মৎস্য সম্পদ বাংলাদেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে আসছে। আমাদেরকে মনে রাখতে হবে, দেশের প্রাণিজ আমিষ ও পুষ্টি চাহিদার বড় অংশ আসে মাছ থেকে। মিঠাপানির মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে তৃতীয় স্থানে রয়েছে। দারিদ্র্য বিমোচন ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে এই খাত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছে। কাজেই এ উন্নয়নকে টেকসই করতে হলে পরিকল্পিত ভাবে যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। “মাছে ভাতে বাঙালি” বাংলার জনপ্রিয় প্রবাদ। কিন্তু বর্তমান বাস্তবতায় মূল্যবৃদ্ধি ও দুষ্প্রাপ্যতার কারণে আমাদের খাদ্য তালিকায় মাছের প্রাধান্য আগের মতো নেই। দেশের খাল– বিল নদী, হাওর – বাঁওড়ে এখন মাছের পরিমাণ আশাতীতভাবে কমে গেছে। অবশ্য আধুনিক মৎস্য চাষাবাদ দেশে মাছের বাড়তি যোগান এনে দিয়েছে। তবে এ খাতে এখনো পর্যন্ত সমুদ্রের অবদান উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পায়নি।
বেসরকারি প্রতিষ্ঠান “সেভ আওয়ার সি” এর তথ্য অনুযায়ী প্রতিবছর বঙ্গোপসাগর থেকে ৮০ লাখ টন মাছ ধরা হয়। কিন্তু বাংলাদেশের জেলেরা ধরতে পারছেন মাত্র ৭ লাখ টন মাছ। এখনো সমুদ্র থেকে মূলত বিভিন্ন প্রজাতির মাছ ও চিংড়ি বেশি ধরা হয়। কারণ খাবার হিসেবে বাংলাদেশিদের মাঝে এগুলোর চাহিদাই বেশি। অনেক জায়গায় অক্টোপাস, স্কুইড, ক্যাটল ফিস, কাঁকড়া বা ঝিনুক খাওয়ার অভ্যাস তৈরি হয়েছে। এগুলোর স্থানীয় বাজারে চাহিদা কম থাকলেও এসব মাছ প্রচুর পরিমাণে ধরা হয় কারণ এগুলো বিদেশে রপ্তানি হয়ে থাকে। বঙ্গোপসাগর থেকে গত ১৩ বছরে সামুদ্রিক মৎস্য আহরণ বেড়েছে প্রায় ৪২ শতাংশ। ২০০৯–২০১০ অর্থবছরে বঙ্গোপসাগরে মৎস্য আহরিত হয় ৫ লাখ ১৭ হাজার ২৮ টন এবং ২০২১–২০২২ অর্থবছরে সামুদ্রিক মৎস্য আহরণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছিল ৭ লাখ ৩৪ হাজার ৫৯৪ টন। অর্থাৎ ১৩ বছরে সমুদ্র থেকে মৎস্য আহরণ বেড়েছিল ২ লাখ ১৭ হাজার ৩১৩ টন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন সামুদ্রিক মৎস্য আহরণের পরিমাণ বাড়লেও বাণিজ্যিকভাবে বিদেশে রপ্তানিযোগ্য মাছের পরিমাণ বাড়াতে হবে। মৎস্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন সমুদ্রে মাছের পর্যাপ্ততা নিশ্চিত করতে অতিরিক্ত মাছ শিকার বন্ধ করতে হবে। বিদেশি জাহাজ যাতে আমাদের সমুদ্র সীমায় ঢুকে বেপরোয়াভাবে মৎস্য শিকার করতে না পারে সে ব্যাপারে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। সামুদ্রিক মৎস্য অধিদপ্তরের আওতায় বর্তমানে সমুদ্রে মৎস্য আহরণে নিবন্ধিত বাণিজ্যিক ট্রলার রয়েছে ২৩১ টি যারমধ্যে ফিশিং এ নিয়োজিত প্রায় ২২০ টি। গবেষকরা বলছেন সমুদ্রে ৪০ থেকে ১০০ মিটার এলাকায় কোন্ ধরনের ট্রলার বা জাহাজ মাছ ধরবে তা নির্ধারিত থাকলেও সে নিয়ম মানা হচ্ছেনা। সীমানা পরিবর্তনের কারণে বড় ট্রলার বা জাহাজ নৌকার এলাকায় ঢুকে পড়লে অনেক মাছ নষ্ট হয়ে যায়। বাংলাদেশের সামুদ্রিক সীমানায় প্রজনন সময়ে ৬৫ দিন মৎস্য আহরণ। নিষিদ্ধ কালে মৎস্য আহরণ বন্ধে নজরদারি জোরদারের নির্দেশ দিয়েছেন মৎস্য ও পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়। মৎস্য ও পানি সম্পদ মন্ত্রী বলেন প্রজনন সময়ে মৎস্য আহরণ কার্যক্রম বন্ধ রাখা গেলে এবং কঠোরভাবে বাজার তদারকি অব্যাহত থাকলে যার ফলে সামুদ্রিক মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে।
