পাপের জন্য ক্ষমাসহ মাজারমসজিদে আল্লাহর নিকট অনুগ্রহ প্রার্থনা করেন। ঐদিন ধর্মপ্রাণ বান্দা আউলিয়াদের মাজারসহ প্রয়াত মুরব্বিদের কবর জিয়ারত করেন। আত্মীয়, প্রতিবেশি, দুস্থদের মধ্যে হালুয়ারুটিসহ নানারকম খাবার বিতরণ করেন। এমনকী শিশুদেরও শিখিয়েছেন আনন্দসহকারে এইরাত উৎযাপন করতে। বাংলার মুসলিমরা বংশপরস্পরায় উৎসবসহকারে পালন করে আসছে। কিন্তু হঠাৎ করে একশ্রেণি ইসলামের দোহাই দিয়ে পবিত্র রাত পালনকে বেদাত ফতোয়া দিয়ে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। সুফিরা ঈদের সময় ধনীদরিদ্র, শত্রুমিত্র, ভেদাভেদ ভুলে কোলাকুলি করতে শিখিয়েছেন। এতে ভেদাভেদের প্রাচীর ভেঙে একে অপরকে কাছে টেনে নেয়। আত্মিক ও সামাজিক বন্ধন অটুট হয়। কিন্তু এই প্রথাকেও ধ্বংসের অপচেষ্টা চালাচ্ছে! তারা বলছেকোলাকুলি করা যাবে না, এগুলো বেদাত। সুফিরা মুরুব্বীদের কদমবুচি করার শিক্ষা দিয়েছেন। ভারতবর্ষ সহ বাংলার সংস্কৃতিতে তা এখনো বিদ্যমান। এটি বিনয় ও আদবের বহিঃপ্রকাশ। কিছুলোক ফতোয়া দিয়ে সুন্দর সংস্কৃতিকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। যুবসমাজকে বুঝাচ্ছেনএগুলো শিরক। এ চেতনায় প্রভাবিত হয়ে যুবসমাজের অধিকাংশই আজকাল মুরব্বিদের কদমবুচি করে না।

