দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক জোরদারের নানা দিক নিয়ে আলোচনা করেছেন প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস ও ভুটানের প্রধানমন্ত্রী শেরিং তোবগে। বৈঠকে ভুটানকে বাংলাদেশের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বন্ধু অভিহিত করেন প্রধান উপদেষ্টা। আর বাংলাদেশকে ভুটানের আধ্যাত্মিক ঐতিহ্যের উৎস বলেন তোবগে। গতকাল শনিবার ঢাকার তেজগাঁওয়ে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে এ দ্বিপক্ষীয় বৈঠক হয়। পরে প্রধান উপদেষ্টার দপ্তর এক বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে বৈঠকের বিস্তারিত জানায়।
দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের সব ক্ষেত্রে দুই নেতা বিস্তারিত আলোচনা করেন। বাণিজ্য, জ্বালানি, শিক্ষা, পর্যটন, ইন্টারনেট সহযোগিতা, পরিবহন, স্বাস্থ্যসেবা, পরিবেশ, পানি সম্পদ, বিনিয়োগ ও বিমান চলাচলসহ নানা বিষয় তাদের আলোচনায় উঠে আসে। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, প্রধানমন্ত্রী তোবগে বিকাল ৩টা ১৫ মিনিটে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে পৌঁছান। দুই নেতা প্রথমে ৩০ মিনিটের একান্ত বৈঠক করেন; এরপর প্রায় এক ঘণ্টা ধরে আনুষ্ঠানিক দ্বিপক্ষীয় আলোচনা চলে। খবর বাসস ও বিডিনিউজের।
এর আগে তিন দিনের সফরে গতকাল শনিবার সকাল সোয়া ৮টায় ঢাকার শাহজালাল বিমানবন্দরে পৌঁছান ভুটানের প্রধানমন্ত্রী শেরিং তোবগে। তাকে বিমানবন্দরে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানান প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস। সেখানে দুই নেতার মধ্যে সংক্ষিপ্ত বৈঠক হওয়ার পর শেরিং তোবগেকে গার্ড অব অনার দেয় সশস্ত্র বাহিনীর একটি চৌকস দল। বিমানবন্দরের আনুষ্ঠানিকতা শেষে ভুটানের প্রধানমন্ত্রী সাভারের জাতীয় স্মৃতিসৌধে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান। এ সময় শেরিং তোবগে স্মৃতিসৌধ প্রাঙ্গণে একটি গাছ রোপণ করেন এবং দর্শনার্থী বইয়ে সই করেন।
দুই সরকার প্রধানের বৈঠকে ভুটানকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বন্ধু অভিহিত করে ইউনুস বলেন, আঞ্চলিক বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক সহযোগিতার ক্ষেত্রে ঢাকার দৃষ্টিভঙ্গিতে ভুটান গুরুত্বপূর্ণ অংশ। ভূগোল ও প্রকৃতি আমাদের একত্রিত করেছে। আমাদের নিয়তি হলো একসঙ্গে ভবিষ্যৎ নির্মাণ করা। তোবগে বলেন, ভুটান ও বাংলাদেশের মধ্যে দীর্ঘদিনের উষ্ণ ও চমৎকার সম্পর্ক রয়েছে। তিনি বাংলাদেশকে ভুটানের আধ্যাত্মিক ঐতিহ্যের উৎস মন্তব্য করে বলেন, মধ্যযুগে বাংলার সন্ন্যাসীরাই হিমালয় অঞ্চলে বৌদ্ধধর্ম প্রচার করেছিলেন। ভুটানের প্রধানমন্ত্রী বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা আরও গভীর করার ওপর গুরুত্বারোপ করেন। তিনি বলেন, যদি আমাদের সমৃদ্ধ হতে হয়, আমাদের অবশ্যই একসঙ্গে সমৃদ্ধ হতে হবে। উভয়পক্ষ একটি দ্বিপক্ষীয় মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির (এফটিএ) বিষয়ে আনুষ্ঠানিক আলোচনা শুরুর পরিকল্পনা নিয়েও মতবিনিময় করে।
২০২০ সালে দুই দেশ একটি প্রেফারেনশিয়াল ট্রেড এগ্রিমেন্ট (পিটিএ) সই করেছিল। তোবগে বলেন, থিম্পু যত দ্রুত সম্ভব এফটিএ সই করতে চায়। তিনি আশা করেন, ভুটান হবে বাংলাদেশের সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি করা প্রথম দেশ। প্রধান উপদেষ্টা জানান, ভুটানের সঙ্গে পণ্য পরিবহণ সহজ করতে বাংলাদেশ উচ্চ অগ্রাধিকার দিচ্ছে। ভুটানের কনটেইনার দ্রুত ছাড়পত্র দিতে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দিয়েছেন বলেও জানান তিনি।
