আন্ত:রাষ্ট্রসম্পর্ক সবসময়ই একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তাই আধুনিক রাষ্ট্র মাত্রই তাদের আমলাতন্ত্রের চৌকস কর্মকর্তাদের পররাষ্ট্র বিভাগ বা ফরেন অ্যাফেয়ার্স ডিভিশনে নিয়োজিত রাখেন। সাধারণত জনপ্রতিনিধিত্বশীল যে কোনো সরকার জনগণের আশা আকাঙ্ক্ষা এবং জাতীয় স্বার্থের নিরিখে নিজ নিজ দেশের পররাষ্ট্রনীতি চৌকষ কর্মকর্তাদের মাধ্যমে বাস্তবায়নে তৎপর থাকেন। যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত দুই মহাদেশে অবস্থিত দুটো বড় গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। ঐ দু’দেশের সাথেই বাংলাদেশের সরকার ও জনগণের বহুমাত্রিক সম্পর্ক যেমন রয়েছে তেমনি রাষ্ট্রদ্বয় বাংলাদেশের উন্নয়ন সহযোগীও বটে। তন্মধ্যে ভারত বাংলাদেশের নিকটতম প্রতিবেশী। আজকের লেখায় আমরা বাংলাদেশের সাথে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের সম্পর্কের সামপ্রতিক গতি প্রকৃতি এবং কিছু প্রাসঙ্গিক বিষয় আলোচনা করার চেষ্টা করব।
নিকট অতীতে অর্থাৎ বিগত শেখ হাসিনা সরকারের আমলে যুক্তরাষ্ট্র বারবার বাংলাদেশের গণতন্ত্র ও মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে আসছিল। বিশেষ করে ভোটারবিহীন একতরফা নির্বাচন ব্যবস্থা,গুম, খুন ,দমন পীড়ন ইত্যাদি ইস্যুতে তারা উচ্চ পর্যায়ে প্রতিনিধি পাঠিয়ে এবং বিবৃতি দিয়ে বাংলাদেশকে সতর্ক করার চেষ্টা করেছিল। এক পর্যায়ে তারা বিভিন্ন রকম সেঙশন বা বিধিনিষেধ দেওয়া শুরু করেছিল। যুক্তরাষ্ট্রের এ সমস্ত প্রয়াসের সাথে একজন মার্কিন কূটনীতিক এর নাম এদেশে ব্যাপক আলোচনায় আসে। আর তিনি হলেন মিস্টার ডোনাল্ড লু। লু চীনাবংশোদ্ভুত একজন মার্কিন নাগরিক যিনি ১৯৬৬ সালে ক্যালিফোর্নিয়ার হান্টিংটন বিচে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ১৯৮৮সালে প্রিন্সটনইউনিভার্সিটির প্রিন্সটন স্কুল অফ পাবলিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্স থেকে স্নাতক পাস করেন। অতঃপর তিনি ১৯৯০ সালে ইউনাইটেড স্টেটস ফরেনসার্ভিসে যোগদান করেন। দুই সন্তানের জনকলুইংরেজি ছাড়াও চীনা, পশ্চিম আফ্রিকান ক্রিও, উর্দু, হিন্দি, রুশ, জর্জিয়া ,আজারবাইজানি এবং আলবেনীয় ভাষায় কথা বলেন। তিনি ১৯৯২ সাল থেকে ৯৪ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানের পেশোয়ারে রাজনৈতিক কর্মকর্তা হিসেবে, ১৯৯৪ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত জর্জিয়ার তিবলিসীতে কনসুল্যার অফিসার হিসেবে, ১৯৯৬ থেকে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত রাষ্ট্রদূত ফ্রাঙ্ক উইজনারের বিশেষ সহকারী হিসেবে, ১৯৯৭ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত ভারতের নয়াদিল্লিতে পলিটিক্যাল অফিসার হিসেবে, ২০০১ থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত মধ্য এশিয়া ও দক্ষিণ ককেশাস বিষয়ক অফিসে উপ–পরিচালক, ২০০৩ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত কিরগিজিস্তানে এবং ২০০৭ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত আজারবাইজানে ডেপুটি চিফ অফ মিশনের দায়িত্ব পালন করেন।
২০১০ সালে মিস্টার লু ব ভারতের নয়া দিল্লিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসে ডেপুটি চিফ অফ মিশন নিযুক্ত হন। এরপর পরবর্তীতে ২০১৩ সালে আলবেনিয়ায় রাষ্ট্রদূত এবং ২০১৮ সালে তাঁকে কিরগিজিস্তানের রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। সবশেষে ২৩ এপ্রিল ২০২১ সালে বর্তমান মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন তাঁকে দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া বিষয়ক সহকারী সেক্রেটারি অফ এস্টেট হিসেবে মনোনীত করেন। এ নতুন দায়িত্ব পাওয়ার পর তিনি ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশে মার্কিন স্বার্থ ও সহযোগিতা নিয়ে নিবিড়ভাবে কাজ করে চলেছেন। পাকিস্তানের ইমরান খান সরকার এর সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের অবনতির প্রেক্ষাপটে ইমরান খান রাশিয়া সফর করে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সাথে মিটিং শেষ করে দেশে ফেরার পরেই পার্লামেন্টে অনাস্থা ভোটের শিকার হয়ে পদচ্যুত হন। পরে এ ঘটনার পেছনে ডোনাল্ডলুর হাত ছিল বলে অভিযোগ করেছিলেন ইমরান খান নিজেই।