সুফিরা শিখিয়েছেনঈদে মিলাদুন্নবী পালন করা। মিলাদ, দরুদ ও বিভিন্ন আনুষ্ঠানিকতার মাধ্যমে নবীপ্রেমিকগণ এই দিবস উদযাপন করে। এটি বাংলার সংস্কৃতির অংশে পরিণত হয়েছে। দুঃখের বিষয়বর্তমানে ঈদে মিলাদুন্নবীকেও প্রশ্নবিদ্ধ করছে। এটি নাকি অত্যন্ত গুনাহের কাজ। যুগেযুগে এনিয়ে কোনোরকম প্রশ্নের অবতারণা হয়নি, নাজায়েজ বলা দূরের কথা। হাজার বছর ধরে রমজান মাসে তারাবির ২০ রাকাত নামাজের প্রচলন হয়ে আসছে। এনিয়ে কখনো কেউ কোনো মতভেদ হয়নি। সকলেই পালন করেছে। হঠাৎ করে একশ্রেণি বলে বেড়াচ্ছে তারাবির নামাজ নাকি ১২ রাকাত। এক অংশ বলছে ৮ রাকাত। ২০/১২/ র দ্বন্দ্বে সাধারণ মুসলমান খুবই বিপদে আছে। ধর্মপ্রাণ মুসলমান দ্বন্দ্ব, সংঘাতেও লিপ্ত হচ্ছে। সুফিরা শিখিয়েছেন সকল ধর্মানুসারিরা যেযার মত স্রষ্টাকে স্মরণ করবে, কেউ কারো মত ও পথে সাংঘর্ষিক নয়। কী সুন্দর সাম্যতার শিক্ষা দিয়েছেন সুফিরা! অথচ একশ্রেণির রক্ষণশীলরা শিখাচ্ছেএসব গুনাহ। অন্যধর্মের অনুসারীরা নাকি আমাদের শত্রু। কী অদ্ভুত চেতনা! দশ মহরম ইয়াজিদ বাহিনী ইমাম হোসাইনসহ আহলেবায়াতকে হত্যার মাধ্যমে রসূলে পাক(.)’র বংশ ও আদর্শের পরম্পরাকে নিশ্চিহ্ন করতে চেয়েছে। বিশ্বমুসলিমরা একে শোকদিবস হিসেবে পালন করে। ইমাম হুসাইন(.)’র নির্মম হত্যাকাণ্ড মুসলমানের হৃদয়কে সন্তপ্ত করেছে। শোকগাথা স্মরণে সুফিকবি কাজী নজরুল ইসলাম(রহ.) লিখেছেন ‘মহররম’ কবিতা, মীর মোশারফ হোসেন লিখেছেন ‘বিষাদসিন্ধু’ সহ হৃদয়বিদারক অসংখ্যকাব্য, কবিতা, পুথিপুস্তক। এসব শুনে বাংলার মুসলমানরা কান্না করে। কিন্তু একশ্রেণি প্রচার করছেএই কাহিনি অসত্য। আহলেবায়াতের প্রতি ভালোবাসা দেখানো নাকি গুনাহের কাজ; এসব কি ভাবা যায়? বাঙালি মুসলিমরা বিভিন্ন উপলক্ষ্যে মিলাদ শরীফের আয়োজন করে। এতে রসূলেপাকের প্রতি ভক্তিপ্রদর্শনপূর্বক আবেগ আপ্লুত হয়ে দাঁড়িয়ে ইয়া নবী সালাম আলাইকা, ইয়া রসূল সালাম আলাইকা ইত্যাদি এবং আউলিয়াদের প্রতি ইয়া গাউসুল সালাম আলাইকা, ইয়া মুর্শিদ সালাম আলাইকাসহ বিভিন্নভাবে গুণকীর্তন করে দাঁড়িয়ে সম্মান(কিয়াম) জানায় এবং অনেকে সেমাহকাওয়ালী সহ তবারকের ব্যবস্থাও করে। এতে জাতিধর্ম নির্বিশেষে নিমন্ত্রণ পায়। এগুলো ধর্মের সাথে বাঙালির সংস্কৃতির অংশে পরিণত হয়েছে। রসূল(.)কে হাজিরনাজির জেনে দাঁড়িয়ে সম্মান প্রদর্শন করা নাকি মস্তবড় গুনাহ! এতে কি কারো, কোনো অসুবিধা হয়? তারা রসূলে পাকের প্রতি দরুদ পাঠকে অবান্তরভিত্তিহীন বলে মুসলিম উম্মাহকে বিভ্রান্তিতে ফেলছে।

সমবেত হয়ে হাত তুলে ফরিয়াদ করলে কারো না কারো উসিলায় আল্লাহ সকলকে কবুল করতে পারেন। এটাও নাকি অশুদ্ধ। এনিয়ে প্রশ্ন তোলার উদ্দেশ্যই হচ্ছে মুসলিম উম্মাহর ঐক্য নষ্ট করা। লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ ‘একই সাথে ছিল এবং আছে। এটি নাকি শিরক। স্বয়ং আল্লাহ তাআলা রসূলকে নিজ থেকে কখনো পৃথক করেননি, অথচ আমরাই আল্লাহ থেকে রসূলকে পৃথক করার অপচেষ্টা চালাচ্ছি। এসব নেতিবাচক ধারণা মানুষের মনে দ্বিধাদ্বন্দ্বের সৃষ্টি করছে। কোনটি সঠিক, কোনটি বেঠিক তা নির্ণয় করাও সাধারণের পক্ষে কঠিন।

