বাংলাদেশের শ্রম আইন এবং গার্মেন্টস শ্রমিকদের অধিকার ও চ্যালেঞ্জ

আদনান আহমেদ রিফাত | মঙ্গলবার , ১২ নভেম্বর, ২০২৪ at ৫:২৭ পূর্বাহ্ণ

বাংলাদেশের গার্মেন্টস খাত দেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড হিসেবে পরিচিত। প্রায় ৪০ লাখ শ্রমিক এ খাতে কর্মরত, যাদের অধিকাংশই নারী। তারা স্বল্প বেতনে দিনরাত পরিশ্রম করলেও তাদের জীবনযাত্রার মান অত্যন্ত নিম্ন। যদিও বাংলাদেশে শ্রমিকদের অধিকার রক্ষায় আইন রয়েছে, বাস্তবে এই আইনগুলো যথাযথভাবে বাস্তবায়িত হচ্ছে না, ফলে শ্রমিকদের জন্য শ্রম আইন থেকে যে সুরক্ষা পাওয়ার কথা তা তারা পাচ্ছেন না। বাংলাদেশ শ্রম আইন, ২০০৬ শ্রমিকদের কাজের সময়, বেতন, নিরাপত্তা, ছুটি, ক্ষতিপূরণ, এবং অন্যান্য সুবিধা নিশ্চিত করার জন্য বিভিন্ন ধারা নিয়ে গঠিত। এই আইনে গার্মেন্টস শ্রমিকদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা থাকলেও বাস্তবে এসব বিধান অনেক ক্ষেত্রেই মানা হয় না।

শ্রম আইনের ধারা ১০০ অনুযায়ী, একজন শ্রমিক দৈনিক সর্বাধিক ৮ ঘণ্টা কাজ করতে পারবেন। সপ্তাহে ছয় দিন কাজের পর একদিন ছুটি দেওয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। তবে বাস্তবে অনেক গার্মেন্টস শ্রমিককে দৈনিক ১০১২ ঘণ্টা কাজ করতে হয়। বিশেষত নির্ধারিত সময়ের বাইরে ‘ওভারটাইম’ করতে বাধ্য হন, এবং অনেক সময় তারা যথাযথভাবে এই অতিরিক্ত কাজের জন্য অর্থসুবিধাও পান না। একই আইনের ধারা ১২৩ অনুযায়ী, একজন মহিলা শ্রমিককে মাতৃত্বকালীন ছুটি এবং সুবিধা পাওয়ার অধিকার দেওয়া হয়েছে। কিন্তু গার্মেন্টস কারখানাগুলোতে অনেক ক্ষেত্রেই এ সুবিধাগুলো অমান্য করা হয়। মাতৃত্বকালীন ছুটির আবেদন করলেই কিছু প্রতিষ্ঠান কর্মীদের ছাঁটাই করার পন্থা অবলম্বন করে, যা শ্রম আইনের স্পষ্ট লঙ্ঘন। শ্রম আইন ২০০৬ এর ১৪৮ ধারা অনুযায়ী, প্রতিটি কারখানায় শ্রমিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। কিন্তু বাস্তবিক চিত্র অনেক ভিন্ন। অগ্নিনিরাপত্তা বা ভবনের নিরাপত্তার যথাযথ ব্যবস্থা না থাকার কারণে প্রতিনিয়তই দুর্ঘটনা ঘটে। ২০১৩ সালে রানা প্লাজা ধসে হাজার হাজার শ্রমিকের প্রাণহানি ও আহত হওয়ার ঘটনা এ সমস্যার ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরে। বাংলাদেশ তৈরি পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজেএমইএ) ২০১৩ সালের এক প্রতিবেদন থেকে পাওয়া তথ্য মতে (১৯৯৩২০১৩) পর্যন্ত ২০ বছরের হিসাব অনুযায়ী বছরে গড়ে ১০ টি গার্মেন্টস কারখানায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। বর্তমানে এই হার আরো বেড়েছে বলে বিশ্লেষকদের ধারনা। ওই প্রতিবেদন অনুযায়ী একই কারখানায় একাধিকবার অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাও ঘটে। গার্মেন্টস শ্রমিকদের মাসিক মজুরি অনেক ক্ষেত্রেই তাদের জীবনধারণের জন্য পর্যাপ্ত নয়। গত বছরের নভেম্বর মাসে পোশাক শ্রমিকদের ন্যূনতম মাসিক বেতন ১২ হাজার ৫০০ টাকা চূড়ান্ত করেছে ন্যূনতম মজুরি বোর্ড। টাকা নির্ধারণ করলেও অনেক কারখানায় শ্রমিকদের সেই পরিমাণ বেতন সঠিক সময়ে বা সম্পূর্ণ দেওয়া হয় না। বর্তমান জীবনযাত্রার ব্যয় ও মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধির ফলে এ বেতনে তাদের মৌলিক চাহিদা মেটানো কঠিন হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশ শ্রম আইনের ১৭৬ ধারা অনুযায়ী শ্রমিকদের সংগঠনের অধিকার দিয়েছে এবং তাদের পক্ষ থেকে অধিকার দাবি করার সুযোগ রয়েছে। কিন্তু অনেক সময় শ্রমিকদের সংগঠনে অংশগ্রহণ করলে তাদের চাকরিচ্যুত করা হয় বা হুমকি দেওয়া হয়। ফলে তারা তাদের অধিকার দাবি করতে সাহস পান না। বাংলাদেশ সরকার শ্রম আইন সংশোধন ও আধুনিকায়ন করার জন্য বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছে, তবে আইনের বাস্তবায়ন অনেক ক্ষেত্রেই শিথিল। গার্মেন্টস কারখানাগুলোর মালিকদের সঙ্গে সরকারের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকায় প্রায়ই মালিকদের অনিয়ম অদৃশ্য থেকে যায়। ফলে শ্রমিকরা ভোগান্তির শিকার হন এবং তাদের অধিকার সুরক্ষিত হয় না।

গার্মেন্টস শ্রমিকদের জন্য বাংলাদেশ শ্রম আইন, ২০০৬এ অনেক সুরক্ষা ব্যবস্থা থাকলেও, তাদের জন্য এসব অধিকার বাস্তবায়িত হয় না। বাংলাদেশে শ্রমিকদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন করতে হলে সরকারকে কঠোর নজরদারি এবং শ্রম আইন বাস্তবায়নের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। শ্রমিকদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় গণমাধ্যম, সরকার ও সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষের সহযোগিতা প্রয়োজন। শ্রমিকদের জন্য ন্যায়সংগত মজুরি, কর্মপরিবেশ, এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সরকারের দায়িত্ব, যা বাস্তবায়িত হলে দেশের অর্থনীতি আরও শক্তিশালী হবে এবং শ্রমিকদের জীবনমান উন্নত হবে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধঅজিতকুমার গুহ : কীর্তিমান রবীন্দ্রগবেষক
পরবর্তী নিবন্ধ‘দরদীয়ারে বন্ধু’ : মরমী সুফীবাদের অনন্য দর্শন