বাংলাদেশের বিগত সরকার আমলেও ডোনাল্ডলু বহুবার বাংলাদেশ সফর করেছেন এবং বাংলাদেশ সরকারের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী, কর্মকর্তা, রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি, সুশীল সমাজের প্রতিনিধিসহ অনেকের সাথে বৈঠক করেছেন দেশের সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করা, মানবাধিকার পরিস্থিতি ইত্যাদি স্বাভাবিক করার জন্য। পরবর্তীতে বাংলাদেশের ৭ জানুয়ারি ২০২৪ সালের জাতীয় নির্বাচন যখন ভোটারবিহীন ও একতরফা ভাবে সম্পন্ন হয় তখন অনেকে মনে করেছিলেন মিস্টার লুর বাংলাদেশ মিশন ব্যর্থ হয়েছে। কিন্তু ৬ মাসের মাথায় ব্যাপক গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ও সরকার প্রধানের দেশ ছেড়ে পালানোর ঘটনায় প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী নিজেই মিস্টার লু ও যুক্তরাষ্ট্রের হাত আছে বলে অভিযোগ করেছেন। বলাবাহুল্য, বিগত শেখ হাসিনা সরকারের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের দৃষ্টিভঙ্গির ঠিক উল্টো দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করেছে ভারত সরকার। গণতন্ত্র ও গুম খুনের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র যেখানে বারবার গভীর উদ্যোগ জানিয়েছে সেখানে ভারত সরকার ওইগুলোকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় বলে মন্তব্য করেছে। উপরন্তু অনেক বিশ্লেষক বাংলাদেশে অগণতান্ত্রিক নির্বাচন ও স্বৈরতান্ত্রিক শাসনে ভারত সরকারের পৃষ্ঠপোষকতাকে দায়ী করেছেন।
যাই হোক, জুলাই ২০২৪ এর গণঅভ্যুত্থানে শত শতছাত্র জনতার শহীদ হবার মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনার দীর্ঘ ১৬ বছরের শাসনামলের অবসান ঘটে তাঁর পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নেওয়ার মধ্য দিয়ে। বাংলাদেশ সরকারের একটা সামরিক হেলিকপ্টারে করে তিনি যখন প্রতিবেশী ভারতের একটা এয়ার বেইসে অবতরণ করেন তখন সেখানে তাঁকে বরণ/রিসিভ করেন ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল। প্রকাশিত খবরে জানা যায়, মিডোভাল বাংলাদেশের সাবেক এ প্রধানমন্ত্রীর সাথে সর্বশেষ পরিস্থিতি নিয়ে বৈঠকও করেন। এদিকে ৫ আগস্ট ২০২৪ সালে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ৮ আগস্ট ২০২৪ সালে রাষ্ট্রপতি জনাব শাহাবুদ্দিন নোবেল জয়ী ডক্টর মুহাম্মদ ইউনূসকে প্রধান করে একটা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের হাতে সরকারের দায়িত্ব অর্পণ করেন।
প্রসঙ্গত এখানে মিডোভাল সম্পর্কে একটু আলোচনা করতে চাই। অজিত কুমার ডোবাল ১৯৪৫ সালের ২০ জানুয়ারি ভারতের যুক্ত প্রদেশে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৬৭ সালে আগ্রা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৬৮ সালে তিনি ইউনিয়ন পাবলিক সার্ভিস কমিশনের পরীক্ষায় প্রথমবারে উত্তীর্ণ হয়ে যান। ঐ সালেই তাঁকে সহকারী পুলিশ সুপার এসপি হিসাবে কেরালা ক্যাডারে ভারতীয় পুলিশ সার্ভিসে পদায়ন করা হয়। যোগদানের পরপরই তিনি সরকারের বিভিন্ন এসাইনমেন্ট দক্ষতার সাথে সম্পন্ন করে সুনাম করতে থাকেন। চাকুরি জীবনের সাত বছরের মধ্যেই তিনি প্রেসিডেন্ট পদক পেয়ে যান। ২০০৪ সালে ইন্টেলিজেন্স ব্যুরো এর পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব লাভ করেন এবং এরপর আইবি এর অপারেশন শাখার প্রধান হিসেবে এক দশক কাজ করেন। তিনি একজন গুপ্তচর এবং গোয়েন্দা প্রধান হিসেবে প্রতিবেশী পাকিস্তানসহ পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় সফলতার সাথে দায়িত্ব পালন করেন। উইকিপিডিয়ার বর্ণনা মতে, ইন্দিরা গান্ধী সরকারের সময় ভারতের সাথে সিকিমের একত্রীকরণের যে অ্যাসাইনমেন্ট তাতে তিনি গোয়েন্দাদের নেতৃত্ব দিয়েছেন এবং সফল হয়েছেন। তিনি ভারতের তৃতীয় জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা এম কে নারায়ণের অধীনে একটি সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য সন্ত্রাসবাদ বিরোধী অভিযানে প্রশিক্ষণ পেয়েছিলেন। ২০০৫ সালের জানুয়ারিতে মিস্টার ডোবাল আইবি এর পরিচালক হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন। অবসর জীবনে তিনি ভিআইএফ নামক একটি পাবলিক পলিসি থিং ট্যাংক এর সাথে যুক্ত হয়ে ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা নিয়ে বিভিন্ন সভা সেমিনারে আলোচনা এবং পত্র–পত্রিকায় লেখালেখি চালিয়ে যেতে থাকেন। ২০০৯ এবং ২০১১ সালে তিনি বিজেপি (ভারতীয় জনতা পার্টি) দ্বারা গঠিত টাস্ক ফোর্স এর একটি অংশ হিসেবে অন্যদের সাথে ‘ইন্ডিয়ান ব্ল্যাকমানি অ্যাবরড ইন সিক্রেট ব্যাংকস’ এবং ‘ট্যাক্স হ্যাভেনস’ বিষয়ে দুটি প্রতিবেদনের কোরাইটার হিসেবে সুনাম কুড়িয়েছেন। ৩০ মে ২০১৪ সালে তিনি ভারতের বিজেপি সরকার কর্তৃক পঞ্চম জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা হিসেবে নিযুক্ত হয়ে এখন অব্দি কাজ করে চলেছেন।
আমরা জানি, বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির মূল ভিত্তি হচ্ছে – সবার সাথে বন্ধুত্ব, কারো সাথে শত্রুতা নয়। বাংলাদেশের প্রায় সব সরকার এ নীতি অনুসরণ করে এসেছে। দৃশ্যত ডক্টর ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সাথে ভারতসহ প্রায় সব দেশই আন্তরিকভাবে কাজ করার অঙ্গীকার ঘোষণা করেছেন। প্রবন্ধে আলোচিত ডোনাল্ড লু্, মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী তাঁর দলবল নিয়ে ইতিমধ্যেই বাংলাদেশ সফর করেছেন এবং সরকার প্রধানের সাথে বৈঠক করে বিভিন্ন সাহায্য ও সহযোগিতার অঙ্গীকার ঘোষণা করেছেন। জাতীয় স্বার্থে ঐক্যবদ্ধ বাংলাদেশীরা প্রতিবেশী ভারতসহ পৃথিবীর সব দেশের সাথে বিশেষ করে উন্নয়ন সহযোগী রাষ্ট্র চীন, জাপান, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, মধ্য প্রাচ্যের দেশগুলোসহ সব রাষ্ট্রের সাথে দৃশ্যমান সহযোগিতা আশা করে। বিগত সরকারের প্রতি কিছু কিছু বিষয়ে ভারতের বর্তমান সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তীব্র প্রতিবাদ বা সমালোচনার সৃষ্টি করলেও বৃহত্তর প্রতিবেশী হিসেবে বাংলাদেশের যেমন গণতান্ত্রিক ভারতকে পাশে দরকার তেমনি একটি গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ ভারতসহ এ অঞ্চলের সবার জন্যই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের আশা থাকবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার তাদের মেধা ও সততা দিয়ে জাতীয় ঐক্যকে দৃঢ় ও মজবুত করবেন এবং স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব,পারস্পরিক আত্মমর্যাদা, জাতীয় স্বার্থ ইত্যাদি অক্ষুণ্ন রেখে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ভারত, ইউরোপীয় ইউনিয়ন সহসকল রাষ্ট্রের সাথে বন্ধুত্ব ও সহযোগিতার সম্পর্ক গড়ে তুলতে সক্ষম হবেন, সচেষ্ট থাকবেন। কারো এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য এ অঞ্চলে যেন কোন যুদ্ধ অবস্থার সৃষ্টি না হয়, উন্নয়ন বিপন্ন না হয় সম্মিলিতভাবে সবাইকে তা নিশ্চিত করতে হবে।
লেখক: গবেষক, শিক্ষাবিদ। প্রধান উপদেষ্টা,
রাজনীতি বিজ্ঞান অনুশীলন কেন্দ্র, চট্টগ্রাম।