বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষা ও গবেষণা এবং ট্যালেন্ট হান্ট প্রকল্প

ড. নারায়ন বৈদ্য | বুধবার , ১৪ মে, ২০২৫ at ৮:৫১ পূর্বাহ্ণ

ট্যালেন্ট হান্ট একটি নতুন শব্দ। ট্যালেন্ট শব্দের অর্থ হলো মেধাবী আর হান্ট (Hunt) শব্দের অর্থ হলো শিকার করা, খোঁজা বা অনুসন্ধান করা। বিশ্বের শিক্ষা ব্যবস্থায় ‘ট্যালেন্ট হান্ট’ প্রকল্প প্রথম চালু করে চীন। বিংশ শতাব্দীর শেষভাগে এবং একবিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকে চীন সরকার বিস্তারিত গবেষণা পরিচালনা করে দেখেন যে, চীন থেকে যে সব মেধাবী ছাত্রছাত্রী উচ্চশিক্ষা গ্রহণের জন্য আমেরিকা বা ইউরোপে বা অন্য যে কোনো দেশে গমন করেছে তাদের উচ্চশিক্ষা শেষে চীনে ফিরে গেছে মাত্র বিশ থেকে ত্রিশভাগ ছাত্রছাত্রী। অন্যরা হয়তো বিদেশি পুরুষ বা মহিলাকে বিয়ে করে বিদেশে রয়ে গেছে, অথবা উচ্চশিক্ষা গ্রহণের পর সেই দেশে চাকুরী বা গবেষণা কাজে নিয়োজিত রয়েছে। নিজ দেশে ফিরে আসার কোনো প্রয়োজন বোধ মনে করেনি। চীন সরকার দীর্ঘ তথ্য বিশ্লেষণে যখন উপলব্ধি করতে পারলো যে, চীনের মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের দেশে থাকার প্রবণতা ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে তখনই একটি পরিকল্পনা হাতে নেয়। এই প্রকল্পের নাম দেয়া হয় ‘ট্যালেন্ট হান্ট’ প্রকল্প। বিশ্বের কোনো দেশ তখনও এ সত্যটি উপলব্ধি করতে পারেনি। এইতো সেদিন ২০০৮ সালে চীন সরকার রাষ্ট্রীয়ভাবে একটি ‘ট্যালেন্ট হান্ট’ প্রকল্প শুরু করে। প্রকল্পের নাম যদিও ‘ট্যালেন্ট হান্ট’তবুও সমগ্র চীনে এটি পরিচিতি লাভ করে ‘থাউজেন্ট ট্যালেন্ট প্ল্যান’হিসেবে। ‘ট্যালেন্ট হান্ট’প্রকল্প চালু করার জন্য চীন সরকার ২০০৮ সালের পরবর্তী সময়ে বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করে। বিশেষ করে তরুণ ছাত্রছাত্রীদেরকে নিজ দেশে ফিরে আসার জন্য এমন কিছু সুযোগ সুবিধা চালু করে যাতে তারা আকৃষ্ট হয়। শুধু আকৃষ্ট করার প্রকল্প চীন সরকার হাতে নেয়নি। একই সাথে এ সকল মেধাবী ছাত্রছাত্রীরা যাতে উন্নত দেশের গবেষণা লব্ধ জ্ঞানকে নিজ দেশে কাজে লাগাতে পারে তার জন্য নিজ দেশে গবেষণা সুবিধা প্রদান করতে থাকে। একই সাথে সমগ্র চীনে প্রাথমিকভাবে পাঁচ শতাধিক গবেষণাগার নির্মাণ করে যেখানে সর্বোচ্চ উন্নত মানের গবেষণা পরিচালনা করা যায়। আর এসব গবেষণাগারে উন্নত যন্ত্রপাতি, রাসায়নিক দ্রব্যাদি ও গবেষণার অন্যান্য সরঞ্জামের জোগান দেয় সরকার। শুধু তাই নয়, এই প্রকল্পের অধীনে তীব্র প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে তরুণ গবেষকদের চীনে ফেরানো হয়। তাদের উচ্চ বেতন ভাতা ও গবেষণার জন্য ফান্ড দেয়া হয়। পিএইচডি এবং পোস্ট ডক গবেষণার মান, পাবলিকেশন ইত্যাদির ওপর ভিত্তি করে ৩০৩৫ বছর বয়সী তরুণ গবেষকদের সরাসরি প্রফেসরশিপও দেওয়া হয়। বিগত ১৫ বছরেই চীনের গবেষণা ও আবিষ্কার উদ্ভাবনের সংস্কৃতি পূর্বের তুলনায় বহুগণ বৃদ্ধি পেয়েছে। এর পিছনে কাজ করেছে একমাত্র ‘থাউজেন্ট ট্যালেন্ট প্ল্যান’ বা ‘ট্যালেন্ট হান্ট’ প্রকল্প। ভারতের দিকে তাকালেও একই অবস্থা দেখা যাবে। সমগ্র ভারতজুড়ে রয়েছে অসংখ্য আইআইটি প্রতিষ্ঠান। এ প্রতিষ্ঠানগুলো বিশ্বমানের। এই সব প্রতিষ্ঠান থেকে ডিগ্রি নিয়ে তারা সমগ্র ভারতে ছড়িয়ে পড়ে। এমনকি সমগ্র বিশ্বে এসব প্রতিষ্ঠান থেকে ডিগ্রিপ্রাপ্ত মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের চাহিদা রয়েছে প্রচুর। এ কারণে ভারতের আইআইটি থেকে ডিগ্রি প্রাপ্ত বেশ কিছু ছাত্রছাত্রী আমেরিকা, ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়াতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। আরো একটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে যে, আমেরিকা ও ইউরোপের বড় বড় আইটি কোম্পানিগুলোর সিও পদ দখল করে বসে আছে ভারতীয়রা। এক তথ্যে দেখা যায়, ইউরোপে বড় বড় যে কোনো কোম্পানি সর্বোচ্চ পদে দখল করে আছে ভারতীয়রা। এর পরিমাণ হচ্ছে প্রায় ত্রিশ শতাংশ। বাংলাদেশে একটি জাতীয় পত্রিকায় কিছুদিন আগে এরূপ একটি প্রতিবেদন এসেছিল। অবশ্য প্রতিবেদনে এর কারণও ব্যাখ্যা করা হয়েছে। এই কথার অর্থ এই যে, ইউরোপ বা আমেরিকা বা উন্নত অন্য কোনো দেশের বড় বড় কোম্পানিগুলো শুধু শুধু ভারতীয়দের উচ্চ পদে বসিয়ে রাখেনি। ভারতীয় এসব আইআইটি ইঞ্জিনিয়ারদের কাজ, মেধা, শ্রম, অভিজ্ঞতা, দায়িত্বশীলতা সর্বোপরি নিবেদিত কাজ দেখে তাদেরকে উচ্চ আসনে ইউরোপীয় কোম্পানিগুলো বসিয়েছে। বিনিময়ে এসব কোম্পানিগুলো তাদেরকে দিয়েছে সর্বোচ্চ বেতন, ভাতা, কাজ করার স্বাধীনতা এবং সব ধরনের সুযোগ সুবিধা।