বঙ্গোপসাগরে ভারত মিয়ানমারের সাথে সমুদ্রসীমার বিরোধ নিষ্পত্তি হয় আন্তর্জাতিক আদালতের রায়ে। ২০১১ খ্রিস্টাব্দে ইটলসের রায়ে মিয়ানমারের সঙ্গে এবং ২০১৪ খ্রিস্টাব্দে আন্তর্জাতিক সালিসি আদালতের রায়ে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা নির্ধারিত হয়। মিয়ানমারের সাথে আইনী লড়াইয়ে ১ লক্ষ ১১ হাজার বর্গকিলোমিটার এবং ভারতের সাথে সমুদ্রসীমা বিরোধ সংক্রান্ত রায়ে ১৯ হাজার ৪৬৭ বর্গকিলোমিটার এলাকায় বাংলাদেশের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশের অর্জিত মোট সমুদ্র এলাকার আয়তন ১ লক্ষ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটার। বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা চূড়ান্তভাবে চিহ্নিত হওয়ায় দেশের অর্থনীতিতে এর ব্যাপক প্রভাব পড়বে। এক্ষেত্রে দেশের সামগ্রিক মানচিত্র তৈরির পাশাপাশি সমুদ্রসীমায় তেল, গ্যাস, মূল্যবান খনিজ সম্পদ ও মৎস্য সম্পদ আহরণ, সমুদ্র এলাকার নিরাপত্তা বিধান, মৎস্য ও সামুদ্রিক সম্পদ আহরণের জন্য দক্ষ জনবল তৈরির ব্যাপারে কেন্দ্রীয়ভাবে একটি কৌশলগত পরিকল্পনা থাকা প্রয়োজন।
সরকারি তথ্য মতে চট্টগ্রাম অঞ্চল থেকে ৩৫৪ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত মহীসোপানের তলদেশে অবস্থিত সব ধরনের প্রাণিজ ও অপ্রাণিজ সম্পদের ওপর বাংলাদেশ সার্বভৌম অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে। সমুদ্র এলাকায় নিজস্ব অধিকার নিশ্চিত হওয়ার ফলে মৎস্য আহরণ, সমুদ্র তলদেশে প্রাকৃতিক সম্পদ অনুসন্ধান ও উত্তোলনে বাংলাদেশ কার্যকরী নীতি গ্রহণ করেছে যাকে বলা হয় ‘ব্লু ইকোনমি’ বা সমুদ্র সম্পদ অর্থনীতি। মৎস্য অধিদপ্তরের “মেরিন ফিসারিজ সার্বে ম্যানেজমেন্ট ইউনিট” এর বর্ণনা মতে জানা যায় ২০০০ খ্রিস্টাব্দের পর থেকে আমাদের ‘ভেসেল বেইজড’ যে গবেষণা সেটা পুরাপুরি বন্ধ ছিল। বাংলাদেশ মেরিন ফিসারিজ ক্যাপাসিটি বিল্ডিং প্রকল্পের মাধ্যমে এটা আবার শুরু করা হয়েছে। বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশ সীমানায় মাছ ধরা ৬৫ দিন বন্ধ থাকলেও ভারত বাংলাদেশের নিষেধাজ্ঞা একইসময়ে কার্যকর না থাকায় মাছধরা নিয়ে উভয় দেশের জেলেদের মাঝে কিছু অসন্তোষ ও সমস্যা দেখা দেয়।
বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের জেলেদের দাবি প্রতিবছর এ দেশের কোটি টাকার মৎস্য সম্পদ আহরণ করে নিয়ে যাচ্ছে ভিনদেশি জেলেরা। বিশেষ করে ভারতীয় জেলেদের অবাধ মৎস্য আহরণ চলে সুন্দরবন এলাকার বাংলাদেশ অংশের সাগরের বিশাল জলসীমায়। চট্টগ্রামের জেলেদের অভিযোগ প্রতিবেশী ভারত, মিয়ানমার এবং থাইল্যান্ডের জেলেরা অবৈধভাবে বড় বড় অত্যাধুনিক ট্রলার নিয়ে বাংলাদেশের জলসীমায় ঢুকে পড়ে এবং নৌবাহিনীর উপস্থিতি টের পেয়ে তারা দ্রুত পালিয়ে যায়। তারা বলেন গভীর সমুদ্রে আমাদের সীমানায় মাছ থাকলেও অবৈধ মৎস্য আহরণকারীদের কারণে আমাদের মৎস্য আহরণ ব্যাহত হচ্ছে। এসব অবৈধ মাছ শিকারীদের অত্যাধুনিক জালসহ আধুনিক বিভিন্ন সরঞ্জাম থাকায় তারা অনেক বেশি মাছ আহরণ করতে পারে। বাংলাদেশের জলসীমায় যে এলাকায় মাছের পরিমাণ বেশি সেই এলাকায় তারা মাছ শিকার করে। বঙ্গোপসাগরে ভারতীয় শিপিং ট্রলার বাংলাদেশী সমুদ্রসীমার প্রায় দেরশ কিলোমিটার ভেতরে ঢুকে মাছ ধরে নিয়ে যায়।