কোনো জ্ঞান, সংস্কৃতিকে ধ্বংস করার প্রধান হাতিয়ার হল একে প্রশ্নবিদ্ধ করে, এর ভিত্তিকে নড়বড়ে করা। এবং ধর্মের দোহাই দিয়ে অসত্যকে সত্য বলে চালিয়ে দেওয়া। জন্ম থেকেই দেখছি এদেশে সর্বধর্মের মানুষ শান্তিপূর্ণভাবে সহাবস্থান করে যার যার ধর্ম পালন করে আসছে। সহাবস্থানকে ধ্বংস করে বিভেদ সৃষ্টিই তাদের প্রধান লক্ষ্য। বাংলার মত সর্বধর্মের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান পৃথিবীর কোথাও নেই। তারা সুফিদের উদার চিন্তাধারাকে বাদ দিয়ে কট্টরতাকে প্রতিষ্ঠা করতে চায়। সুফিরা আল্লাহ, রসূল(.)কে চেনা ও জানার পথকে সুগম করেছেন। ধর্ম সম্পর্কে জ্ঞান দিয়েছেন। অথচ রক্ষণশীলদের দৃষ্টিতে তাঁরাই হয়ে গেল ভণ্ড। তাঁদের খানকাহও নাকি অবৈধ। সাধারণ মুসলমান সত্যমিথ্যা নির্ধারণ করতে না পারলেও অন্তত এই বিশ্বাস রাখা উচিত সুফিদের মাধ্যমে প্রাপ্তজ্ঞান, সংস্কৃতি যা বহুকাল ধরে মুসলমান পালন করে আসছে, এগুলোতে কোনো ভুল দূরের কথা, বরং এদের দেখানো পথই সঠিক। তাঁরা সাধনার মাধ্যমে এলহামপ্রাপ্ত হয়ে আল্লাহর গুণে গুণান্বিত হয়েছেন। অতএব এদের দেখানো জ্ঞান, সংস্কৃতি, পথ কখনো অসত্য হতে পারে না। এ বিশ্বাস যদি মনের গভীরে ধরে রাখা যায়তাহলে সাধারণ মুসলমানদের বিভ্রান্তি করা সহজ হবে না। সত্যকে ধামাচাপা দেওয়া যায়, কিন্তু চিরতরে ধ্বংস করা যায় না। সুফিরা সত্য, সুফিবাদ সত্য। অতএব সুফিবাদ ও বাংলার অসম্প্রদায়িক সংস্কৃতিকে নিশ্চিহ্ন করার যতই চেষ্টা হোক না কেন ;স্বার্থন্বেষী মহল সফল হবে না।কারণ সুফি এবং সুফিবাদ এদেশে ধর্মপ্রাণদের হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছে।এদেশে সুফিবাদের শেকড় অনেক গভীর। মানুষ সবসময় সত্যের সন্ধান করে,যেটি বাংলার মানুষ খুঁজে পেয়েছে সুফিদের খানকাহ ও দরবারে।এজন্য সুফিরা সর্বকালে সর্বধর্মের লোকের কাছে গ্রহণযোগ্য। মনে রাখা প্রয়োজনযে জাতি নিজস্ব জ্ঞান, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য থেকে বিচ্ছিন্ন হয়, তখন তার পতন অবধারিত। এই অপচেষ্টা বাংলাদেশে একটি গোষ্ঠী করছে খুবই পরিকল্পিতভাবে; তাও ধর্মের দোহাই দিয়ে। এ বিষয়ে সকলকে ঐক্যবদ্ধ ও সচেতন হওয়া আবশ্যক। অন্যথায় সম্প্রীতি ও সহাবস্থানের দেশ বাংলাকে অচিরেই ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাবে। এসব বিষয়ে সকলকে সাবধান ও সচেতন হওয়া প্রয়োজন।

লেখক : প্রাবন্ধিক; সাজ্জাদানশীন, মতিভাণ্ডার দরবার শরীফ, ফটিকছড়ি, চট্টগ্রাম।

পূর্ববর্তী নিবন্ধঅ্যাটর্নি জেনারেল দেশে দেশে
পরবর্তী নিবন্ধদরবারে আজিজিয়ায় ওরশ সম্পন্ন