আমেরিকা ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে এশিয়া থেকে যে সব মেধাবী ছাত্রছাত্রীরা পিএইচডি এবং পোস্ট ডক করতে যায় তাদের ল্যাবে গবেষণা ও বিভিন্ন পাবলিকেশন কোনো অংশে আমেরিকা বা ইউরোপের অন্যান্য দেশের ছাত্রছাত্রীদের তুলনায় নিম্নমানের নয়। বাংলাদেশের অনেক তরুণ ছাত্রছাত্রী একই মানের গবেষণা করে থাকে। ক্ষেত্র বিশেষে আরো উন্নত গবেষণা করে থাকে। একজন ভারতীয় বা চীনা ছাত্র বা ছাত্রী উন্নত দেশে যে সব অধ্যাপকের অধীনে কাজ করে, বাংলাদেশের একজন তরুণ গবেষক ও সেই অধ্যাপকের অধীনে কাজ করার যোগ্যতা রাখে। এমন কি বিশ্বের সেরা গবেষকদের অধীনে কাজ করেছে বা এখনও করছে। অথচ ভারতীয় বা চীনা একজন গবেষক (ছাত্র) দেশে ফিরে গিয়ে তার জ্ঞানের পরিধিকে বা অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগাতে সরকার যথেষ্ট সুযোগ দেয়। তারা কাজ করে বিভিন্ন ক্ষেত্রে নিজ দেশে সাফল্যও দেখিয়েছেন। অথচ বাংলাদেশি কোনো তরুণ ছাত্রদেশে ফিরে এলে তিনি তার গবেষণার ও অভিজ্ঞতার বা জ্ঞানের দশ শতাংশ নিজ দেশে কাজে লাগাতে পারতেন। কিন্তু বাংলাদেশে একজন তরুণ গবেষকের পক্ষে বিষয়টি তত সহজ নয়। চীনা তরুণ গবেষকেরা দেশে ফিরে গিয়ে কাজ করার মত একটি পরিবেশ পেয়েছেন। সর্বোপরি ৩০৩৫ বছর বয়সে শিক্ষকতার সর্বোচ্চ পদ ‘প্রফেসর’ পদবীটাও পেয়েছেন যা তাকে আরো অধিক মনোযোগ সহকারে গবেষণা করার জন্য অনুপ্রাণিত করে। কিন্তু বাংলাদেশি একজন তরুণ, দেশের একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে যাওয়ার পথই আজও সুগম হয়নি। দেশের কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালযের উপাচার্য ট্যালেন্ট হান্টের কোনো উদ্যোগ এখনো পর্যন্ত নিতে দেখা যায়নি। নিবেই বা কি করে? তারাও বিধিবদ্ধ কতগুলো নিয়মে বাধা। তাছাড়া স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের চারটি বিশ্ববিদ্যালয়কে স্বায়ত্তশাসনের অলংকার পরাতে জন্ম নেয় ‘বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ ১৯৭৩’। কিন্তু সেই অধ্যাদেশ যথাযথ কাজে লাগানোকে বাদ দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও ক্ষমতালিপসু শিক্ষকরা বিভিন্ন সরকারের পদলেহন করে সেই অধ্যাদেশেরই মর্যাদাহানি করেছেন। ক্ষমতার স্বাদ পেতে ও ক্ষমতাবানের পূজারি হওয়ায় কী আপ্রাণ চেষ্টা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা করে থাকেন তা বিগত পনের বছরের ইতিহাস দেখলে স্পষ্ট হয়। সুতরাং ‘ট্যালেন্ট হান্ট’উপাচার্যদের মুখ্য বিষয় নয়।

