বাংলাদেশে জশনে জুলুছের প্রবর্তক আল্লামা সৈয়দ মুহাম্মদ তৈয়্যব শাহ্‌

রহমাতুল্লাহি আলায়হি

মাওলানা মুহাম্মদ আবদুল মান্নান | শনিবার , ৬ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ at ৮:১৫ পূর্বাহ্ণ

এ দেশের বৃহত্তম ধর্মীয় আধ্যাত্মিক সংস্থা ‘আনজুমানএ রহমানিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া’ এবং ‘জান্নাত নিশান’ জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া কামিল মাদরাসার প্রতিষ্ঠাতা উপমহাদেশের প্রখ্যাত ওলীই কামিল হযরতুল আল্লামা সৈয়দ আহমদ শাহ্‌ সিরিকোটী রহমাতুল্লাহি আলাইহি। তাঁর যোগ্যতম উত্তরসূরী ও প্রধান খলীফা হিসেবে মুর্শিদে বরহক আল্লামা সৈয়দ মুহাম্মদ তৈয়্যব শাহ্‌ রহমাতুল্লাহি আলাইহি এদেশের মানুষের মনে অকৃত্রিম নবীপ্রেম ও পূতপবিত্র ইসলামের আদর্শে আদর্শবান হবার প্রতি একান্ত নিষ্ঠা ও আগ্রহকে জাগ্রত করার জন্য অনেক যুগোপযোগী ও বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহণ করে চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন। তাঁর ওইসব ফলপ্রসূ ও সুদূরপ্রসারী পদক্ষেপের মধ্যে পবিত্র রবিউল আওয়াল মাসে ‘জশনে জুলুছে ঈদে মিলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র প্রবর্তন অন্যতম। এ জুলুছ হচ্ছে পবিত্র রবিউল আউয়াল মাসে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র বেলাদত শরীফকে স্বাগত জানিয়ে নবীই পাকের শুভ আবির্ভাবে অকৃত্রিম খুশি প্রকাশ করে সারাদেশে লাখো লাখো মুসলিম জনতার নূরানী শোভাযাত্রা (জশনে জুলুছ)। এ ধর্মীয় জুলুছ আজ ইসলামী সংস্কৃতিরও একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। বিগত ১৯৭৪ ইংরেজিতে পবিত্র রবিউল আউয়াল শরীফের ১২ তারিখ সকল পীরভাই ও সর্বস্তরের মুসলমানদের নিয়ে সম্পূর্ণ শরীয়ত সম্মত উপায়ে শান্তিপূর্ণ ও সুশৃঙ্খলভাবে জশনে জুলুছে ঈদে মিলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আয়োজন করার জন্য আনজুমানএ রহমানিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়াকে নির্দেশ দান করেন। হুজুর কেবলার নির্দেশানুসারে ওই বছর চট্টগ্রাম বলুয়ারদীঘি পাড়স্থ খানকাহএ কাদেরিয়া সৈয়্যদিয়া তৈয়বিয়া শরীফ থেকে এক বর্ণাঢ্য ‘জশনে জুলুছ’ বের হয়ে চট্টগ্রামের প্রধান প্রধান সড়ক প্রদক্ষিণ করে ষোলশহরস্থ জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া কামিল মাদরাসা প্রাঙ্গণে সমাপ্ত হয়। ওই বছর ‘জুলুস’র নেতৃত্ব দেন আনজুমান’র তৎকালীন সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট আলহাজ্ব নূর মুহাম্মদ সওদাগর আলকাদেরী। ১৯৭৫ সালে পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবীর মাসেও একইভাবে আনজুমানএ রহমানিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়ার ব্যবস্থাপনায় জশনে জুলুছ আরো বড় পরিসরে আয়োজন করা হয়। এরপর থেকে নিয়মিতভাবে জশনে জুলুছের সফলভাবে আয়োজন করে আসছে।

আনজুমানএ রহমানিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া ট্রাস্টের উদ্যোগে প্রতি বছর ৯ই রবিউল আউয়াল রাজধানী ঢাকায় এবং ১২ই রবিউল আউয়াল চট্টগ্রামে মহাসমারোহে পবিত্র জশনে জলুছ আয়োজিত হচ্ছে। এ ধারাবাহিকতায় বিগত ১৯৭৬ সাল থেকে উভয় জুলুছে হুযুর কেবলা আল্লামা সৈয়দ মুহাম্মদ তৈয়্যব শাহ রহমাতুল্লাহি আলাইহি নেতৃত্ব দিতেন। অতঃপর বর্তমান হুজুর কেবলা আল্লামা সৈয়াদ মুহাম্মদ তাহের শাহ মুদ্দাযিল্লুহুল আলী ও পীরে বাঙ্গাল আল্লামা সৈয়দ মুহাম্মদ সাবির শাহ্‌ মুদ্দাযিল্লাহুল আলী নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন।

কেন এ জুলুছ?