দুই দেশ দ্বিমুখী পর্যটন বৃদ্ধিতে একটি যৌথ কর্মদল গঠনে সম্মত হয়। বাংলার বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের অবদান স্মরণ করে মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, তিনি আশা করেন, আরও বেশি ভুটানের পর্যটক বাংলাদেশের বৌদ্ধ ঐতিহ্য আবিষ্কারে আগ্রহী হবেন। প্রধান উপদেষ্টা জানান, বাংলাদেশ নীলফামারীতে এক হাজার শয্যার একটি হাসপাতাল ও মেডিকেল কলেজ নির্মাণ করছে। তিনি ভুটানের নাগরিকদের ভবিষ্যতে এই চিকিৎসা ও শিক্ষাসেবা গ্রহণের আমন্ত্রণ জানান।
আনুষ্ঠানিক আলোচনার পর স্বাস্থ্যসেবায় সহযোগিতা এবং ইন্টারনেট ব্যান্ডউইথ বাণিজ্য নিয়ে দুই দেশের মধ্যে দুটি সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) সই হয়। দুই নেতা স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। প্রধান উপদেষ্টা আশা প্রকাশ করে বলেন, আরও বেশি বাংলাদেশি চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মী এখন ভুটানে কাজের সুযোগ পাবেন, বিশেষত উন্নয়নাধীন গেলেফু নতুন অর্থনৈতিক শহরে। ইন্টারনেট ব্যান্ডউইথ চুক্তির আওতায় ভুটান বাংলাদেশ থেকে ব্যান্ডউইথ আমদানি করবে। পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন বলেন, ঢাকা আশা করছে এই রপ্তানি ভুটানের ডিজিটাল সংযোগ আরও শক্তিশালী করবে এবং ডিজিটাল বিভাজন কমাবে। বাংলাদেশ ভুটানের শিক্ষার্থীদের জন্য মেডিকেল কলেজে আসন সংখ্যা বাড়ানোর পাশাপাশি বুয়েটে আসন বরাদ্দেরও ঘোষণা দেয়।
প্রধানমন্ত্রী তোবগে জানান, ভুটানের অনেক শীর্ষ চিকিৎসকই বাংলাদেশের মেডিকেল কলেজের প্রাক্তন শিক্ষার্থী। তিনি বলেন, ভুটান ‘গেলেফু মাইন্ডফুলনেস সিটি’ নামে একটি বড় অর্থনৈতিক কেন্দ্র নির্মাণ করছে এবং নারায়ণগঞ্জে ভুটানের পণ্য ওঠানামার জন্য জায়গাসহ বাংলাদেশের সহযোগিতা কামনা করেন।
দুই নেতা ভুটান থেকে জলবিদ্যুৎ আমদানির সম্ভাবনা নিয়েও আলোচনা করেন, যেখানে ভারতকে অন্তর্ভুক্ত করে ত্রিপক্ষীয় বিদ্যুৎ বাণিজ্য চুক্তির সম্ভাবনা রয়েছে। প্রধান উপদেষ্টা পুনর্ব্যক্ত করেন, সব প্রতিবেশীর সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি ভবিষ্যৎ নির্মাণ অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান অগ্রাধিকার। তিনি বলেন, আপনার এই সফর এই অভিন্ন ভবিষ্যতের ভিত্তিপ্রস্তর হবে।
প্রধানমন্ত্রী তোবগে প্রধান উপদেষ্টার নেতৃত্ব ও অন্তর্বর্তী সরকারের কর্মকাণ্ডের প্রশংসা করেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশ বড় উদ্দেশ্য পূরণে সক্ষম হয়েছে এবং পরিবর্তনপর্বে শান্তি ও স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করেছে।
ব্যক্তিগতভাবে প্রধানমন্ত্রী তোবগে বলেন, সকালে ঢাকায় পৌঁছানোর সময় প্রধান উপদেষ্টা নিজে বিমানবন্দরে গিয়ে তাকে গ্রহণ করায় তিনি আনন্দিত ও আবেগাপ্লুত হন। তিনি নিউ ইয়র্ক, দাভোস, বাকু ও ব্যাংককে তাদের আগের সাক্ষাতের স্মৃতিও স্মরণ করেন।
বৈঠকে অন্যদের মধ্যে অর্থউপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ, জ্বালানি উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান, স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী, স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নূরজাহান বেগম, বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন, প্রধান উপদেষ্টার স্বাস্থ্যবিষয়ক বিশেষ সহকারী সাইদুর রহমান এবং ডাক, টেলিযোগাযোগ ও আইসিটি–বিষয়ক বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমেদ তৈয়্যব উপস্থিত ছিলেন।