প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশের উচ্চ শিক্ষার মান ও গবেষণা, অর্থনীতির সেই ‘দারিদ্র্যের দুষ্টচক্র’এর মত বৃত্তে ঘুরপাক খাচ্ছে। এখান থেকে উঠে আসা কিছুতেই সম্ভব হচ্ছে না। অবশ্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর তুলনায় প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কিছুটা মনোযোগী। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কিছুটা কম মেধাবী শিক্ষার্থীদের নিয়ে এগিয়ে গেলেও এসব বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আর্থিক ক্ষমতা অনেকাংশে সীমিত থাকা সত্ত্বেও তারা চেষ্টা করে। আমার দুইটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে বিচরণ করার সৌভাগ্য হয়েছে। আমি শিক্ষকতাও করেছি আবার প্রশাসনিক কাজেও জড়িত ছিলাম। বিজিসি ট্রাস্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ এ যেমন মেধাবী শিক্ষকদেরকে শিক্ষকতার সুযোগ দেয়া হয় তেমনি ইউএসটিসিতেও সর্বোচ্চ গবেষণাকারী শিক্ষকদেরকে শিক্ষকতার সুযোগ দেয়া হয়। প্রকৃতপক্ষে এসব বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ‘ট্যালেন্ট হান্ট’নীতি অনেকাংশে অনুসরণ করে।

লেখক : প্রাবন্ধিক; অবসরপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ, গাছবাড়ীয়া সরকারি কলেজ

পূর্ববর্তী নিবন্ধদূরের টানে বাহির পানে
পরবর্তী নিবন্ধপ্রবাহ