অবৈধ মৎস্য আহরণ নিয়ে অনেক সময় বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক থাকার পরও কোনো কোনো দেশ পার্শ্ববর্তী দেশের ওপর প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে থাকে। অবৈধ মৎস্য আহরণের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার সতর্কতামূলক হুশিয়ারিসহ ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট জোকো উইডোডো যুদ্ধ ঘোষণার কথা বলেন। তাঁর ঘোষণার বিপক্ষে ২০ মে ২০১৫ খ্রিস্টাব্দে চীনের একটি মৎস্য আহরণকারী জাহাজ দক্ষিণ চীন সমুদ্রের নিকটবর্তী ইন্দোনেশিয়ার জলসীমায় প্রবেশ করলে ইন্দোনেশীয় কর্তৃপক্ষ জাহাজটিকে ডুবিয়ে দেয়। এটি ছিল তাদের জাতীয় সতর্ক দিবসকে স্মরণ করে ফিলিপাইন, থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনামের ৪১ টি মৎস্য আহরণ করা জাহাজের অন্যতম একটি। এনিয়ে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার কিছু দেশের কাছে জাহাজ ডুবানোর নীতি গ্রহণ করার জন্য ইন্দোনেশিয়াকে সমালোচনার মুখোমুখি হতে হয়েছে। যদিও জোকো সরকার ও পরামর্শকরা এটিকে একটি প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ ধরে নিয়েছেন যেহেতু অবৈধ মৎস্য আহরণের বিষয়টি প্রতিবছর তাদের মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার রাজস্ব আয়ের ক্ষতির কারণ। “জাকার্তা পোস্ট ‘ এর মতে অক্টোবর ২০১৪ এবং মার্চ ২০১৫ এর মধ্যে তাদের মন্ত্রণালয় এবং নৌবাহিনী মালয়েশিয়া, পাপুয়া নিউ গিনি, ফিলিপাইন, থাইল্যান্ড এবং ভিয়েতনামের ১৮ টি অবৈধ মৎস্য আহরণকারী জাহাজ ডুবিয়ে দিয়েছিল।
বঙ্গোপসাগর থেকে প্রতিবছর আনুমানিক ৮০ লাখ টন মাছ ধরা হয়। অথচ সবচেয়ে সমৃদ্ধ সমুদ্রসীমার অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশ বঙ্গোপসাগর থেকে মাছ শিকার করছে বছরে গড়ে মাত্র সাত লাখ টন। মৎস্য সম্পদ আহরণ, সমুদ্রের তলদেশের সম্পদ আহরণ এবং তা উত্তোলন বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে উজ্জ্বল সম্ভাবনা বলে মনে করা হয়। তাই সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে অত্যন্ত বিচক্ষণতা, পেশাদারিত্ব ও আন্তরিকতাপূর্ণ উদ্যোগ নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। প্রতিবেশী মিত্র দেশগুলোর সাথে সরকারের উচ্চ মহলের পারস্পরিক বোঝাপড়া ও সহযোগিতা গ্রহণ ও প্রদানে সতর্কতা ও দূরদর্শিতাপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে মৎস্য সম্পদ ও সমুদ্র সম্পদ রক্ষায় সংশ্লিষ্ট সকলকে সমন্বিত উদ্যোগ নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। এ লক্ষ্য অর্জিত হলে আমাদের মৎস্য সম্পদ ও সমুদ্র সম্পদ বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে এবং “ব্লু ইকোনমি” বা সমুদ্র সম্পদ নির্ভর অর্থনীতিতে সুদূরপ্রসারী উন্নয়ন ঘটাতে সক্ষম হবে। আর এ জন্য আমাদের সমুদ্র সীমায় নিরাপত্তা বাড়াতে সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতর, নৌবাহিনী, কোস্ট গার্ড ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে বিশেষ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। যাতে করে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় অবৈধ মৎস্য আহরণ বন্ধ করা যায়।
লেখক : শিক্ষাবিদ, কলামিস্ট, প্রাবন্ধিক ও প্রাক্তন অধ্যক্ষ রাঙ্গুনিয়া সরকারি কলেজ।