মিছিল, শোভাযাত্রা, র‌্যালি ইত্যাদির মাধ্যমে প্রতিটি জনগোষ্ঠী তাদের সুদৃঢ় অস্তিত্ব ও ঐক্য, নিজেদের আদর্শ ত্রাণকর্তার প্রতি নিজেদের অকৃত্রিম ভালবাসা ইত্যাদি ঘোষণা করে থাকে। এটা সর্বযুগে স্বীকৃত নিয়ম। মানবতার মুক্তিসনদ ও শ্রেষ্ঠতম ত্রাণকর্তা, নবীই আকরাম সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লামর পবিত্র শুভাগমনে আনন্দ প্রকাশেরও অন্যতম শরীয়তসম্মত ও বরকতময় পদ্ধতি হাচ্ছে জশনে জুলুছের আয়োজন ও তাতে স্বতঃস্ফূর্তভাবে শরীক হওয়া। পবিত্র কোরআনের সুরা ইউনুস’র ৫৮নং আয়াতসহ বহু বিশুদ্ধ বর্ণনা তাছাড়া ‘সীরাতে হালবিয়া’সহ বহু বিশ্ববরেণ্য কিতাবে ‘জশনে জুলুছ’র পক্ষে অকাট্য ও জোরালো প্রমাণাদি মওজুদ রয়েছে। হুযুর কেবলার নির্দেশে নিয়মিত প্রকাশিত মাসিক তরজুমান ও জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলিয়া থেকে প্রকাশিত বিভিন্ন প্রামাণ্যপুস্তকে এ ধরনের ধর্মীয় জুলুছ বা মিছিলের বৈধতা ও উপকারিতা প্রমাণ করা হয়েছে। সুতরাং এমন পুণ্যময় কাজের বিরোধিতার কোন অবকাশই নেই। জুলুছের অগ্রভাগে থাকে ‘লাইলাহা ইল্লাল্লাহ’র যিকরকারী দল। আর গোটা মিছিলে থাকে ইয়া নবী সালাম আলাইকা’সহ না’তে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ভক্তিপূর্ণ তিলাওয়াত। অগণিত জুলুছকারীর বেশিরভাগই পদব্রজে যিকর ও না’ত পড়তে পড়তে পথ অতিক্রম করেন আর গাড়ীর বহর সুশৃঙ্খলভাবে তাতে অংশ নেয়। জুলুছে বহনকৃত কালেমা ও ইসলামী চিহ্নাদি খচিত পতাকা, ফেস্টুন ও ব্যাজ ইত্যাদি জুলুছকে করে অবর্ণনীয় শোভামণ্ডিত। সর্বোপরি প্রকাশ পায় ইসলামী জযবা। আরো লক্ষ্যণীয় যে, বিগত ১৯৭৪ সাল থেকে প্রবর্তিত এই জশনে জুলুছ সর্বস্তরের মুসলমানদের নিকট এতই সমাদৃত হয় যে, এরপর থেকে ক্রমশঃ বিভিন্ন সংস্থা, সম্মানিত পীরমাশায়েখের দরবারগুলো এবং বিভিন্ন মুসলিম জনগোষ্ঠীও রবিউল আউয়াল মাসে জশনে জুলুছের আয়োজন করে তাঁদের অকৃত্রিম নবীপ্রেমের বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়ে আসছেন।

পরিশেষে এ কথাই বলতে হয় যে, হুযূর কেবলা আল্লামা সৈয়দ মুহাম্মদ তৈয়্যব শাহ্‌ রহমাতুল্লাহি আলাইহি তাঁর সুদুর প্রসারী ও ফলপ্রসূ বিভিন্ন পদক্ষেপের ধারাবাহিকতায় ‘জশনে জুলুছ’ প্রবর্তন করে এ দেশের মানুষকে অকৃত্রিম নবীপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করেছেন। আর এরই মাধ্যমে এ দেশের সুন্নী মুসলমানদের বৃহত্তম ঐক্যের বার্তা ঘোষণা করে প্রিয়নবীর আদর্শে আদর্শবান হবার পথকে সুগম করেছেন। আমরা আজ এ মহান ওলী ও তাঁর বরকতময় অবদানসমূহের কথা অতি শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি।

মহাপরিচালকআনজুমান রিসার্চ সেন্টার, ষোলশহর, চট্টগ্রাম।

পূর্ববর্তী নিবন্ধশতবর্ষে আনজুমান-এ রহমানিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া ট্রাস্ট : ৫০ পেরিয়ে জশনে জুলুছ ও মাসিক তরজুমান
পরবর্তী নিবন্ধআপনার পদচিহ্নই জীবন-ললাটে খোদিত নিয়তি